একটি ফেসবুক লাইভ আমাদের অনেক কিছু জানাল। আমরা কিছু দৃশ্য দেখলাম, কিছু কথা শুনলাম। ৯ মিনিট ৩৮ সেকেন্ডের লাইভ। পাঠকদের অনেকেরই অবশ্য তা দেখা ও শোনা হয়ে গেছে। যাঁরা এখনো এর বাইরে আছেন, তাঁদের জন্য লাইভের কিছু কথা ও দৃশ্যের বর্ণনা দিতেই হচ্ছে। শুরুতেই ধারাভাষ্য—‘আমাদের পরীক্ষা চলছে, সবাই লিখছে, আমি বসে আছি। সবাই লিখছে বাংলায়, আমি তো বাংলাই লিখি না, ইংলিশে লিখি। অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল পরীক্ষা হল ফেসবুকে লাইভ দেব। সেই ইচ্ছা আজ পূরণ হলো। ম্যাডামও দেখি আমাকে ভিডিও করছে। স্যারেরা ঘুমাচ্ছে, আমি ইংরেজিতে লিখেছি, সালামও লিখেছে।’
‘পরীক্ষা হল থেকে ফেসবুকে লাইভ’ করার খায়েশ পূরণকারী এই শিক্ষার্থীর নাম মনির হোসেন। ওনার একটি ডাকনাম আছে, সুমন। তিনি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আমরা তাঁকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। কারণ, তিনি ফেসবুক লাইভে না এলে অনেক কিছুই আমাদের জানা-বোঝার বাইরে থাকত। আমরা এখন জানতে পেরেছি, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন কম্পিউটার অফিস অ্যাপ্লিকেশন বিষয়ের ছয় মাস মেয়াদি কোর্সের চূড়ান্ত পরীক্ষা কীভাবে হয়। পরীক্ষার সময় সেই হলের অবস্থা কেমন থাকে, পরিদর্শক স্যার-ম্যাডামরা কী কী করেন।
যে ফেসবুক লাইভ আমাদের আলোকিত করল, বিনোদন দিল, তার জন্য হয়তো সুমনকে আরও ত্যাগস্বীকার করতে হবে। পরীক্ষায় যে এ প্লাস পাওয়া তাঁর প্রায় নিশ্চিত ছিল, তা থেকেও বঞ্চিত হতে পারেন তিনি। বেচারা সুমনের জন্য আরও একদফা আগাম সমবেদনা।
সুমনের কাছ থেকে আমরা আর কী কী জানলাম? ‘আমরা ছাত্রলীগ, যেখানে যাব সেখানেই বুলেট। রোজা থেকে পরীক্ষা দিচ্ছি, গোল্ডেন এ প্লাস পাব। পরীক্ষার খাতায় গ্রুপের জায়গা লিখে দিয়েছি, “এমপি আনার গ্রুপ”(সরকারি দলীয় স্থানীয় সাংসদ আনোয়ারুল আজিম আনার)। স্যাররা এ প্লাস না দিলে বোর্ডমোড ভেঙে ফেলবানে।’ আমরা জানলাম এবং বুঝলাম ছাত্রলীগের কর্মীরা সত্যিই ‘বুলেট’। স্যাররা তাঁদের এ প্লাস দিতে বাধ্য। না দিলে ‘বোর্ডমোড’ ভেঙে ফেলার ক্ষমতা তাঁরা রাখেন। পরীক্ষার খাতায় ‘গ্রুপের’ জায়গায় স্থানীয় সাংসদের ডাকনাম লিখে আসা যায়। বোঝা গেল, স্থানীয় সাংসদের নামে একটি ‘গ্রুপ’ আছে এবং তার পরিচিতিও রয়েছে।
আর ভিডিওতে আমরা কী দেখলাম? একটি বড় পরীক্ষা হল। ৫০ জনের মতো শিক্ষার্থী সেখানে রয়েছেন। তাঁদের সবার সামনে খাতা। পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থীদের সামনে উত্তরপত্র থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এমন একটি পরীক্ষার হলে বসেই সুমন কথা বলছেন, ভিডিও করছেন, সেখানে সবাইকে যুক্ত করার চেষ্টা করছেন। অন্য শিক্ষার্থী, এমনকি ম্যাডামকেও প্রশ্ন করছেন, হলের মধ্যে বেশ হাসি-ঠাট্টার পরিবেশ। দুজনকে পরীক্ষাকক্ষে পায়চারি করতে দেখা গেছে। যাঁদের মধ্যে একজনকে শিক্ষকের চেয়ার বসতে দেখা গেছে। এমন একটি ‘পরীক্ষা হলের’ দৃশ্য আমাদের সামনে তুলে ধরার জন্য সুমনকে ধন্যবাদ না দিলে তাঁর প্রতি অবিচারই করা হবে।
সুমনের এই ফেসবুক লাইভ শুধু আমাদের জানা–বোঝার পরিধিই বাড়ায়নি। আমাদের বিনোদনও দিয়েছে। সুমনের কথা বলার ঢং, হাসিমাখা মুখ ও সেন্স অব হিউমার তারিফ করার মতো। যাঁরা এই ফেসবুক লাইভ দেখেছেন, তাঁরা কি সুমনের রসবোধকে অস্বীকার করতে পারবেন!
সুমনের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার পাশাপাশি তাঁর প্রতি আমাদের সমবেদনাও থাকল। এই ফেসবুক লাইভের পর তিনি তাঁর পদ হারিয়েছেন। অথচ সেখানে ‘আমার প্রাণের সংগঠন কালীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন’ জানিয়েছিলেন তিনি। শুধু সুমন বাদ পড়েননি, পুরো কমিটিই বাতিল করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এই বাতিলের সঙ্গে অবশ্য ‘ফেসবুক লাইভের’ কোনো সম্পর্ক নেই। কমিটি বাতিলের কারণ হিসেবে ‘মেয়াদ উত্তীর্ণের’ কথা বলা হয়েছে। তবে কৌতূহলী মনে প্রশ্ন জাগে, ফেসবুক লাইভের এই কাণ্ড না ঘটলে ‘মেয়াদ উত্তীর্ণ’ এই কমিটির ‘মেয়াদ’ কি এত দ্রুতই শেষ হতো?
যে ফেসবুক লাইভ আমাদের আলোকিত করল, বিনোদন দিল, তার জন্য হয়তো সুমনকে আরও ত্যাগস্বীকার করতে হবে। পরীক্ষায় যে এ প্লাস পাওয়া তাঁর প্রায় নিশ্চিত ছিল, তা থেকেও বঞ্চিত হতে পারেন তিনি। বেচারা সুমনের জন্য আরও একদফা আগাম সমবেদনা।
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক
akmzakaria@gmail.com