মতামত

ফোনে আড়িপাতার অসাংবিধানিক চর্চা এবার থামুক

আমাদের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সদ্য প্রকাশিত এক রায়ে বলা হয়েছে, সংবিধানের ৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদে নাগরিকদের ব্যক্তিগত ও অন্যান্য যোগাযোগের ক্ষেত্রে গোপনীয়তার অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। এটি কোনো স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর জন্য সহজেই লঙ্ঘন করা যাবে না। হাইকোর্টের তিনজন বিচারপতির একটি বৃহত্তর বেঞ্চের দেওয়া ওই রায়ে অভিমত এসেছে, সরকারি-বেসরকারি মুঠোফোন অপারেটর কোম্পানি থেকে আনুষ্ঠানিক লিখিত চাহিদা ছাড়া এবং গ্রাহককে অবহিত না করে কললিস্ট বা কল রেকর্ড (কথোপকথন) সংগ্রহ অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত। হাইকোর্টের এই রায় নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার নাগরিক অধিকার সুরক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ও আশা–জাগানিয়া পদক্ষেপ।

সংবাদপত্রের খবরে রায়ের এই অংশকে পর্যবেক্ষণ হিসেবে বর্ণনা করা হলেও প্রকাশিত রায়ে তা যেভাবে বলা হয়েছে, তাকে সাধারণভাবে আমরা যেগুলোকে আদালতের পর্যবেক্ষণ বলে জানি, সে রকমটি বলা যাবে না। আদালত আলাদা করে কোনো পর্যবেক্ষণ দেননি। রায়ের মধ্যেই কথাগুলো বলেছেন। সুতরাং, একে আদালতের আদেশ হিসেবে গণ্য করাই যৌক্তিক বলে মনে করা চলে। বিচারপতিরা লিখেছেন, যোগাযোগের গোপনীয়তা রক্ষায় সাংবিধানিক অঙ্গীকার (ম্যান্ডেট) যথাযথ বাস্তবায়নে বিটিআরসি ও ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোর একটি বড় দায়িত্ব রয়েছে।

রায়ে তাঁরা বলেছেন, অডিও-ভিডিওসহ নাগরিকদের মধ্যে ব্যক্তিগত যোগাযোগ প্রায়ই ফাঁস হয় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে এসব প্রকাশিত হয়, যা এখনকার সাধারণ অভিজ্ঞতা। রায়ে তাঁরা স্পষ্ট করে বলেছেন, বিটিআরসি এবং ফোন কোম্পানিগুলো তাদের গ্রাহক ও দেশের নাগরিকদের মধ্যকার যোগাযোগের কোনো তথ্য আইনে অনুমোদিত না হলে কাউকে দিতে পারে না। তাঁদের কথায়, আইনটিও সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হবে। তাঁরা সাক্ষ্য আইন সংশোধন প্রয়োজন বলেও অভিমত দিয়েছেন। রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, শুধু সন্ত্রাস দমন আইন ২০০৯-এ সন্ত্রাসী ব্যক্তি বা কোনো সত্তার ইলেকট্রনিক মাধ্যমের আলোচনা বা সংলাপের রেকর্ড সংগ্রহ করা হলে তাকে সাক্ষ্য হিসেবে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অন্য আইনগুলোতে এ বিষয়ে অসম্পূর্ণতা আছে।

কোনো নির্দিষ্ট তদন্ত বা অনুসন্ধানে নিয়োজিত তদন্তকারী কর্মকর্তা কারও যোগাযোগের বিষয়ে বা ফোনকলের তালিকা চাইলে তাঁকে তদন্তকাজে তাঁর প্রয়োজনীয়তার কারণ জানিয়ে কোম্পানি বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অনুরোধ জানাতে হবে। তথ্যের সন্ধানে লিখিত অনুরোধ ছাড়া তা করা যাবে না। সেটা কেবল তখনই করা যাবে, যখন তা গ্রাহককে জানিয়ে করা হবে। রায়ে বলা হয়েছে, এর অন্যথা হলে সংগৃহীত নথি বা প্রমাণের আইনের চোখে সাক্ষ্য হিসেবে কোনো মূল্য থাকবে না। যে ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ এ ধরনের তথ্য-যোগাযোগের বিবরণ সরবরাহ করবেন, তিনি বা তাঁরা সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনে সহায়তার জন্য দায়ী হবেন।

তিনজন বিচারপতিই এই রায়ে পুরোপুরি একমত হয়েছেন এবং কোনো ধরনের ভিন্নমত দেননি। মামলাটির লিখিত রায় প্রকাশিত হয়েছে গত ২৯ সেপ্টেম্বর। মূল রায়টি ঘোষিত হয়েছিল ঠিক ১৩ মাস আগে ২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট। এই ১৩ মাসে ঠিক কতজনের টেলিফোনের গোপনীয়তা লঙ্ঘন হয়েছে, তা হয়তো আমরা কোনো দিনই জানতে পারব না। কিন্তু কিছু যে হয়েছে, তা বলা যায়। যাঁদের টেলিকথন সামাজিক মাধ্যমে ফাঁস করা হয়েছে, তাঁরা যে তা জানতেন না, সেটাও মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায়। পুলিশ হয়তো কললিস্ট ও টেলিকথনের সূত্র ধরে কিছু গুরুতর অপরাধের সন্দেহভাজন ব্যক্তিকেও আটক করেছে। কিন্তু এই রায়ের পর সেগুলো সাক্ষ্য হিসেবে আদালতের কাছে মূল্যহীন হয়ে গেছে। ফলে বিচারপতিরা যে শিশু সৈকত হত্যা মামলার রায়ে এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সেই সৈকতের পিতা সিদ্দিকুর রহমানের মতোই দুর্ভাগ্যজনকভাবে অন্য অনেক অপরাধের ভুক্তভোগীই হয়তো ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবেন।

গত ১৩ মাসে বেআইনিভাবে যাঁদের টেলিকথনের রেকর্ড ফাঁস হয়েছে, তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক হয়রানির শিকার ব্যক্তিও আছেন। উদাহরণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক সহসভাপতি নুরুল হকের কথা বলা যায়। নুরুল হক ব্যবসা করার সম্ভাবনা নিয়ে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে টাকাপয়সার বিষয়ে যে আলাপ করেছেন, তার একটি অডিও ফাইল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এখানে উদ্দেশ্যটা যে রাজনৈতিক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর গত এক দশকে এ রকম কত টেলিকথন যে ফাঁস হয়েছে, তার শেষ নেই।

ভিপি নুরুলের কপাল অপেক্ষাকৃত ভালো যে তাঁর পরিণতি তাঁর পূর্বসূরিদের একজন মাহমুদুর রহমান মান্নার মতো হয়নি। মান্নাকে ওই টেলিকথনের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় এক বছরের বেশি বিনা বিচারে লাল দালানের ভাত খেতে হয়েছে। আদালত তখন তাঁকে তাঁর সংবিধানপ্রদত্ত ব্যক্তিগত গোপনীয়তার নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা দিতে পারেননি। বিএনপির নেতাদের টেলিসংলাপ কিংবা সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও নিউ নেশন পত্রিকার সম্পাদক মইনুল হোসেনের ঘটনাও ভুলে যাওয়ার কথা নয়। তবে সবচেয়ে আলোড়ন জাগানো টেলিকথন ফাঁসের রহস্য কিন্তু আজও উদ্‌ঘাটিত হয়নি, যেটি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বের বিচারে বিশেষভাবে বিবেচ্য—মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান অবসরে যাওয়া বিচারপতি নিজামুল হকের টেলিফোন সংলাপ।

বাংলাদেশে টেলিফোনে আড়িপাতার প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা সরকারের বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থার বাইরে অন্য কারও কাছে থাকার কথা নয়। আর সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো স্বচ্ছতা নেই; বেসরকারি সংস্থা বা কোনো নাগরিক সংগঠনও বিষয়টি নিয়ে খুব একটা সক্রিয় নয়। এসব বিষয়ে যা তথ্য মেলে, তার উৎস প্রধানত বিদেশি সংবাদমাধ্যম ও প্রকাশনা। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউসের প্রকাশনা ফ্রিডম অন দ্য নেট-এ বাংলাদেশের আইন এবং প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম সংগ্রহের কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়। ওই প্রকাশনা অনুযায়ী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারকে (এনটিএমসি) সরকার আদালতের আদেশ ছাড়াই নাগরিকদের টেলিযোগাযোগের বিশদ সংগ্রহের আইনগত অধিকার দিয়েছে।

২০০১ সালের টেলিযোগাযোগ আইনে ২০১০ সালে একটি সংশোধনী আনার মাধ্যমে কোম্পানিগুলোর ওপর সব টেলিফোন কলের ডেটা অনির্দিষ্টকালের জন্য সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। সংস্থাটি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম সংগ্রহে তৎপর ছিল এবং রিপোর্টটিতে সে সময় আড়াই কোটি ডলার সম্ভাব্য ব্যয়ের কথা বলা হয়েছিল। সুইজারল্যান্ড, চীন, জার্মানি ও যুক্তরাজ্য থেকে যেসব প্রযুক্তি সংগ্রহের চেষ্টা করা হচ্ছিল, তার বিবরণও তুলে ধরা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত কী কী সংগৃহীত হয়েছে, তা এখনো অজানা।

যুক্তরাজ্যের বেসরকারি সংস্থা প্রাইভেসি ইন্টারন্যাশনালও নানা দেশে কীভাবে ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে, তার ওপর নজর রাখে। তাদের প্রকাশনাতেও বাংলাদেশে যুক্তরাজ্য থেকে প্রযুক্তি সংগ্রহের কথা আছে। আর ২০১৯ সালে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এনএসওর বিরুদ্ধে হোয়াটসঅ্যাপের দায়ের করা মামলা সূত্রে জানা যায়, বিশ্বের ৪৫টি দেশে ৩৩টি গ্রাহকের হয়ে এনএসও তাদের তৈরি পেগাসাস সফটওয়্যারের মাধ্যমে ১ হাজার ৪০০-এর বেশি মানুষের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে শীর্ষ ভিন্নমতাবলম্বী আহমেদ মনসুরের হোয়াটসঅ্যাপ হ্যাকিংয়ের কথা বেশ আলোচিত হয়েছিল। ভারতের দ্য ডেকান হেরাল্ড, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকায় এ বিষয়ে প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নামও ছিল।

আড়ি পেতে টেলিফোন ও ইন্টারনেটনির্ভর যোগাযোগমাধ্যমে তথ্য ও সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের চর্চা সারা বিশ্বেই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো করে থাকে। সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের কারণ দেখিয়ে চর্চাটির প্রসার ঘটেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে এই হাতিয়ারের অপব্যবহার রোধে গণতান্ত্রিক জবাবদিহির বিশেষ ব্যবস্থা আছে। আদালতের অনুমোদন এর অপব্যবহার রোধের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে থাকে। কিন্তু যেসব দেশে কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চালু রয়েছে, সেসব দেশে ভিন্নমত দমনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই কৌশলের নির্বিচার প্রয়োগ হয়। স্পষ্টতই আমাদের আইনে এর অপব্যবহার বন্ধের কোনো নিরোধক ব্যবস্থা নেই। আদালতের পূর্বানুমতির বিধান সংযোজন ছাড়া সাক্ষ্য আইনের পরিবর্তনে নাগরিকের মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা হবে, এমন আশা কম। তবে উচ্চ আদালত সংবিধান পরিপন্থী আইনগুলোর ক্ষেত্রে আরেকটু সাহসী ভূমিকা রাখতে উদ্যোগী হবেন, সেই আশা আমরা এখনো হারাইনি।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক