খোলা চোখে

ফিলিস্তিন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল ভারত

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

ইসরায়েলে বেড়াতে এসে প্রায় নায়কোচিত সংবর্ধনা পেলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে জানি দোস্তের মতো বুকে জড়িয়ে ধরেছেন, তাঁর সঙ্গে সমুদ্রতীরে খালি পায়ে হেঁটে বেড়িয়েছেন, ফিরে এসে ফেসবুকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছেন। ইসরায়েল সফরে আসা তিনিই প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। এত দিন পর্যন্ত ভারত নিজেকে ফিলিস্তিনের একজন অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে পরিচিত করাতেই ভালোবাসত। কিন্তু ইসরায়েল সফরে এসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী চোখ তুলে তাকালে দেখা যায় যে রামাল্লাহ, সেখানে যাওয়ার কোনো চেষ্টাও করেননি তিনি।

মুখে মুখে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আমৃত্যু বন্ধুত্বের কথা বললেও ভারত দীর্ঘদিন থেকেই ইসরায়েলের সঙ্গে নিকট সম্পর্ক নির্মাণ করে এসেছে। আগ্রহটা উভয় পক্ষেরই। তৃতীয় বিশ্বে ইসরায়েলের বন্ধুর সংখ্যা হাতে গোনা। ভারতের মতো দেশকে বন্ধুর তালিকায় নাম লেখানো গেলে তার কৌশলগত লাভ হবে, এই যুক্তিতে ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বেন গুরিয়েন ভারতকে কাছে টানতে কম চেষ্টা করেননি। পণ্ডিত নেহরুর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল, চিঠি চালাচালি ছিল। শোনা যায়, বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনকে দিয়ে পর্যন্ত বেন গুরিয়েন চেষ্টা করেছিলেন দুই দেশকে কাছে আনতে। নেহরুর সময়েই ভারত ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়, যদিও দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে আরও ৪৪ বছর লেগে যায়। ১৯৯২ সালে নরসিমা রাওয়ের সময় এ দুই দেশ তাদের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে, যদিও তলে তলে এই পুরো সময় ধরেই দুই দেশ তাদের সম্পর্ক ঠিকই টিকিয়ে রাখে। এই সম্পর্কের কেন্দ্রে ছিল সামরিক সহযোগিতা।

আগাগোড়া মস্কোই ছিল ভারতের প্রধান সামরিক সরবরাহকারী। এখনো সে ভারতের এক নম্বর অস্ত্র সরবরাহকারী। ঠিক তার পরেই স্থান ইসরায়েলের। প্রথম দিকে মস্কোর কাছ থেকে যে টুটা-ফুটা অস্ত্র ভারতের মিলেছিল, তা দিয়ে চীন ও পাকিস্তানকে ঠেকানো তার জন্য কঠিন হবে—এ কথা ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পর নেহরু বুঝতে পেরেছিলেন। তিনিই উদ্যোগী হয়ে বেন গুরিয়েনকে চিঠি লিখেছিলেন ইসরায়েলি অস্ত্রের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে। বস্তুত, তখন থেকেই এ দুই দেশের সামরিক সহযোগিতার ভিত রচিত হয়। পরবর্তীকালে নিজের সামরিক খাত আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে ভারত ইসরায়েলের কাছ থেকে কৌশলগত অস্ত্র আমদানিতে অধিক মনোযোগী হয়ে ওঠে। কংগ্রেস আমলে শুরু হওয়া এই সহযোগিতা মোদি আমলে ফুলে-ফেঁপে ওঠে। বর্তমানে ইসরায়েল থেকে ভারতের সমরাস্ত্র আমদানির পরিমাণ অর্থের হিসাবে বছরে ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ভারতের বেশি আগ্রহ ইসরায়েলের অত্যাধুনিক সামরিক বিমান হামলা মোকাবিলায় সক্ষম আকাশ সুরক্ষাব্যবস্থা (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম)। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় ইসরায়েলের অভিজ্ঞতা রয়েছে, ভারত সেই কৌশল আয়ত্ত করতেও আগ্রহী।

এত দিন ভারত ইসরায়েলের সঙ্গে তার সম্পর্কের ব্যাপারটা কিছুটা লুকিয়ে-ছাপিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। এখন তার আর প্রয়োজন নেই, কারণ খোদ আরব দেশগুলোই ইসরায়েলের সঙ্গে নিকট বন্ধুত্ব পাতাতে উঠেপড়ে লেগেছে। মুখে যা-ই বলুক, আরবদের মধ্যে এমনিতে খুব একটা আত্মীয়তা কোনোকালেই ছিল না। একমাত্র যে প্রশ্নে তারা নিজেদের মধ্যে ঐক্যবন্ধন নির্মাণ করতে সক্ষম হয়, তা ওই ফিলিস্তিন প্রশ্নে; তা–ও মুখ্যত যার যার দেশের জনগণের অভ্যন্তরীণ চাপের কারণেই। এখন তা–ও ভেঙে পড়েছে।

এই সব দেশের কোনোটিতেই গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই। পাঁচ বছর আগে তথাকথিত ‘আরব বসন্ত’ যে বিপ্লবের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল, তার ফলে এক তিউনিসিয়া ছাড়া অন্য কোনো আরব দেশে গণতন্ত্র আসেনি। ‘বিপ্লব’ থেকে সবক নিয়ে এসব দেশের একনায়ক শাসকেরা গণতন্ত্র বিষয়টা যেকোনো মূল্যে ১০ হাত দূরে রাখার ব্যাপারে এখন দৃঢ় সংকল্প। গণতন্ত্র মানেই তাঁদের রাজত্ব শেষ, অতএব যেভাবে পারো গণতন্ত্র ঠেকাও। এ জন্য যদি ইসরায়েলের সঙ্গে হাত মেলাতে হয়, তাতেও আপত্তি নেই।

সৌদি আরব ও উপসাগরীয় আমির শাহিরা বরাবরই নিজেদের তেলের পয়সায় কেনা অস্ত্রের জোরে তাঁদের বাদশাহি টিকিয়ে রেখেছেন। এক দশক ধরে তেলের দাম কমছে, কমতে কমতে তা এখন তলানিতে ঠেকেছে। এরই মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে আইএস। সুন্নি হলেও আইএস ইসলামি জগতের নেতা হিসেবে সৌদি বাদশাহর নেতৃত্ব স্বীকার করে না, তাদের চূড়ান্ত রাজনৈতিক লক্ষ্য জেদ্দা পর্যন্ত ধাওয়া করা। অন্য বিপদ ইরান। অনেক আগে থেকেই আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলোর কাছে এই শিয়াপ্রধান দেশটি তাদের গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে রয়েছে। ইরানের প্রভাবে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের শিয়া জনগোষ্ঠী বেশ কিছুদিন ধরেই অশান্ত হয়ে উঠেছে। বাহরাইন ও ইয়েমেনে শিয়াদের অংশগ্রহণে সামরিক প্রতিরোধও ছড়িয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যের বাদশাহিতন্ত্রের জন্য প্রধান অগ্রাধিকার হয়ে ওঠে আইএস ও ইরানকে ঠেকানো।

ঠিক এমন একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল ইসরায়েল। ইরান ও আইএস দুটিই ইসরায়েলের শত্রু। সৌদি ও উপসাগরের দেশগুলো হিসাব করে দেখেছে, ইরান ও আইএসকে ঠেকাতে হলে সবচেয়ে ফলপ্রসূ পথ হলো এই ইসরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, তা গোপনে হোক বা প্রকাশ্যে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনের পর সব পক্ষের জন্যই পথটা অধিক প্রশস্ত হয়ে পড়ে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইরানের ব্যাপারে যথেষ্ট নমনীয়—এমন একটা ধারণা ইসরায়েল ও আরবের একনায়কদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। ট্রাম্প ঠিক উল্টো, তিনি সম্ভব হলে আজই ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়েন। অতএব, অভিন্ন শত্রু ইরান ও আইএসের বিরুদ্ধে অনায়াসে এককাট্টা হয়ে গেল আমেরিকা, আরব একনায়কতন্ত্র ও ইসরায়েল।

এই নতুন মেরুকরণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হলো ফিলিস্তিনিদের। মধ্যপ্রাচ্যে তাদের আর বন্ধু রইল না। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের প্রধান চাঁদা প্রদানকারীর ভূমিকা গ্রহণ করেছিল কাতার। আরব একনায়কতন্ত্র সেই কাতারেরও বিরুদ্ধে, কারণ কাতার আল-জাজিরা নামক অপেক্ষাকৃত স্বাধীন একটি স্যাটেলাইট টিভির জন্য অর্থ জোগান দিয়ে থাকে, যার ওপর সৌদি বাদশা অত্যন্ত নাখোশ। ইরানের সঙ্গেও কাতারের মধুর সম্পর্ক। অতএব, সেই কাতারকে একঘরে করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে সৌদি আরব ও তার উপসাগরীয় বন্ধুরা।

আরব দেশগুলোর মতো ভারতও যে ফিলিস্তিনিদের এড়িয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধবে, রামাল্লাহর ফিলিস্তিন প্রশাসনের জন্য তা গভীর বেদনাবহ। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত ইসরায়েলে বেড়াতে এলে এক-আধ ঘণ্টার জন্য পশ্চিম তীর ঘুরে যান। এ বছরের মে মাসে মহা সাড়ম্বরে ট্রাম্প ইসরায়েলে এসেছিলেন, তিনিও সে সময় বেথলেহেমে এসে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে দেখা করে যান। অথচ মোদি সে–মুখো হননি, আব্বাসকে টেলিফোনে দু-চার কথা বলারও প্রয়োজন দেখেননি।

সন্দেহ নেই, আরব দুনিয়ার বিভক্তি ফিলিস্তিন প্রশ্নে ভারতকে পথ বদলাতে সাহায্য করেছে। দেশের ভেতরেও এই পথ পরিবর্তনে সমর্থন রয়েছে। ভারতের অধিকাংশ মানুষের ধারণা, পাকিস্তানকে ঠেকাতে হলে চাই ইসরায়েলি প্রযুক্তি। সে কারণে দু-চারজন বামপন্থী কলাম লেখক ছাড়া মোদির এই সফরে আপত্তির কারণ দেখেননি কেউই। গত তিন দশকে ভারতের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইসরায়েলের সহযোগিতা অস্বাভাবিক রকম বেড়েছে। ফলে পেশাদারি বুদ্ধিজীবীরাও রাজনীতি ও আদর্শের বদলে নগদ পাওনাকেই বেশি গুরুত্ব দেবেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

তবে ভারত-ইসরায়েলের এই প্রকাশ্য বন্ধুত্ব ফিলিস্তিনিদের জন্য পুরোপুরি দুঃসংবাদ না-ও হতে পারে। ভারতসহ অধিকাংশ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে, বিশেষ করে আরব বিশ্বে, ফিলিস্তিন প্রশ্নে এখনো প্রবল জনসমর্থন রয়েছে। ইসরায়েল যদি ফিলিস্তিনে নতুন করে হামলা চালায় অথবা বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, তার ফলে এসব দেশে রাজনৈতিক অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। অনুমান করি, সেই বিবেচনা থেকে ইসরায়েল ভারত অথবা নতুন বন্ধু সৌদি আরবের জন্য অস্বস্তিকর এমন কিছুই করবে না। নেতানিয়াহু তেমন কিছু করলে মোদি তাঁর নতুন দোস্তের ওপর চাপ প্রয়োগ করবেন, এমন আশাও একদম অযৌক্তিক নয়। এর ফলে যদি মধ্যপ্রাচ্য শান্তির প্রশ্নে অর্থপূর্ণ আলোচনার সুযোগের সৃষ্টি হয়, ঘন আঁধারে সেটি হবে আলোর সামান্য দ্যুতি।

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি