ফি বছর রাজস্ব কেন কমে?

১০ ভাগ অবদানে সক্ষম রাজস্ব খাত কেন আজও সরাসরি একজন স্বতন্ত্র মন্ত্রীর নেতৃত্ব পায় না, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ
ছবি: প্রথম আলো

করোনা মহামারি এবং ইহকাল-পরকালের মধ্যে টানাটানির কারণে গত দুই বছর সরকারের বার্ষিক বাজেট নিয়ে মানুষের তেমন মনোযোগ ছিল না। অর্থনীতিবিদেরাও এটা বুঝে চুপচাপ ছিলেন। এবারের বাজেটে তাই, ‘না জানি কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।’ উভয় সারির রাজনীতিকেরা তাঁদের স্মৃতিনির্ভর মন্তব্য ছেড়ে দিয়েছেন—ফরাসি ভাষায় যাকে বলে ‘দেই জা ভুঁ’ বা হারানো দিনের অনুভূতি ফিরে এল।

তবে অর্থ মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ দিতে হয় দুটো কারণে। গত দুই বছর ব্যাট নিয়ে ক্রিকেটের ক্রিসে টিকে থাকা এবং জৈবনিক বন্দীদশার পর মোটামুটি একটা শক্ত বাজেট দেওয়া। সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যাখ্যায় যথেষ্ট দুর্বলতা থাকলেও উন্নয়নমুখী একটা মনোযোগ এই বাজেট সৃষ্টি করতে পেরেছে। একটা ঘুরে দাঁড়ানোর বার্তা সেখানে আছে, যদিও অস্বাভাবিক বচনবাহুল্য সেই আত্মবিশ্বাসের শরবতে মাঝেমধ্যেই পানি ঢেলে দিয়েছে। ১৬৭ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতা একটা বিশ্বরেকর্ড বটে। ভারত বা পাকিস্তানের বাজেট বক্তৃতা এর চার ভাগের এক ভাগও নয়। উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেনে এত লম্বা ভাষণ দিলে কেউ হয়তো মামলা করে দেবে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বাজেট ভাষণ দুই পাতার।

সাধারণ মানুষের কাছে বাজেটের বড় অঙ্কগুলো নিরর্থক। তার চেয়ে এর আনুপাতিক সংখ্যা অনেক আকর্ষণীয়। সরকার আগে ব্যয়গুলো ঠিক করে বাজেট বানায়। তারপর দেখে নেয় তার নিজস্ব কর, খাজনা ও রাজস্ব আয় এই বাজেটের কত অংশ মেটাতে পারে। বাকিটা ঘাটতি। ধারদেনা করে এটা পূরণ করতে হয়। অনেকটা কন্যাদায়গ্রস্ত বাবার দ্বারা মেয়ের বিয়েতে খরচ করার মতো ঘটনা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ এ দুটোই। রাজস্ব ক্ষমতা বাড়ানো, যাতে ঘাটতি কম থাকে। দ্বিতীয়ত, ঘাটতিকে বিচক্ষণতার সঙ্গে কম সুদের ধারদেনা করে মোচন করা। সুদের কম খরচ দেখার পাশাপাশি আরও দেখতে হয় যেন সরকারি ধারদেনার কাজটি যেন অন্য ব্যক্তি ঋণগ্রহীতাদের পথের কাঁটা না হয়ে দাঁড়ায়। মোড়ল যদি গ্রাম্য দোকানদারের কাছ থেকে বেশি ঋণ নিয়ে নেয়, তাহলে ওই সুদখোর দোকানি একই গ্রামের অন্য চাষিদের আর ঋণ দিতে পারে না, বা দিলেও অনেক কম দিতে পারবে। তাতে গ্রামের কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অর্থনীতির পরিভাষায় এই ক্রাউডিং আউট বা খেদিয়ে দেওয়ার রোগ এ বাজেটেও কমছে না; বরং আয় দুর্বলতার কারণে তা বাড়তে পারে।

উন্নয়ন খাতের বাজেটের ৩৮ ভাগ সংরক্ষণ করা বাজেটের একটা ভালো দিক। উন্নয়ন বাজেটে খরচ করা মানে ভবিষ্যৎ জাতীয় আয় বা জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে সহায়তা দেওয়া

প্রায় পৌনে সাত লাখ কোটি টাকার (৬,৭৮,০৬৪ কোটি টাকা) এ বাজেটকে সরাসরি ১০০ টাকার একটা খরচ হিসাব ধরে যদি বিশ্লেষণ শুরু করি, তাহলে বাজেটের বাকি আনুপাতিক হিসাব-নিকাশ ও সক্ষমতা বা দুর্বলতা বুঝতে সুবিধা হবে। এই ১০০ টাকার খরচ হিসাবের মধ্যে সরকারের আয় বা রাজস্ব জোগান মাত্র ৬৪ টাকা। অবশিষ্ট ৩৬ টাকা মেটানো হবে মূলত ধারদেনা করে। বিদেশি ঋণ নেওয়া হবে ১৪ টাকার, ১৬ টাকা নেওয়া হবে ব্যাংক থেকে, আর বাকি ৬ টাকা সঞ্চয়পত্র বেচে—এই সর্বমোট ৩৬ টাকার সংস্থান করা হবে।

আয়ের ৬৪ টাকার মধ্যে ৫৭ দেবে কর আর বাকি সাড়ে ৬ টাকার মতো দেবে করবহির্ভূত আয়। অবশিষ্ট `এক ফোঁটা দিলেম শিশির' অর্থাৎ বিদেশি অনুদান মাত্র আট আনা বলে একে আর কোথাও উল্লেখ করার তাগাদা পেলাম না। এবার ব্যয়ের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এই ১০০ টাকার মধ্যে ৬২ টাকা যাবে সরকারের চলতি ব্যয় নির্বাহ করতে। এখানে বার্ষিক চলমান খরচে থাকছে বেতন, ভাতা, সুদ, ভর্তুকি ইত্যাদি। বাকি ৩৮ টাকা ব্যয় করা হবে রাস্তাঘাট, সেতু, দালানকোঠা নির্মাণ তথা সার্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে। এভাবেই ১০০ টাকার বাজেটের হিসাব পূর্ণ হলো।

উন্নয়ন খাতের বাজেটের ৩৮ ভাগ সংরক্ষণ করা বাজেটের একটা ভালো দিক। উন্নয়ন বাজেটে খরচ করা মানে ভবিষ্যৎ জাতীয় আয় বা জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে সহায়তা দেওয়া। পদ্মা সেতু নির্মিত হলে তা জাতীয় আয়ের বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে। ঠিক ১০ বছর আগের বাজেটে (২০১২-২০১৩) মাত্র ৩০ ভাগ দেওয়া হয়েছিল উন্নয়ন খাতে। পাঁচ বছর আগে (২০১৬-২০১৭) তা একটু বেড়ে হয় ৩৪ ভাগ। এখন ৩৮ ভাগ। একটি উন্নত দেশের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে হলে এ সংখ্যাকে যথাসম্ভব দ্রুত ৫০ ভাগে উন্নীত করা প্রয়োজন।

উন্নয়নে বাজেটের নজর প্রবণতা রেখার বিচারে প্রশংসনীয় হলেও এর রাজস্ব সক্ষমতার ক্রমাবনতি অর্থনীতিকে শনির দশায় ফেলতে পারে। দশ বছর আগে এ রকম ১০০ টাকার বাজেটের ৭৪ টাকা দিতো সরকারের আয়। পাঁচ বছর আগে তা নেমে হয় ৭১ টাকা। আজ এটি আরও নেমে ৬৪ টাকায় ঠেকেছে। হওয়ার কথা ছিল ঠিক উল্টো। রাজস্ব সক্ষমতার এই আনুপাতিক ক্রমাবনতির মূল কারণ ধনিক বণিকের তুষ্টিসাধন। তারা নানা চাতুরী করে কর ফাঁকি দেন। একেবারে ন্যূনতম বা ন্যায্য কর দিতেও তারা পছন্দ করেন না। রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশয়েরও অভাব নেই তাদের। তাই রাজস্ববৃদ্ধি শম্বুকগতিরও অধম।

প্রতিবার বাজেটে রাজস্ব আদায়ের মোট অঙ্ক অবশ্যই বাড়ে। তা তো হবেই। কিন্তু ঢাকা পড়ে যায় এর আনুপাতিক দুর্বলতার প্রবণতা রেখা। এ থেকে মুক্তির উপায় রাজনৈতিক দৃঢ়তা, প্রযুক্তির স্বচ্ছতা, প্রশাসনিক সংস্কার ও বিচারিক দ্রুতির মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিতকরণ। এ ছাড়া রাজস্ব ব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে আলাদা একটা রাজস্ব মন্ত্রণালয় গঠন করা খুবই জরুরি। পৃথিবীতে এ রকম বহু উদাহরণ রয়েছে। কানাডাতে রাজস্ব আদায়ের আলাদা মন্ত্রী রয়েছেন। তিনি অর্থমন্ত্রী নন। করের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার জন্য পাকিস্তানে বাজেট ঘোষক মন্ত্রীর নাম অর্থ ও রাজস্বমন্ত্রী।

নিউজিল্যান্ডে রয়েছে ফাইন্যান্স ও রেভিনিউয়ের জন্য দুটো আলাদা মন্ত্রণালয়, আলাদা মন্ত্রী। ছোট্ট দেশ টোঙ্গা ও স্যামোয়াতেও রয়েছে আবগারি ও রাজস্বের আলাদা মন্ত্রণালয়। ভারতের বেশ কটি রাজ্য তাদের সুবিধামতো রাজস্বমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করে নিয়েছে। দুর্বলতা দূরীকরণ ও অর্থনীতির দূরদর্শিতার স্বার্থে চীন নতুন নতুন মন্ত্রক গড়েছে।

অর্থমন্ত্রীদের ঘাড়ে সর্বব্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বা ক্ষমতা অর্পণ অর্থনীতির সক্ষমতার জন্য আত্মঘাতী। সরকার দ্রুত আলাদা রাজস্ব মন্ত্রণালয় গঠন করে কর-আয় হারকে ১০ থেকে ২০ ভাগে উন্নীত করুক, এটাই প্রার্থিত। প্রয়োজন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ।

এ দেশে রাজস্ব আদায়ের বিষয় একজন পদস্থ আমলা দিয়ে চালানো হচ্ছে। যত চৌকসই তিনি হন না কেন, একজন গণপ্রতিনিধির মতো তিনি কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে পারেন না। ফলে জিডিপিতে রাজস্ব খাতের আনুপাতিক ভাগ দিন দিন ক্ষীয়মাণ। এককালে এটি ছিল জাতীয় আয়ের ১৩ ভাগ। এখন তা সাড়ে ৯ ভাগ, যা প্রতিবেশীদের অঞ্চলে তো বটেই, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মাপেও এ সংখ্যা নিম্নতম ধাপের বাসিন্দা।

জিডিপিতে মাত্র ২ থেকে ৫ ভাগ অবদান রেখেও অনেক খাত আলাদা মন্ত্রণালয়ের পদোন্নতি পেয়েছে। অথচ ১০ ভাগ অবদানে সক্ষম রাজস্ব খাত কেন আজও সরাসরি একজন স্বতন্ত্র মন্ত্রীর নেতৃত্ব পায় না, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। অর্থমন্ত্রীদের ঘাড়ে সর্বব্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বা ক্ষমতা অর্পণ অর্থনীতির সক্ষমতার জন্য আত্মঘাতী। সরকার দ্রুত আলাদা রাজস্ব মন্ত্রণালয় গঠন করে কর-আয় হারকে ১০ থেকে ২০ ভাগে উন্নীত করুক, এটাই প্রার্থিত। প্রয়োজন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ।

বাজেটে ৭ দশমিক ৫ ভাগ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন একটা করোনা-উত্তর অর্থনীতির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হলেও ৫ দশমিক ৬ ভাগ মূল্যস্ফীতির অনুমান স্বপ্নমঙ্গলের মতোই মনোরম। বিবিএস প্রদত্ত মূল্যস্ফীতির সংখ্যাগুলো নিয়ে সন্দেহ রোগ এখন সর্বব্যাপ্ত। কারণ, বাজারে দামের তাপ-তাণ্ডব বড়ই প্রবল। পুতিন-তাড়িত মূল্যস্ফীতি বিশ্বের কাউকেই ছাড় দেবে না। যুদ্ধে পুতিনের রাজস্ব বাড়ছে। তাই ক্ষান্ত দেওয়ার কারণ নেই। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের রাজস্ব কিছুটা বাড়লেও টাকার ক্ষমতা কমবে, প্রকল্প খরচ বাড়বে, বেতন-ভাতা বৃদ্ধির চাপ আসবে। ক্ষতির শিকার হবে উন্নয়ন বাজেট, বাঁধা আয়ের মানুষ ও শ্রমজীবী জনতা। গরিবকে সরাসরি খাদ্যদ্রব্য সহায়তা প্রদান ও দ্রুত কর্মসংস্থান বাড়ালে মূল্যস্ফীতিজনিত তাপের আংশিক নিরাময় সম্ভব।

বিরূপাক্ষ পাল, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ।