সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে ফেসবুক কি নিরপেক্ষ অবস্থান হারাচ্ছে? গণমানুষের যোগাযোগের মাধ্যম থেকে ফেসবুক কি রাষ্ট্রের আজ্ঞাবহ মাধ্যমে পরিণত হচ্ছে? সাধারণ ফেসবুকারদের রক্ষার পরিবর্তে ফেসবুকের বিরুদ্ধে গণহত্যায় উনকানি দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। ফেসবুকের স্ববিরোধিতা নিয়ে বিস্তর কথা হচ্ছে দুনিয়াজুড়ে। একদিকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা চলাকালে বিভিন্ন উসকানিমূলক লেখা ও ছবি ফেসবুকে অব্যাহতভাবে প্রচারিত হয়েছে। ফেসবুক এসব নিয়ে খুব বেশি তৎপরতা দেখায়নি। আবার ফিলিস্তিনিরা যখন ইসরায়েলের নৃশংসতা, হামলার ছবি বা তথ্য প্রচার করছে, ফেসবুক তা মুছে দিচ্ছে। কয়েক বছর ধরে ফিলিস্তিনের বিভিন্ন সংগঠন, ব্যক্তি ফেসবুক থেকে একই ধরনের বার্তা পাচ্ছে। বার্তাগুলো হচ্ছে লেখা মুছে দেওয়ার, অ্যাকাউন্ট স্থগিত বা বাতিল করে দেওয়ার। বিভিন্ন সংগঠনের পেজও বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। সব ক্ষেত্রেই ফেসবুকের নীতিমালা ভঙ্গের কারণ দেখানো হচ্ছে। ফেসবুকের এ ধরনের একপেশে আচরণ নিয়ে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে। এসব ঘটনায় কখন, কোথায়, কোন ঘটনায় ফেসবুকের নীতিমালা ভঙ্গ হচ্ছে, তা বোঝা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন।
ফিলিস্তিনিদের অভিযোগ, মূলত ইসরায়েলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কোনো কিছু লেখা হলেই ফেসবুক থেকে তা উধাও হয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের দখল অবসানের জন্য বড় বড় জমায়েতের আয়োজন করছে। তারা এর নাম দিয়েছে তৃতীয় ইন্তিফাদা বা তৃতীয় গণ–অভ্যুত্থান। এই তৃতীয় ইন্তিফাদায় ফিলিস্তিনিরা নিজেদের দখল হয়ে যাওয়া ঘরে ফিরতে চায়। যাকে বলা হচ্ছে মহাপ্রত্যাবর্তন। ফিলিস্তিনিরা হারিয়ে যাওয়া বাড়ির বাগানে স্প্যানিশ ম্যারিগোল্ডের সুবাস নিতে চায়। জলপাইয়ের পাতা হাতে নিয়ে শান্তির শপথ নিতে চায়। তবে ফিলিস্তিনিদের এই মহাপ্রত্যাবর্তনের পথে বাধা ইসরায়েল সীমান্তে ওত পেতে থাকা স্নাইপাররা।
জন্মভূমি বেহাত হয়ে যাওয়ার পর থেকেই ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন ময়দানে লড়ছে জন্মভূমি ফিরে পাওয়ার জন্য। এর বাইরেও সম্প্রতি নতুন এক ময়দানে তাদের লড়তে হচ্ছে। এ লড়াই ফেসবুকের সঙ্গে। নিজেদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট, পেজ টিকিয়ে রাখার লড়াই। ধরা যাক, ফিলিস্তিনিরা গাজা সীমান্তে বিক্ষোভের ডাক দিয়ে একটি ইভেন্ট পেজ খুলল। সেখানে ফিলিস্তিনিরা সাড়া দিতেই সেই ইভেন্ট পেজ গায়েব। আয়োজকদের নতুন করে আবার শুরু করতে হচ্ছে। এতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। জনমতের পথে নানা বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন আরব দেশ থেকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে লেখা মন্তব্যও মুছে যাচ্ছে। অনেক সময় সুনির্দিষ্ট কোনো কারণও দেখানো হয় না। ভুয়া ছবি ও তথ্য প্রচারের বিষয় এটা নয়। ধরা যাক, ফিলিস্তিনিদের ধরে পেটাচ্ছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী, এ রকম কোনো প্রকৃত ছবি দেওয়া হলো। কিছুক্ষণ পরই সেই ছবি উধাও। মিডল ইস্ট মনিটরে লেখা হয়েছে, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে একধরনের কারফিউ জারি করেছে ফেসবুক।
আরবের বিভিন্ন পত্রিকা ও ব্লগ থেকে জানা যাচ্ছে, বিশেষ বিশেষ কিছু শব্দে ফেসবুকের চরম আপত্তি রয়েছে। যেমন ইসরায়েলকে বর্ণবাদী বা দখলদার রাষ্ট্র বলা যাবে না। ইন্তিফাদা শব্দেও তাদের আপত্তি। ফিলিস্তিনিদের অভিযোগ ইসরায়েলের বিভিন্ন সংস্থা তাদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছে ফেসবুকে। এটা করতেই পারে। যেকোনো রাষ্ট্রই এটা করে থাকে। প্রতিপক্ষের ওপর নজরদারি করা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু বিপত্তি বাধে তখনই, যখন নজরদারির এই কাজটা করে তথাকথিত নিরপেক্ষ মাধ্যম ফেসবুক। এভাবে ফেসবুকের মাধ্যমে যৌক্তিক আন্দোলনকে আটকে দেওয়া হয়। ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে তাই করা হচ্ছে। তাদের বিভিন্ন বার্তা প্রদানকারী লেখাকে ‘গণঅভিযোগ’ (ম্যাস রিপোর্টিং) করে মুছে দিতে বলা হচ্ছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে। কখনো বা সরাসরিই ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে জানাচ্ছে ইসরায়েল সরকার। ইসরায়েল চায় না ফিলিস্তিনিদের কোনো সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্র গড়ে উঠুক। আর সেই মোতাবেক কাজ করছে ফেসবুক। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের সন্ত্রাসী বা জঙ্গি হিসেবে প্রচারকারী ইসরায়েলের প্রপাগান্ডা কিন্তু মুছে দেওয়া হচ্ছে না।
যেকোনো আন্দোলনে ‘রিসোর্স মবিলাইজেশন’ প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ন ধাপ। রিসোর্স মোবিলাইজেশন বলতে অনেক কিছুই বোঝায়। এর মধ্যে থাকে জনমত গঠন ও সংগঠিত করা প্রথম ধাপ। এরপরই সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো দানা বেঁধে ওঠে ও পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। সম্প্রতি জনমত সংগঠনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক হয়ে উঠেছিল সহজ ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সমাজিক যোগাযোগমাধ্যম কয়েক বছরের গণ–আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। নারীদের মিটু আন্দোলন কিংবা অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট এবং বিশেষ করে আরব বসন্ত গড়েই উঠেছিল ফেসবুককে কেন্দ্র করে। কিন্তু এই আরব বসন্তেই যখন ফিলিস্তিনের যুবারা ইসরায়েলের অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে সরব হলেন, তখই বাধে বিপত্তি। ফেসবুক থেকে বাধার সম্মুখীন হলেন, যা এখনো অব্যাহত আছে।
শুধু ইসরায়েল নয় বিভিন্ন দেশেই সরকারপক্ষের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। যখন–তখন বিভিন্ন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর, লেখক, সমালোচকদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের তথ্য তুলে দিচ্ছে তৃতীয় পক্ষের হাতে। রাষ্ট্রগুলো অভিযোগ করছে, এসব লেখক, সমালোচকেরা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করছেন। গুজব রটনা করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। গুজবের অভিযোগও সত্য। কিন্তু গুজব কোন সমাজে বেশি ছড়ায়? যেখানে গণমাধ্যমে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। গণমাধ্যমের বড় একটি অংশ তোষামোদে ব্যস্ত থাকে। বাক্স্বাধীনতা থাকে না। সমাজে ভয় বিরাজ করে। গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরা হয়। ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিস্তার ঘটানো হয়। একধরনের গুমোট, অস্বাভাবিক পরিবেশ বিরাজ করে। সেখানেই গুজবের ডালপালার বিস্তার ঘটে।
ফেসবুক কখনোই অপপ্রচার, গুজবের ক্ষেত্র হতে পারে না। তবে ফেসবুক দ্বিচারীও হতে পারে না, ফ্যাসিবাদ ও বর্ণবাদের সহগামী হতে পারে না। ফেসবুকের আচরণে স্বরিবোধ স্পষ্ট। নিরপেক্ষ অবস্থানে না থেকে ফেসবুক দখলদার, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের কায়েমি স্বার্থ বাস্তবায়নের হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে। ফেসবুক অবশ্যই গুজব রোধ করবে। কিন্তু ফেসবুক গণতান্ত্রিক অধিকারের আন্দোলন, নিজ ভূমি ফিরে পাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। কোনো জাতি বা গোষ্ঠী ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে কারফিউ জারি করতে পারে না ফেসবুক।
ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন