নুরজাহানের কথা কি আপনাদের মনে আছে? আমি সেই নুরজাহানের কথা বলছি, দ্বিতীয়বার বিয়ে করার অপরাধে যিনি নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। ফতোয়াবাজরা তাঁকে ১০১ বার পাথর নিক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছিলেন। নির্দেশ পালন হয় একেবারে নিখুঁতভাবে। পাথরের আঘাত সহ্য করতে পারলেও নিজের অপমান মেনে নিতে পারেননি নুরজাহান। বিষপানে আত্মহত্যা করেন ২২ বছরের ওই তরুণী। ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি মাসে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ছাতকছড়া গ্রামে ঘটেছিল মর্মান্তিক এই ঘটনা। তারপর অনেক বছর পার হয়ে গেছে। দেশ অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে। অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু ফতোয়াবাজদের দৌরাত্ম্য কমেনি। তাঁরা এখনো সক্রিয়। এই তো গত সপ্তাহেই কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কল্যাণপুর গ্রামে নারীদের মাঠে যাওয়ার ওপর কথিত ওই ফতোয়া জারি করেন স্থানীয় জামে মসজিদ কমিটির সদস্যরা।
১২ ডিসেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত এ খবর পড়ে হতবাক হই। মসজিদ কমিটি এই কথিত ফতোয়া দিয়েছে। কারণ, তারা মনে করে, এই এলাকার নারীরা মাঠে বেশি যাচ্ছেন। এতে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। তাঁরা মাঠে গিয়ে ফসল চুরি করেন এবং অসামাজিক কার্যকলাপ করেন। নারীরা মাঠে কম গেলে ফসলের উন্নতি হবে। তাই তাঁদের মাঠে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, নারীদের যাতায়াত বন্ধে ও ফসল রক্ষায় মাঠে চৌকিদার নিয়োগের জন্য গ্রামবাসীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে।
খবর পড়ে জানা গেল, নারীরা ফসল চুরি করছেন বা অসামাজিক কার্যকলাপ করছেন—এমন কোনো প্রমাণ মসজিদ কমিটির হাতে নেই। হাতে প্রমাণ নেই, অথচ স্রেফ ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা এ রকম একটি ফতোয়া জারি করে দিল? নারীরা ফসলের মাঠে যাবেন কি না, তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা তাদের কে দিয়েছে?
আসলে আমাদের দেশে নারীকে দমন করে রাখার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি দীর্ঘদিনের। নারীর কোনো উন্নতি হতে পারে না, তাঁরা পুরুষকে ছাড়িয়ে যেতে পারবেন না, সব সময় পুরুষের কাছে মাথা নত হয়ে থাকবেন—এ রকমটা এখনো ভাবে দেশের বেশির ভাগ মানুষ। নারীদের মাঠে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা এই মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। এখানে নারীদের দমিয়ে রাখার একটা হীন প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
এ দেশের কৃষি খাতে নারীর অবদানের কথা কে না জানে? কৃষিকাজের ২১টি ধাপের মধ্যে নারীরা ১৭টি ধাপের কাজ করেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফসলের প্রাক্-বপনপ্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিপণনের অনেক কাজ নারী এককভাবে করেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ২০১০ সালের শ্রমশক্তি জরিপে দেখা গেছে, দেশে কৃষিকাজে নিয়োজিত শ্রমশক্তির সংখ্যা ২ কোটি ৫৬ লাখ। এর মধ্যে নারী প্রায় ১ কোটি ৫ লাখ। আর সেই নারীদের ফসলের মাঠে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা! একবিংশ শতকে এসেও আমাদের এ ধরনের ঘটনা দেখতে হচ্ছে। এর চেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় আর কী হতে পারে? আর ইসলামে কি কোথাও নারী-পুরুষের শ্রম বিভাজন করা হয়েছে?
ভাবছি, ফতোয়াবাজদের দৌরাত্ম্য কবে থামবে? ২০১০ সালের ৮ জুলাই হাইকোর্টের একটি রায়ে ফতোয়ার নামে বিচারবহির্ভূত কার্যক্রম ও শাস্তি প্রদানকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। উচ্চ আদালতের ওই রায়ে বলা হয়েছিল:
১. ধর্মীয় বিষয়ে যথাযথ শিক্ষিত ব্যক্তিরা শুধু ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কে ফতোয়া দিতে পারবেন। এই ফতোয়া স্বেচ্ছায় গৃহীত হতে হবে। ফতোয়া মানতে কাউকে বাধ্য করা, জোর করা কিংবা অনুচিত প্রভাব প্রয়োগ করা যাবে না।
২. কোনো ব্যক্তির দেশে প্রচলিত আইন দ্বারা স্বীকৃত অধিকার, সম্মান বা মর্যাদা ক্ষুণ্ন বা প্রভাবিত করে, এমন ফতোয়া কেউ প্রদান করতে পারবে না।
৩. ফতোয়ার নামে কোনো প্রকার শাস্তি, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা যাবে না।
কিন্তু কিসের কী। দেশে এখনো গ্রামাঞ্চলে বিচারের নামে তথাকথিত ফতোয়া জারি হচ্ছে। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসবের শিকার হচ্ছেন নারীরা।
ফতোয়া হচ্ছে ধর্মীয় আইন বিশেষজ্ঞ বা মুফতির দেওয়া মতামত। সবাই এটার প্রয়োগ করতে পারেন না। কিন্তু এই ফতোয়া এখন নারীকে দমনের অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। একশ্রেণির মানুষ নারীকে দমিয়ে রাখতে এবং নারীর অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে মনগড়া কিছু আইন তৈরি করে ফতোয়া বলে নারীর ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। ফতোয়াবাজির কারণে অনেক অসহায় ও দরিদ্র পরিবার গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। এরা নারীর শত্রু, রাষ্ট্রের শত্রু। ধর্মও এদের কাছে নিরাপদ নয়।
ভেবে অবাক হই, হাইকোর্ট যেখানে ফতোয়া জারির এখতিয়ার নির্দিষ্ট করে দেন, সেখানে কী করে গ্রামাঞ্চলে এধরনের বৈষম্যমূলক নিষেধাজ্ঞা চলে? আইন ও ধর্মের কর্ত্বত্ব নিজের হাতে তুলে নেওয়া এবং তার অপব্যবহার প্রতিরোধের দায়িত্ব সরকারের যেমন, সমাজেরও তেমন। সরকারকে এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, কুষ্টিয়ায় ফতোয়া জারির সঙ্গে জড়িত তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ। তবে শুধু আটক করলেই হবে না। এদের যথোপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। আইনের ফাঁক গলে এরা যাতে কোনোভাবে পার না পায়, তা দেখতে হবে।
রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক