সেনাবাহিনীর দয়াদাক্ষিণ্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের প্রতিষ্ঠান পুতুলনাচের মঞ্চের সুতোয় বাঁধা পুতুলের চেয়ে বেশি কিছু হতে পারেনি।
২০১৬ সালে অং সান সু চির নতুন সরকারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে উ থিন কিউ যখন শপথ নেন, তখন আমি লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় একটি কলামে লিখেছিলাম, ‘প্রেসিডেন্ট হিসেবে থিন কিউর দায়িত্ব গ্রহণ মিয়ানমারের সাধারণ মানুষের জন্য একটি প্রতীকী গুরুত্ব বহন করছে। সাধারণ মানুষ বহুদিন ধরে দেশকে সামরিক বোঝা থেকে মুক্ত করার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে এসেছে। ৫৩ বছরের মধ্যে এই প্রথম ৫ কোটি ১০ লাখ বর্মি প্রেসিডেন্ট হিসেবে এমন একজন মানুষকে পেয়েছে, যাঁর গায়ে কোনো দিন খাকি পোশাক ওঠেনি। তিনি সেনাবাহিনীর স্বার্থ রক্ষার জন্য সব সময় ব্যস্ত থাকবেন না, এমন আশা তাঁকে নিয়ে করাই যায়।’
গত আট বছরে মিয়ানমারের ‘গণতান্ত্রিক উত্তরণ’ ও ‘সংস্কার’-এর নতুন যুগ নিয়ে গণমাধ্যমে কলমের বহু কালি নষ্ট হয়েছে। হতাশার সঙ্গে লক্ষ করছি, আমার দেশের ‘বিশেষজ্ঞ’ ও আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের বেশির ভাগই একটি আধা সামন্ততান্ত্রিক বলয়ের কিছু নেতার খুঁটিনাটি মতামতের ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক ভবিষ্যদ্বাণী করে আসছেন। কীভাবে প্রেসিডেন্ট পদটিকে আরও আলোকিত করা যায় এবং কীভাবে আরও ক্ষমতাশালী ও শুভশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, সে বিষয়ে তাঁরা মতামত দিচ্ছেন।
অক্সফোর্ড থেকে পাস করা মিয়ানমারের নেতৃস্থানীয় সাহিত্য ব্যক্তিত্ব এবং রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্মি সাহিত্যের সাবেক অধ্যাপক প্রয়াত উ ইয়ুনের ছেলে থিন কিউ একজন নিপাট ও মানবিক ভদ্রলোক। সু চির একান্ত বাধ্যগত সহযোগী হওয়া ছাড়া তাঁর কিছু করার নেই। তাঁর বাবাও সু চিকে সমর্থন করতেন এবং ১৯৯০ সালে সু চির দল এনএলডি থেকে তিনি নির্বাচন করেছেন এবং জয়ীও হয়েছেন। অবশ্য ওই নির্বাচনের ফল জান্তা সরকার বাতিল করে দিয়েছিল। থিন কিউ তাঁর বাবার মতোই সু চির একান্ত বাধ্যগত লোক হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। জনসমক্ষে তিনি সু চিকে ‘মা’ বলে ডাকেন। চির নমস্য দেবীর মতো ভক্তি-শ্রদ্ধা করার কারণেই ‘মা’ সু চি তাঁকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নেন।
কিন্তু সু চির প্রতি সর্বোচ্চ আনুগত্য প্রদর্শনই তাঁর জন্য যথেষ্ট ছিল না। ২০০৮ সালের সংবিধান অনুযায়ী, কমান্ডার ইন চিফ সিনিয়র জেনারেল মিন অং লাইয়ের কাছে তাঁর আরও গ্রহণযোগ্য হওয়ার দরকার ছিল। ২০০৮ সালে ঘূর্ণিঝড় নার্গিসে মিয়ানমারে ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়। এই দুর্যোগের মধ্যেই একটি পাতানো গণভোটের মাধ্যমে একটি সংবিধানের খসড়া পাস করা হয়। সাবেক সেনা কর্মকর্তারা সেনাবাহিনী এবং সব জেনারেলের স্বার্থ রক্ষার বিষয় নিশ্চিত করে সংবিধানটি প্রণয়ন করেন।
ওই সংবিধানে বলা হয়, ভোটের রায় যা-ই হোক না কেন, প্রেসিডেন্ট যে–ই হোন না কেন, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সেনাবাহিনীর কথাই শেষ কথা হবে। সেনাবাহিনীর দল ইউডিএসপিকে ধরাশায়ী করে বিপুল বিজয় ছিনিয়ে আনার পরও সু চি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে প্রেসিডেন্ট হতে পারলেন না। এ কারণে থিন কিউকে তিনি এই ভেবে প্রেসিডেন্ট বানালেন যে থিন কিউ কখনোই জেনারেলদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবেন না। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি জেনারেল নে উইনের সাবেক অর্থমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী কর্নেল মং লুইনের জামাতা।
থিন কিউর প্রেসিডেন্ট পদে বসাটা সেনাবাহিনীর অনুমোদন সাপেক্ষে হোক আর না-ই হোক, এটি দ্বিগুণ পুতুলনাচ বা ‘ডাবল পাপেট্রি’ ছাড়া কিছু ছিল না। ২০১৫ সালে নির্বাচন হওয়ার আগেই সু চি নিজেকে ‘প্রেসিডেন্টের ঊর্ধ্বের লোক’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে থিন কিউ গদিতে বসলেও পেছন থেকে সব নির্দেশ দিচ্ছিলেন ‘প্রেসিডেন্টের ঊর্ধ্বে থাকা’ সু চি। সেনাবাহিনী কর্মকাণ্ডের নীরব দর্শক হওয়া ছাড়া থিন কিউর কিছু করার ছিল না। কিন্তু ‘সন্ত্রাসবিরোধিতার’ মিথ্যা দোহাই দিয়ে গণহত্যা চালিয়ে সেনাবাহিনী যখন রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করা শুরু করল, তখন সেটি থিন কিউর সামনে বিবেচ্য বিষয় হয়ে এল।
আমি যদি একজন ফার্স্ট লেডিসহ থিন কিউকে একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিই, তাহলে আমাকে মানতেই হয়, রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত যখন ‘প্রেসিডেন্টের ঊর্ধ্বের লোক’ সু চিকেও অভিযোগ থেকে রেহাই দিচ্ছে না, তখন রাষ্ট্রের ১ নম্বর আনুষ্ঠানিক পদে থাকা থিন কিউও রেহাই পেতে পারেন না।
জাতিসংঘ কিংবা আন্তর্জাতিক আদালত অভিযুক্ত হিসেবে কাকে বেশি মাথায় রাখবে? প্রেসিডেন্টকে নাকি ‘প্রেসিডেন্টের ঊর্ধ্বে থাকা’ ব্যক্তিকে? বাস্তবতা হলো মিয়ানমারে যতক্ষণ সেনাবাহিনী আইন ও প্রেসিডেন্টসহ সবকিছুর ঊর্ধ্বে থাকবে, ততক্ষণ সেখানে পার্লামেন্টের প্রধান কিংবা প্রেসিডেন্ট হওয়ার মধ্যে না থাকবে ক্ষমতা, না থাকবে মর্যাদা।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
মং জার্নি: মিয়ানমারের নির্বাসিত মানবাধিকারকর্মী ও লেখক