মতামত

ফাঁদে পড়া ইউক্রেন ও ছোট রাষ্ট্রের বিপদ-আপদ

ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর হামলা
ছবি: এএফপি

দুজন ভ্লাদিমিরের মধ্যে লড়াই শুরু হয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির (রুশ উচ্চারণে ভ্লাদিমির) জেলেনস্কি। কিন্তু প্রাণ যাচ্ছে সাধারণের। ন্যাটো বনাম রাশিয়া মুখোমুখি, মাঝখানে পিষ্ট হচ্ছে দুর্বল রাষ্ট্রের স্বাধীনতা। মার্কিন বিশ্বব্যবস্থায় চীন-রাশিয়া নিজেদের হিস্যা চায় বটে কিন্তু সেটা ছোট দেশগুলোকে ভাগ-বাঁটোয়ারা করার মাধ্যমে। ‘তৃতীয় দুনিয়া’র দর্শক থাকারও উপায় নেই, খেসারতের ভাগ দিতে হচ্ছে তাদেরই।

পুতিন সাবেক গোয়েন্দা আর জেলেনস্কি সাবেক সেলিব্রিটি কৌতুকাভিনেতা। এখানে কে ভালো কে খারাপ, সেই মানসাঙ্ক কষে কী লাভ? আসল বিষয় তো ছোট রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। রাশিয়ার ভয়ে ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিতে চেয়েছে, দেশের ন্যাটোকরণ চালিয়েছে। ন্যাটোর ভয়ে রাশিয়া ইউক্রেনকে নিরস্ত্র করতে যুদ্ধে নেমেছে। উভয়ের নিরাপত্তাভীতিই বাস্তব। কিন্তু যুদ্ধ বা আগ্রাসন কখনো বাস্তব নীতি হতে পারে না। তাই যুক্তরাষ্ট্র যখন সার্বিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়ায় হামলা চালায়; তখন আমরা মার্কিন যুক্তির চেয়ে বড় করে দেখি ওই সব আক্রান্ত দেশের মানুষের মৃত্যু, অর্থনীতির ধ্বংস এবং সার্বভৌমত্বের পতন। এসব দেখে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক রাষ্ট্রগুলো বিপন্ন বোধ করবে না? মানবতা বলে কিছু থেকে থাকলে, তা আহত হবে না? হবে। তেমনিভাবে ইউক্রেনের বিপক্ষে রুশদের যত যুক্তিই থাকুক, আগ্রাসন কখনো সমর্থন পেতে পারে না।

বড় রাষ্ট্রের ছোট প্রতিবেশীদের জন্য ইউক্রেনে রুশ হামলা অশনিসংকেত। রাশিয়া সফল হলে তাইওয়ান দখলে চীন উৎসাহিত হবে এবং পূর্ব ইউরোপের গ্রিনরুমে চীনই হলো সেই বিরাট হাতি, যাকে খেয়াল করা দরকার। রাশিয়াকে ন্যাটো দিয়ে ঘিরে ফেলার জন্য সেসব দেশকে শিখণ্ডী বানানো, যারা কিনা একদা সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিবারের সদস্য ছিল; বটেই তা একটা চক্রান্ত। ইউক্রেন কি ন্যাটোর মানবঢাল?

রাশিয়া বারবার বলে যাচ্ছিল, ন্যাটো তুমি দূরে থাকো, ’৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসানের সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতি মনে রাখো। পুতিন ঠিকই বলছেন, ১৯৯১ সালে শান্তিপূর্ণভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির সময় পশ্চিমারা কথা দিয়েছিল, ন্যাটোকে পূর্ব ইউরোপে নিয়ে গিয়ে রাশিয়াকে বিপদে ফেলা হবে না। এমনকি মিনস্ক চুক্তির (২০১৪) শর্তও মানেনি ইউক্রেন। রাশিয়া যেমন ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে মিলিশিয়া পাঠিয়েছে, ইউক্রেনও তেমনি নাৎসিপন্থীদের দিয়ে বাহিনী গঠন করে দনবাসে গণহত্যা চালিয়েছে বলে রাশিয়ার অভিযোগ।

বড় রাষ্ট্রের ছোট প্রতিবেশীদের জন্য ইউক্রেনে রুশ হামলা অশনিসংকেত। রাশিয়া সফল হলে তাইওয়ান দখলে চীন উৎসাহিত হবে এবং পূর্ব ইউরোপের গ্রিনরুমে চীনই হলো সেই বিরাট হাতি, যাকে খেয়াল করা দরকার। রাশিয়াকে ন্যাটো দিয়ে ঘিরে ফেলার জন্য সেসব দেশকে শিখণ্ডী বানানো, যারা কিনা একদা সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিবারের সদস্য ছিল; বটেই তা একটা চক্রান্ত। ইউক্রেন কি ন্যাটোর মানবঢাল?

রাশিয়ার হাতে যুক্তি রয়েছে ঠিক, কিন্তু ছোট রাষ্ট্রকে অসম যুদ্ধে ঠেলে দেওয়া তো অনৈতিক। এই অনৈতিক কাজ যুক্তরাষ্ট্রও করেছে, আগ্রাসনের মাধ্যমে রাশিয়াও করল। পশ্চিমারা শোনেনি। রাশিয়াও ধৈর্য ধরেনি। মাঝখান থেকে লাভ হলো চীনের। পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে রাশিয়া এখন ডলারের বদলে অন্য কোনো মুদ্রায় চীনের সঙ্গে বাণিজ্য করবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ডলারকেন্দ্রিক অর্থনীতিও। রাশিয়া আক্রান্ত হলে চীন তার পাশে থাকবে। এভাবে এক ঢিলে দুটি পাখি মারবে চীন। রাশিয়া হয়ে পড়বে চীনের ছোট তরফের অংশীদার আর যুক্তরাষ্ট্রকে পূর্ব ইউরোপে ব্যস্ত রাখার মাধ্যমে তাইওয়ানকে বগলদাবা করার পথে এগোনো এবং দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য বাড়ানোর সুযোগ পাওয়া। পুতিন ইউক্রেনে সফল হলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমাদের এককেন্দ্রিক বিশ্বের কবর রচিত হবে ইউক্রেনের তৃণভূমিতে। চীনের চেয়ে কে বেশি সেটা চায়?

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, পুতিনের আত্মা নেই তাই তাঁকে বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু জার্মানিসহ ইউরোপের বাস্তববাদীরা আত্মা বা বিশ্বাস খুঁজছেন না। তাঁরা দুটি জিনিস বোঝেন—গ্যাস ও পরমাণু বোমা। রাশিয়ার গ্যাস পাওয়ার জন্য এবং পারমাণবিক যুদ্ধ এড়াতে পুতিনের সঙ্গে আলোচনা বন্ধ করেননি তাঁরা, অন্য কিছু ন্যাটো দেশের মতো অস্ত্র ও সেনা পাঠাননি ইউক্রেনে। ইরাক যুদ্ধের প্রত্যাঘাতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে ইউরোপও। সেখানে খোদ ইউরোপের মাটিতে যুদ্ধ তো আরও ভয়ানক। এর মূল্য কেবল ইউক্রেন ও রাশিয়াই দেবে না, দেবে পুরো ইউরোপ। যুক্তরাষ্ট্র তো আটলান্টিকের ওপারের দেশ। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে না রাগিয়েই রাশিয়াকে খুশি করা দরকার। অর্থাৎ রাশিয়াকে দাও নিরাপত্তা আর বাঁচাও ইউক্রেন। এ এক কঠিন সমীকরণ। পশ্চিমাদের বর্তমান নেতা বাইডেনের কাছে এই জটিলতা সমাধানের কোনো ফর্মুলা মেলেনি।

রাশিয়া যে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা চায়, তা দিতে পারে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ইইউ ও ন্যাটোর আওতায় রাশিয়ার প্রতিবেশীদের টানা মানে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে রাশিয়াকে একঘরে ও প্রভাবহীন করে ফেলা। তার ওপর একের পর এক জর্জিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্তান, ইউক্রেনে মার্কিন স্পনসরড রেজিম চেঞ্জের খেলা রাশিয়াকে আরও উগ্র করে তুলেছিল। ইউক্রেন ২০১৪ সাল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া অঞ্চলের রুশভাষীদের ওপর হামলা চালাচ্ছিল। কোণঠাসা শক্তি ঘুরে দাঁড়াবেই। কিন্তু রাজায় রাজায় যুদ্ধে উলুখাগড়া ইউক্রেনের যে প্রাণ যায় যায়!

ইউক্রেনের উচিত ছিল রুশ প্রতিবেশী ফিনল্যান্ডের মতো জোট নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকা। ন্যাটো নামক বর্শা ইউক্রেনকে বাধ্য করেছে রাশিয়াকে খোঁচানোর ফলা হতে কিন্তু যে আহত হচ্ছে, সে তো আগে ফলা ঠেকাবে। কোনো ছোট রাষ্ট্রের উচিত নয় বৃহতের বর্শার ফলা হয়ে বিপদ ডেকে আনা। পৃথিবীতে এখন আবার জোট নিরপেক্ষতা দরকার। পরাশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা থেকে দূরে থাকার জন্য ছোট রাষ্ট্রগুলোর জোট চাই। ইউক্রেন নিয়ে যুদ্ধ পুরোদমে শুরু হয়ে গেলে সেটা আর আঞ্চলিক থাকবে না। পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা রুশ-মার্কিন স্বার্থ যখন পরস্পরের ক্ষতি করতে চাইবে, তখন উলুখাগড়ারা কোথায় যাবে, তা ভাবা দরকার।

পৃথিবী এখন গ্রিক সমরবিদ থুসিডাইডিসের ফাঁদে পড়ে গেছে। মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গ্রাহাম টি অ্যালিসন একে ব্যাখ্যা করেন এভাবে, যখন উদীয়মান পরাশক্তি কায়েম থাকা পরাশক্তির আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক দাপটে ভাঙন ধরাতে চায়, তখন উভয় পক্ষের যেকোনো একজন যুদ্ধ লাগিয়ে দিতে পারে; এটা ব্যতিক্রম নয়, এটাই নিয়ম। এই শতকে উদীয়মান চীন কায়েমি যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলার পথে এগোচ্ছে। দাপট ধরে রাখার জন্য যুদ্ধের পথে যুক্তরাষ্ট্রও। রুশ-ইউক্রেন ফ্রন্ট সেই বিশাল ছকেরই অংশ। দুনিয়ার ক্ষমতার পুনর্বণ্টন ছাড়া এর মীমাংসা নেই। কিন্তু সেই মীমাংসা যুদ্ধ ছাড়াও করা সম্ভব কি না, সেটাই আজকের পৃথিবীর অন্যতম বড় জরুরি প্রশ্ন।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও নির্বাহী সম্পাদক, প্রতিচিন্তা