অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে ফিলিস্তিনি মুসল্লিদের ওপর আরেকটি রমজানে হামলা হলো। ইসরায়েলের এই হামলার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বেশির ভাগ ইউরো-আমেরিকান রাজনীতিবিদ, মিডিয়া বিশ্লেষক এবং ভাষ্যকার এটিকে তিনটি প্রধান ধর্মীয় অনুভূতির সংমিশ্রণে উদ্ভূত ‘উত্তেজনা’ হিসেবে দেখাচ্ছেন। ইসরায়েলের চারটি শহরে ‘ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসী হামলার’ প্রতিক্রিয়া হিসাবে এই হামলাকে ন্যায্যতা দেওয়া হচ্ছে। ফিলিস্তিনিরা এই ধরনের অযৌক্তিক ব্যাখ্যা শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
কয়েক শতাব্দী ধরে যে ফিলিস্তিনি জনগণ এখানে বসবাস করে আসছে এবং যারা নিজেদের অস্তিত্বের অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে, সেই ফিলিস্তিনিদের দখলদার ইসরায়েল এবং তার ইউরো-আমেরিকান মিত্ররা ‘ক্রমাগত সহিংসতার চক্র সৃষ্টি করা হিংস্র, ঘৃণ্য, আবেগপ্রবণ, অযৌক্তিক এবং পিছিয়ে পড়া মানুষ’ হিসাবে চিহ্নিত করছে।
জায়ানিজম বা ইহুদিবাদ মূলত ইউরোপীয় ইহুদি বিদ্বেষের ভয়াবহতা থেকে ইউরোপের ইহুদিদের রক্ষা করার আকাঙ্ক্ষা দ্বারা চালিত হয়েছিল। কিন্তু যখনই তাঁরা ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন শুরু করে তখন থেকেই তাঁরা বসতি স্থাপনকারী-ঔপনিবেশিক সহিংসতার অনুশীলন শুরু করে। ইসরায়েলি সহিংসতার প্রধান লক্ষ্য ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের সমগ্র ভূমিতে সর্বোচ্চ আগ্রাসন নিশ্চিত করা; কারণ ইসরায়েলের জন্য এখনো এই ভূমি নিশ্চিতভাবে সুরক্ষিত হয়নি। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ এখনো তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ইসরায়েল যে কারণে এই সর্বশেষ আক্রমণটি শুরু করেছে, সেই একই কারণে তারা এর আগে অনেকগুলো আক্রমণ করেছে এবং তাদের আসন্ন আক্রমণগুলোর পেছনেও থাকবে সেই একই কারণ। কারণটি হলো: ইসরায়েল রাষ্ট্রটি বসতি স্থাপনকারী ঔপনিবেশিক সার্বভৌমত্বের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ফিলিস্তিনের ওপর তাদের আধিপত্যকে তাদের ক্রমাগত জানান দিয়ে যেতে হবে।
ইসরায়েলি রাষ্ট্র যে ঔপনিবেশিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে, সেখানে যে রাজনৈতিক দল বা জোট ক্ষমতায় থাকুক না কেন এই রাষ্ট্রটি ক্রমাগত তার ক্রিয়াকলাপ চালিয়ে যাবে। এই রাষ্ট্রের মৌলিক ধারণাটি হলো, ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি-রাষ্ট্র হিসাবে ইসরায়েলকে অবশ্যই ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ভূমির ওপর সর্বোচ্চ সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণ সুরক্ষিত করতে হবে এবং ইহুদি বসতি সম্প্রসারিত করতে হবে। এই নীতি বাস্তবায়নই ইসরায়েলি সহিংসতার প্রধান কারণ ও লক্ষ্য।
জায়ানিজম বা ইহুদিবাদ মূলত ইউরোপীয় ইহুদি বিদ্বেষের ভয়াবহতা থেকে ইউরোপের ইহুদিদের রক্ষা করার আকাঙ্ক্ষা দ্বারা চালিত হয়েছিল। কিন্তু যখনই তাঁরা ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন শুরু করে তখন থেকেই তাঁরা বসতি স্থাপনকারী-ঔপনিবেশিক সহিংসতার অনুশীলন শুরু করে। ইসরায়েলি সহিংসতার প্রধান লক্ষ্য ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের সমগ্র ভূমিতে সর্বোচ্চ আগ্রাসন নিশ্চিত করা; কারণ ইসরায়েলের জন্য এখনো এই ভূমি নিশ্চিতভাবে সুরক্ষিত হয়নি। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ এখনো তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ইসরায়েলি পুলিশ, সেনা, বসতি স্থাপনকারী বা রাজনীতিবিদেরা ‘দাঙ্গা দমন করতে’, ‘আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে’, ‘ইসরায়েলি বেসামরিকদের রক্ষা করতে’ এই সহিংসতাকে ন্যায্যতা দিচ্ছেন। কিন্তু এই সব লক্ষ্য অর্জনের জন্য মসজিদের ছবি তুলতে থাকা একজন নারীকে লাঠিপেটা করার, একজন অতি বৃদ্ধকে গরু ছাগলের মতো লাথি মেরে ফেলে দেওয়ার, ছোট ছোট বাচ্চাদের ভয়ংকর সন্ত্রাসীদের মতো করে গ্রেপ্তার করার, আল আকসা মসজিদের প্রাচীন জানালা ভেঙে ফেলার, মসজিদের ভেতরে ঢুকে নামাজ আদায়রত মুসল্লিদের ওপর টিয়ার গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ার, ১৫৮ জন গুরুতর আহত হওয়ার পরও সেখানে অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে না দেওয়ার, ইসরায়েলি সেনাদের তৎপরতার ছবি তুলতে থাকা সাংবাদিকদের পেটানোর, সাড়ে চার শ জনের বেশি ফিলিস্তিনিকে গ্রেপ্তার করে জেলে পোরার কোনো দরকার ছিল না।
নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা বা স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য এই ধরনের সহিংসতা চালানোর কথা না। কিন্তু তারা পরিকল্পিতভাবে এটি করে থাকে। মূলত তারা ফিলিস্তিন এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর সর্বোচ্চ ইসরায়েলি খবরদারি জাহির করার জন্য এটি করে থাকে। ইসরায়েল সহিংসতার মধ্য দিয়ে যে বার্তাটি দিয়ে থাকে তা হলো: ফিলিস্তিনিদের জীবন ও মৃত্যুর বিষয়ে ইসরায়েলের রায়ই চূড়ান্ত; এসবের জন্য ইসরায়েলিদের জন্য কোনো গুরুতর পরিণতি বরণ করতে হবে না এবং ইসরায়েল হঠকারিতার মধ্য দিয়েও যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে তা উল্টে দেওয়ার বা তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোনো বাস্তব উপায় ফিলিস্তিনিদের সামনে খোলা নেই।
এখন আল আকসা মসজিদে যে ঘটনা ঘটছে, প্রায় এক বছর আগে ঠিক একই ধরনের একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় ধ্বংসাত্মক সামরিক আক্রমণ শুরু করেছিল। সে সময় তারা ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত করেছিল এবং মসজিদগুলোতে ঢুকে তাণ্ডব চালিয়েছিল।
গত বছরের ১০ মে থেকে ২১ মে পর্যন্ত ইসরায়েলের হামলায় ৬৬ জন শিশুসহ ২৫৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল। ছয় শ শিশু ও চার শ নারীসহ দুই হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি আহত হয়েছিল। সে হামলায় অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি ছিল গুরুতর। সে সময় ২০০০ ভবন ধ্বংস হয়েছিল। আট লাখ মানুষ পানি সরবরাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল।
খেয়াল করলে বোঝা যাবে, এই সহিংসতাগুলো স্পষ্টতই অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ঘোষিত লক্ষ্য ‘ইসরায়েলের নিরাপত্তা’র জন্য প্রয়োজনীয়ও নয়। মূলত ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি ইহুদিবাদের সম্পূর্ণ সার্বভৌম ক্ষমতা যে অটুট আছে তা জানান দিতেই তারা এই অসম হামলা চালিয়েছিল। যখন যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয় তখন ইসরায়েলের চ্যানেল টুয়েলভ এর প্রকাশিত একটি জরিপে দেখা গিয়েছিল ৭২ শতাংশ ইসরায়েলি ভেবেছিল গাজায় বিমান হামলা চালিয়ে যাওয়া উচিত, আর ২৪ শতাংশ বলেছিলেন, ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়া উচিত। সেই অবস্থা থেকে ইসরায়েলিরা এক চুলও নড়েনি।
আল-আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডে সর্বশেষ হামলার সঙ্গে একটি অনুমিত মুসলিম-ইহুদি সংঘর্ষের সামান্যতম কোনো সম্পর্ক নেই। যত দিন পর্যন্ত আল আকসা মসজিদ চত্বরে ফিলিস্তিনি মুসল্লিদের আমরা ইবাদত করতে দেখব এবং যত দিন পর্যন্ত সেখানে তাদের স্বাধীনতার স্বর উচ্চকিত দেখব তত দিন পর্যন্ত আমাদের ফি বছর ফিলিস্তিনি মুসল্লিদের ওপর ইসরায়েলি আক্রমণ সম্পর্কে লিখতে হবে।
ফিলিস্তিনিদের ওপর যতক্ষণ ইসরায়েলি আধিপত্যকে নিরঙ্কুশ বলে ইসরায়েলিদের মনে না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এই হামলা তারা অব্যাহত রাখবে।
আল জাজিরা থেকে নেওয়া। অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
মার্ক মুহান্নাদ আয়াশ কানাডার ক্যালগারির মাউন্ট রয়্যাল ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক।