পরীক্ষা কেন নেওয়া হয়, এটি অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের যেমন জানা নেই, তেমনি জানা নেই দেশের অধিকাংশ শিক্ষকের। এ কারণে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা এ প্লাস পাওয়ার হিসাব করে; আর শিক্ষকেরা কোচিং বা অন্য মাধ্যমে ভালো নোট সরবরাহের চেষ্টা করেন। আমাদের শিক্ষা ও পরীক্ষাপদ্ধতিও এমন, যেখানে মুখস্থ হলো ভালো নম্বর পাওয়ার উপায়। শিক্ষার্থীরা নিজের মতো করে কিছু লিখতে পারে না, বিশ্লেষণ করা দূরে থাক। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আসা শিক্ষার্থীদের দিকে তাকালে এটা ভালোই বোঝা যায়। এ থেকে বেরিয়ে আসার উপায় অনেক হতে পারে। তবে প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড গঠন কিংবা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা জিইয়ে রাখা কোনো সমাধান হতে পারে না।
৯ নভেম্বর বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, পিইসি পরীক্ষা স্থায়ী করতে ‘প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড’ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, যার অন্যতম কাজ হবে পিইসি পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার যাবতীয় কাজ করা। প্রথম কথা, শিক্ষা বোর্ড করা মানে এই নয় যে পিইসি পরীক্ষা স্থায়ী হবে। তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, প্রাথমিক স্তরে পিইসি পরীক্ষাসহ নানান পরীক্ষা আছে। যেহেতু পরীক্ষা হচ্ছে, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে হয়, সে জন্য বোর্ড করা দরকার। আশঙ্কা বা ভয়ের জায়গা এখানেই। শিক্ষা বোর্ড গঠনের উদ্দেশ্য যদি হয় পরীক্ষার কাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা, তবে এই উদ্যোগকে সমর্থন জানানোর কোনো কারণ নেই।
পিইসি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে বাজারের গাইড বিক্রেতা, কোচিং সেন্টারের মালিক, স্কুলের শিক্ষকসহ সুবিধাভোগী কিছু লোকের মধ্যে অর্থ-বাণিজ্যের খেলা চলে। ফলে একটি গোষ্ঠী জোরালোভাবে এই পরীক্ষার পক্ষে রয়েছে। আর্থিক লাভ-অলাভ ছাড়া পিইসি পরীক্ষা চালু রাখার আর কোনো কারণ থাকতে পারে না।
পরীক্ষা শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করার একটা উপায় মাত্র। পরীক্ষার কারণে শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়ে, শিখন–আগ্রহও বাড়ে। আমাদের দেশে অবশ্য কখনোই তা হয়নি। প্রতিযোগিতা বলতে যা আছে, তা মূলত অভিভাবকদের মধ্যে। আর শিখন–আগ্রহ তৈরি করা দূরে থাক, শিক্ষার্থীদের শ্রেণির ন্যূনতম নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জন করানো সম্ভব হচ্ছে না। অথচ প্রতিটি শ্রেণির জন্য বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতা নির্ধারণ করা আছে। আমাদের এখানে পরীক্ষা মানে চোখ-কান বুজে উত্তর মুখস্থ করা। সেই উত্তর আবার স্কুলের শিক্ষক তৈরি করে দেন, কিংবা গাইড বইয়ে থাকে। অবাক করা ব্যাপার হলো পাবলিক পরীক্ষায় যেসব প্রশ্ন থাকে, সেগুলো গাইড বইয়েও পাওয়া যায়। এ কারণে বাজারের গাইড বইয়ের চাহিদাও কমানো সম্ভব হয়নি। অনেক শিক্ষক ক্লাসে সরাসরি গাইড বই কিনতে উৎসাহিত করেন; এমনকি নিজেও গাইড বই নিয়ে ক্লাসে যান।
এখানে জিপিএ-৫ পাওয়া যেহেতু একমাত্র লক্ষ্য, সেটা অর্জনের জন্য ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র পরীক্ষার্থীর হাতে তুলে দিতে সন্তানের মা-বাবাও দ্বিধা করেন না। তাঁরাও মনে করেন, সার্টিফিকেট দুর্বল হলে চাকরির বাজারে সন্তান পিছিয়ে পড়বে। পিইসি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে বাজারের গাইড বিক্রেতা, কোচিং সেন্টারের মালিক, স্কুলের শিক্ষকসহ সুবিধাভোগী কিছু লোকের মধ্যে অর্থ-বাণিজ্যের খেলা চলে। ফলে একটি গোষ্ঠী জোরালোভাবে এই পরীক্ষার পক্ষে রয়েছে। আর্থিক লাভ-অলাভ ছাড়া পিইসি পরীক্ষা চালু রাখার আর কোনো কারণ থাকতে পারে না। শিক্ষার্থীর শ্রেণি-যোগ্যতা অর্জিত হচ্ছে কি না, প্রচলিত প্রশ্নপদ্ধতি ও প্রচলিত পরীক্ষার মাধ্যমে তা যাচাই করা মোটেও সম্ভব নয়। এ কারণে শুরু থেকেই শিক্ষাবিদদের সবাই এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শিক্ষার্থীদের পড়ার চাপ কমাতে এবং বইয়ের ভার কমাতে নির্দেশ দিয়েছেন। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা গ্রহণকেও তিনি সরাসরি না করেছেন। পিইসি পরীক্ষা চালু রাখা মানে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার বনিয়াদকে ধ্বংস করা।
প্রস্তাবিত নতুন কারিকুলামে শিখনপ্রক্রিয়াকে অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও বাস্তবঘনিষ্ঠ করা হয়েছে। শ্রেণিকক্ষে পাঠগ্রহণকে আনন্দঘন করতে নতুন কৌশল ও পদ্ধতি নেওয়া হয়েছে এবং উদাহরণ দিয়ে তা দেখানো হয়েছে। পাঠ্যবইকে কার্যক্রমভিত্তিক ও উপলব্ধিমূলক করা হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে তথ্যকে মুখস্থ করে ধারণ করার প্রয়োজন পড়ে না। অথচ পিইসি থেকে শুরু করে পিএসসির বিভিন্ন পরীক্ষা এখনো তথ্য যাচাইমূলক হয়ে চলেছে। শিক্ষার্থীর যোগ্যতা অর্জনকে নিশ্চিত করতে এবং ভবিষ্যতের পৃথিবীতে শিক্ষার্থীকে প্রস্তুত করে তুলতে কারিকুলামের আমূল পরিবর্তন আনার বিকল্প নেই। পাঠ্যপুস্তকেও একই সঙ্গে পরিবর্তন আনতে হবে; যেহেতু প্রধান শিক্ষা-উপকরণ হিসেবে সেটি শিক্ষার্থীর হাতে থাকে।
নিশ্চয় শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যে কিংবা শিক্ষার সঙ্গে জড়িত কিছু ব্যক্তির মধ্যে এ ধারণা রয়েছে, পরীক্ষার মাধ্যমে আর কিছু না হোক, কিছু পড়াশোনা তো হয়। তাঁদের কাছে শিক্ষা মানে বেশি বেশি পড়া, বেশি বেশি মুখস্থ করা, আর বেশি বেশি নম্বর পাওয়া। এর ফলাফল হয়েছে এই, পাঠ্যবইয়ের বাইরে থেকে একই জাতীয় অন্য প্রশ্ন দিলে শিক্ষার্থীরা লিখতে পারে না। এর মানে হলো শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিখনযোগ্যতা অর্জন করছে না। যোগ্যতা অর্জিত হচ্ছে কি না, সেটি পাঁচ থেকে ছয় বছর পড়াশোনা শেষ করে একবার পরীক্ষা নিয়ে যাচাই করার বিষয় নয়। এটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া শ্রেণিকক্ষেই চালাতে হবে, যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ে মূল্যায়নে অংশ নেবে। এমনকি শ্রেণিকক্ষের বাইরে অভিভাবকও যুক্ত হবেন মূল্যায়নের প্রক্রিয়ার সঙ্গে। এখন যদি পিইসি পরীক্ষাকে স্থায়ী করা হয়, তবে ধারাবাহিক মূল্যায়নের এসব প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত কাগজে-কলমেই থেকে যাবে। সবাই পরীক্ষামুখী হয়ে হরেদরে যেভাবেই হোক পিইসিতে ভালো করারই প্রস্তুতি নেবে। এরপর আফসোসেরও কিছু বাকি থাকবে না।
● তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক