বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সংসদে যোগদান না করার সিদ্ধান্তটি ব্যক্তিগত, বিএনপির নির্বাসিত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের চাপানো নয় বলেই জেনেছি। কিন্তু এই কথায় ফাঁক থাকা স্বাভাবিক, না থাকা অস্বাভাবিক।
ফখরুল সংসদে থাকলে গণতন্ত্রের, দলের, এমনকি জিয়া পরিবারের প্রতি গণতন্ত্রকে অস্বীকার করে চলা ক্ষমতাসীন দলের মনোভাবে অপেক্ষাকৃত পরিবর্তন আনতে ভূমিকা রাখতেন। কিন্তু যাঁরা কট্টর বা সংসদে না যাওয়াকেই শ্রেয় মনে করেন, তাঁরা তাঁর বর্জনে একটা সান্ত্বনা খুঁজছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীরা আন্দোলনের কৌশল হিসেবে সংসদে যোগদানকে সর্বদা বিষবৎ জ্ঞান করেছেন। বিএনপির দশা আরও করুণ। কারণ, মির্জাকে সংসদে দেখলে ‘একমাত্র নজরুল ইসলাম খান ছাড়া’ স্থায়ী কমিটির সক্রিয় নেতাদের কেউ খুশি হতেন বলে খবর পাই না।
মির্জা ফখরুল সংসদে গেলে দল হয়তো এখনই ভাঙত না, তবে চাপে পড়ে তিনি যে ‘প্রজ্ঞার’ পরিচয় দিয়েছেন, তাতে দলটি ভাঙনের কবল থেকে বেঁচে গেল, তা-ও বলা কঠিন। গয়েশ্বর রায় ফখরুলকে সার্কাসের জোকারই বলেননি, তিনি তারেকের সিদ্ধান্তকে প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। আরও একজন সাবেক মন্ত্রী ও স্থায়ী কমিটির সদস্য ‘কত টাকা খেয়ে পাঁচজনকে সংসদে যোগদান করানো হয়েছে’ মর্মে ফখরুলকে অভিযুক্ত করেছেন। এসবই দল পচনের লক্ষণ!
জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সদস্য নির্বাচনে জিতে গেলে, বিশেষ করে মওদুদ আহমদ ও খন্দকার মোশাররফ হোসেন জয়ীদের তালিকায় থাকলে আমরা ভিন্ন চিত্র দেখতাম। মির্জা ফখরুল জিয়া ডাইনেস্টির তত্ত্বাবধায়ক থাকতে থাকতে আবার বৈধ মালিক না বনে যান, সেই সতর্কতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কিছু যে থাকতে পারে, তা বিবেচনায় নেওয়ার মতো প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক সংস্কৃতি বাংলাদেশে এখনো গড়ে ওঠেনি। সুতরাং মির্জা ফখরুলের ‘কৌশলগত বা আদর্শগত’ যুক্তির ধরন কী, তা আলোচনার দাবি রাখে। বিএনপি বা তারেক রহমান লন্ডনে বসে শাসক দলের আইনের শাসনচ্যুত শাসনের বিপরীতে ইতিবাচক রাজনীতি শুরু করেছেন, সাধারণভাবে এটা মনে করা অবাস্তব। এবং এর বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট খুবই স্বাভাবিক।
গত ১০ জানুয়ারি এই কলামে লিখেছিলাম, বিএনপির ‘যেসব কারণে সংসদে যাওয়া উচিত’। এই লেখায় আমরা দেখব, যেসব বিষয় মির্জা ফখরুলকে আছাদুজ্জামান খান (১৯৭৯-এর সংসদে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের নেতা) হতে বাধা দিল।
এক. গণফোরামের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও মোকাব্বির খানকে অনুসরণ করে বিএনপির পাঁচ নির্বাচিত সাংসদ যদি শপথ নিতে উদ্যোগী না হতেন, তাহলে বিএনপির ‘কৌশল’ দেখতেই হতো না। সুতরাং সংসদে যোগদানে তারেকের সায়, তাঁর ইতিবাচক মনোভাবের ফল নয়। এখন ‘কৌশলের অংশ’ বলে যা চালানো হচ্ছে, সেটা মুখরক্ষার কৌশল বটে। ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের সাংসদ জাহিদুর রহমানকে বহিষ্কার করার গতি থেকে বোঝা যায়, বিএনপির স্থায়ী কমিটি ও তারেক রহমান—কারও চিন্তায় সংসদে যোগদানের কৌশল ছিল না। তবে জানতাম ফখরুল সংসদে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন। ৫ মে তিনি স্বীকারও করেন, সংসদে না যেতে দলীয় সিদ্ধান্ত ভুল ছিল।
দুই. জাহিদুর রহমানকে বহিষ্কারের পরও যখন অন্যরা শপথ নিতে ভড়কে যায়নি, তখনই সম্ভবত ‘কৌশল তত্ত্ব’ আবিষ্কৃত হয়।
তিন. এই দাবি যদি সঠিক হয় যে খালেদা জিয়া কারাগারে মির্জা ফখরুলকে সর্বশেষ সাক্ষাতে সংসদে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন, তাহলে এই ঘটনা প্রমাণ দিল যে বিএনপির সিদ্ধান্ত নেওয়ার চাবিকাঠি তারেক রহমানের হাতে চলে গেছে। খালেদা জিয়া গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তারেকের মত নিতে অভ্যস্ত ছিলেন না।
চার. তারেক রহমানের ‘অনুরোধ’ সত্ত্বেও মির্জা ফখরুল সংসদে যাননি। শেষ মুহূর্তে এই ‘অনুরোধ’ করাটা ছিল তারেক রহমান বা জিয়া পরিবারের কৌশল। আর অনুরোধ রক্ষা না করা ছিল ফখরুলের কৌশল।
পাঁচ. মির্জা ফখরুল সংসদে গেলে তিনি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিকল্প নেতা হিসেবে একটি ভাবমূর্তি গড়তে পারতেন, সেই পথ রুদ্ধই রাখা হলো। বিএনপি নামক সত্তা সম্ভবত মনে করে, জিয়া পরিবার ছাড়া দলটি সংগঠন হিসেবে টিকে থাকতে পারে না। প্রয়োজনে বিএনপি মুছে যেতে পারে, কিন্তু জিয়া পরিবারের বাইরের ‘কোথাকার’ মির্জা ফখরুলকে কোনোভাবেই শীর্ষ নেতা মানা যাবে না।
ছয়. গত নির্বাচনের আগে বিএনপি ইঙ্গিত দিতে পারেনি যে তারা সরকার গঠন করতে পারলে রাষ্ট্রপতি তাঁদের মধ্য থেকে কাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে আহ্বান জানাবেন। এটা ছিল মির্জা ফখরুল অথবা জিয়া পরিবারের বাইরে কারও নাম প্রকাশে দল বা পরিবারটির প্রস্তুতির অভাব। মুখে ‘ভোটবিপ্লবের’ সম্ভাবনার কথা বললেও তারা হয়তো এটা ভাল্লাই জানত যে এটা অবাস্তব। সুতরাং নাম প্রকাশ করে জিয়া পরিবারের ভিত আরও আলগা করার ঝুঁকি নেওয়া হয়নি। এই অচলাবস্থা নিয়েই সম্ভবত দলটি চলতে থাকবে।
সাত. বিএনপির সর্বশেষ ‘কৌশলের অংশ’ আরও কতিপয় প্রশ্নকে জ্বলন্ত করেছে। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর ঢাকার উত্তর সিটি মেয়র এবং উপজেলা নির্বাচন তারা যেভাবে বর্জন করেছে, তাতে মনে হয়েছিল, তারা আওয়ামী লীগের অধীনে আর নির্বাচনের ধারেকাছেও যাবে না। কিন্তু সংসদে দলটি থাকবে অথচ নির্বাচন হলেই তা বয়কট করবে, তা সাংঘর্ষিক।
আট. বগুড়ার শূন্য হওয়া আসনটি ঐতিহ্যগতভাবে জিয়া পরিবারের। কিন্তু এই আসন ছেড়ে দেওয়ার পর সেই আসনের উপনির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থী হওয়া দৃষ্টিকটু হলেও তাঁরাই শক্ত লড়াই করতে পারবেন। একাদশ সংসদে দল থাকবে, কিন্তু সেই সংসদের উপনির্বাচন দলটি বর্জন করবে, এটা পরস্পর বিরোধী।
নয়. সংসদে ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসনের একটি বিএনপির জন্য খালি আছে। এই পদে তারেক-পত্নী জোবাইদা রহমান বা কোকো-পত্নী সিঁথিকে দেখা যাবে? তাঁরা যে কেউ দেশে ফিরলে আগের মামলাতেই তাঁদের কারাগারে যেতে হতে পারে। সুতরাং জিয়া পরিবার এসে সংসদীয় গ্রুপে মির্জা ফখরুলের শূন্য করে দেওয়া স্থানটি পূরণ করবেন, সেই সম্ভাবনা উজ্জ্বল নয়।
মির্জার সংসদে যাওয়ার প্রশ্নটির সঙ্গে উত্তরাধিকারের রাজনীতির একটি বিরাট প্রশ্ন জড়িত। খালেদা জিয়া কারাবন্দী, তারেক রহমান নির্বাসিত। খালেদা জিয়া জামিন কিংবা প্যারোলে যেভাবেই বাইরে আসুন না কেন, তাঁকে সম্ভবত একটা বড় সময়ের জন্য বিদেশেই থাকতে হবে। আর তারেক রহমান ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে লন্ডনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের (আপনি দেশে কবে যাবেন) উত্তরে বলেছিলেন, দেশে ফিরলে তাঁর জীবনের ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। এরপর আর তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে কথা ওঠেনি। সুতরাং ধরে নেওয়া যায়, মির্জা ফখরুলকেই বিএনপির নেতৃত্ব দিতে হবে। তাঁর পক্ষে এমন পদক্ষেপ নেওয়া সমীচীন নয়, যা দলকে আরও দুর্বল করে। তিনি সংসদীয় গ্রুপের নেতা হলে তাঁর প্রাত্যহিক জীবন ছারখার হতে পারত।
বলা যায়, কার্যত স্থায়ী কমিটির সদস্যদের গোপন ঈর্ষার বলি হলেন মির্জা ফখরুল। শেষ পর্যন্ত মির্জা ফখরুলের সংসদে না যাওয়ার বিষয়টির সঙ্গে দূরদর্শিতার সম্পর্ক নেই কিংবা থাকলেও তা আলগা। ব্যক্তিগত সৌজন্য ও দলের লোকজনের কাছ থেকে অব্যাহত গালমন্দ শোনার অনীহা থেকেই সম্ভবত তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাংলাদেশে নির্বাচিত হয়ে স্বেচ্ছায় কারও শপথ না নেওয়ার ঘটনা এই প্রথম।
মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
mrkhanbd@gmail.com