প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সত্যি সত্যি বিশ্বাস করা শুরু করেছিলেন যে তিনি শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন। বারাক ওবামা কিছু না করেই পেয়েছেন, আর তিনি উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে শান্তিচুক্তি প্রায় করে ফেলেছেন! তাঁর রাজনৈতিক সভায় দলের লোকেরা ধুয়া তুলত, নোবেল নোবেল! তাই শুনে ট্রাম্প মিটিমিটি হাসতেন আর বলতেন, ‘দ্যাখো, সবাই কী বলে।’
তিনি নোবেলের জন্য এতটা মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন যে জাপানের প্রধানমন্ত্রীকে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করেছিলেন তাঁকে পুরস্কার দেওয়ার সুপারিশ করে তিনি যেন নোবেল কমিটির কাছে একটি পত্র লেখেন। লিখেওছিলেন, ট্রাম্প নিজে ঢাকঢোল পিটিয়ে জানান দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে পাঁচ পাতার চমৎকার একটি সুপারিশনামা পাঠিয়েছেন। তবে এটি যে তাঁর অনুরোধে লেখা, সে কথা অবশ্য চেপে গিয়েছিলেন।
নোবেলের জন্য ট্রাম্প তাঁর সব ডিম উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে বিপারমাণবিকীকরণ চুক্তি নামক ঝুড়ির ওপর রেখেছিলেন। হায়, হ্যানয়ে উত্তর কোরিয়ার নেতার সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকের দ্বিতীয় দিন তাঁর সে ডিমের ঝুড়ি পপাত ধরণিতল। তিনি অবশ্য ব্যাখ্যা করে বলেছেন, কিম জং-উন আবদার করেছিলেন তাঁর দেশের ওপর যে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়েছে, তা তুলে নিতে হবে। প্রতিদানে তিনি সে দেশের অন্যতম পারমাণবিক কেন্দ্র বন্ধ করে দেবেন। ট্রাম্প তাতে রাজি হননি। ‘মাঝেমধ্যে চুক্তি শেষ না করে উঠে আসতে হয়,’ তিনি সাংবাদিকদের বলেন। উত্তর কোরিয়া অবশ্য বলেছে, সব নয়, তারা আংশিক অবরোধ তুলে নিতে বলেছিল।
ট্রাম্প শুধু নোবেল পুরস্কার নয়, একটা বড় রাজনৈতিক জয়ের আশাও করেছিলেন। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে শান্তিচুক্তি ভেস্তে যাওয়ায় ট্রাম্পের নোবেল পুরস্কার ফসকে যেতে পারে, তা–ই নয়, তিনি একটা বড় ধরনের রাজনৈতিক জয়ের আশা করছিলেন, সেটাও হাতছাড়া হলো। দেশের অভ্যন্তরে তিনি একের পর এক বিপদের মুখে রয়েছেন। গত নভেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলে কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদ তাঁর দলের হাতছাড়া হয়েছে। এত দিন রিপাবলিকান দল তাঁর চৌদ্দ রকম অনিয়ম দেখেও না দেখার ভান করেছে, টুঁ শব্দ করেনি। এখন সব বদলে গেছে। একের পর তদন্ত শুরু হয়েছে। গত সপ্তাহে ট্রাম্পের সাবেক ব্যক্তিগত আইনজীবী মাইকেল কোহেনের প্রকাশ্য শুনানি দিয়ে তাঁর বস্ত্রহরণ শুরু করেছেন ডেমোক্র্যাটরা।
একসঙ্গে দুই ঘটনা—একদিকে ভিয়েতনামে ট্রাম্প, অন্যদিকে ওয়াশিংটনে মাইকেল কোহেন। নিউইয়র্কার পত্রিকার সুসান গ্লাসার মন্তব্য করেছেন, বেচারা ট্রাম্প! তাঁর জীবনটা একেবার নরক করে ছাড়ল কোহেন। ভিয়েতনামে তিনি কিমের কাছে ঘোল খেলেন, আর ওয়াশিংটনে তাঁকে নাস্তানাবুদ করলেন কোহেন।
শুধু কোহেন নন, ট্রাম্পের কাছের সহচরদের অন্য অনেককেও কংগ্রেসের সামনে ডাকা হবে বলে ডেমোক্রেটিক নেতারা জানিয়েছেন। তাঁদের অন্যতম হলেন ট্রাম্প করপোরেশনের চিফ ফিন্যান্সিয়াল কর্মকর্তা এলেন ওয়াইসেলবার্গ। তিনি কয়েক যুগ ধরে ট্রাম্প পরিবারের সেবা করে আসছেন, অনেক গোপন খবরই তাঁর জানা। কোহেন যদি তাঁর সাক্ষ্যভাষ্যে ট্রাম্পের গেঞ্জি ধরে টান দিয়ে থাকেন তো ওয়াইসেলবার্গ চাইলে তাঁর ল্যাঙট টেনে নামাতে পারেন। ট্রাম্পের কন্যা ও জামাতাকেও ডেকে পাঠানোর আয়োজন চলছে।
আট হাজার মাইল দূরে থাকায় ট্রাম্প নিজ চোখে কোহেনের শুনানি সময়মতো দেখতে পাননি, তবে খোঁজখবর ঠিকই নিয়েছেন। একাধিক টুইটে তিনি কোহেনকে মিথ্যাবাদী অভিযুক্ত করে গালমন্দ করেছেন। এ দেশের পত্রপত্রিকায় কোহেনের নাম দেওয়া হয়েছে ট্রাম্পের ‘ফিক্সার’, সোজা বাংলায় লেঠেল। ১০ বছর ট্রাম্পের ঢাল ও তরোয়াল হয়ে কাজ করেছেন তিনি। এর আগের এক শুনানিতে ট্রাম্পকে রক্ষা করতে গিয়ে হলফ নিয়ে কংগ্রেসের সামনে মিথ্যা বলেছিলেন, সে জন্য তাঁকে তিন বছরের জেল সাজা হয়েছে। এবার ফিরানিতে এসে তিনি মনের সব জ্বালা–যন্ত্রণা জুড়ালেন ট্রাম্পের তাবৎ কুকীর্তির সবিস্তার বিবরণ দিয়ে। কোনো রাখঢাক ছাড়াই বললেন, এই লোকটা শুধু মিথ্যুকই নন, তিনি একজন প্রতারক ও বর্ণবিদ্বেষী।
হ্যানয় শীর্ষ বৈঠক সফল হলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হতেন ট্রাম্প। কোহেনের শুনানির পর এখনো তিনিই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু, তবে হাততালির বদলে সবাই এখন তাঁকে নিয়ে হো হো করে হাসছে। পর্নো তারকার মুখ বন্ধ রাখতে মোটা টাকা গছিয়েছেন, সে কথা আমরা আগেই জানি। রুশ আইনজীবীর সঙ্গে ট্রাম্প টাওয়ারে তাঁর ক্যাম্পেইনের কর্তাদের গোপন বৈঠক তাঁর সম্মতিতে হয়েছে, সে সন্দেহও আমরা আগেই করেছিলাম। এসবের বাইরে আরও নানা নতুন তথ্য ফাঁস করলেন কোহেন।
যেমন ট্রাম্প বরাবর দাবি করে এসেছেন, তিনি সবার চেয়ে সব ব্যাপারে অধিক পণ্ডিত, অন্য সবার চেয়ে তাঁর আইকিউ বেশি। অথচ কোহেন জানালেন, কেউ যাতে ট্রাম্পের পরীক্ষার ফল না জানতে পারে, সে জন্য বসের নির্দেশে স্কুলের প্রিন্সিপালকে ধমক দিয়ে তিনি (অর্থাৎ কোহেন) চিঠি পাঠিয়েছেন। এক স্কুলের প্রিন্সিপাল সে কথা সঠিক বলে ইতিমধ্যে জানিয়েছেন।
আরও এক মজার ব্যাপার, নিজের এক পোর্ট্রেট ট্রাম্প নিজেই লোক ভাড়া করে বিক্রি করিয়েছেন। কোহেনই সেই লোককে জোগাড় করে ৬০ হাজার ডলার দিয়ে কিনিয়েছিলেন, উদ্দেশ্য, ট্রাম্প কত জনপ্রিয়, সে কথা প্রমাণ করা। পরে ট্রাম্প ফাউন্ডেশন থেকে সে লোকের দেনা চোকানো হয়।
ট্রাম্প ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীতে নাম লেখাননি পায়ের হাড়ের সমস্যার অজুহাতে। কোহেন জানালেন, এটাও একটা ডাহা মিথ্যা। পায়ের হাড়ফাড় কিছু না, সবটাই চিকিৎসকের মিথ্যা সার্টিফিকেট। কোহেনের কথামতো, ট্রাম্প তাঁকে বলেছেন, ভিয়েতনামে যাব আমি! তোমার মাথা খারাপ!
আরও কত কেচ্ছা!
উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারটা যে এভাবে কেচে গেল, তার জন্য দায়দায়িত্ব ট্রাম্প এড়াতে পারেন না, এ কথা এখন অনেকেই বলছেন। পর্যাপ্ত আগাম প্রস্তুতি ছাড়া, কোনো সুচিন্তিত রণকৌশল গ্রহণ না করে শীর্ষ বৈঠকে গিয়েছিলেন ট্রাম্প। এর আগের বছর সিঙ্গাপুরে তাঁদের প্রথম বৈঠকেও একই ঘটনা ঘটেছিল। কোনো পরিকল্পিত আলাপ-আলোচনা নয়, পুরো ব্যাপারটাই ট্রাম্পের জন্য ছিল টেলিভিশনের একটি ‘রিয়েলিটি শো’। কিমের সঙ্গে কথা বলে তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়ে পড়েন যে ফিরে এসে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, ‘আমি কিমের প্রেমে পড়ে গেছি।’ এর মাত্র কয়েক মাস আগে তিনি এই কিমকেই ‘রকেটম্যান’ বলে ঠাট্টা করেছিলেন, হুমকি দিয়েছিলেন বোমা মেরে তাঁর পুরো দেশটাকেই গুঁড়িয়ে দেবেন।
ট্রাম্প ভেবেছিলেন, মুখোমুখি দেখা হলে কিমকে হাতের মুঠোয় আনা তাঁর জন্য নস্যি। নিজের অনুগত সমর্থকদের বুঝ দিয়েছিলেন তিনি বিশ্বের সেরা ‘ডিল মেকার’। অন্য সবাই যেখানে চুক্তি করতে ব্যর্থ, সেখানে তিনি সফল। তিনি এমন কথাও বলেছিলেন, ‘অনেক লোক আছে চমৎকার ছবি আঁকে বা কবিতা লেখে। আমি সেসবের বদলে চুক্তি সম্পাদন করি। সেটাই আমার কবিতা।’
হ্যানয়ের ব্যর্থ বৈঠকের পর ট্রাম্পের সেই কবিতা আর আমাদের পড়া হবে না। তার বদলে ‘ট্রাম্পের বস্ত্রহরণের’ যে কেচ্ছা আমরা তাঁর ‘লেঠেলের’ কাছ থেকে পেলাম, সেটা কীভাবে সামলাবেন, ট্রাম্পকে এখন সে কথাই ভাবতে হবে।
হাসান ফেরদৌস যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি