সব খবরের কাগজে গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে খবরটি। বেতন বাড়ছে প্রাথমিক শিক্ষকদের। কিন্তু খবরটি চরম বিভ্রান্তিকর। কোন হিসাবে গুরুদের বেতন বাড়ছে আর বেড়ে কত হচ্ছে, সে হিসাব মিলছে না কারও। এটা আশ্চর্য যে সহকারী শিক্ষকদের ১৩ থেকে ১১ গ্রেডে উন্নীত করলে মাসে ৮০০ টাকা কমে যাবে। এই টাকা সরকার কেটে নিতে পারবে না যেহেতু, সেহেতু নিদেনপক্ষে এই ৮০০ টাকা ‘ব্যক্তিগত’ বেতন হবে। পরবর্তী ইনক্রিমেন্ট যোগের সময় বঞ্চনা দ্বিগুণ হবে এবং আখেরে পেনশনে লাখ টাকা থেকে বঞ্চিত হবেন একেকজন শিক্ষক। সম্মেলন করে তার বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন শিক্ষক নেতারা।
শিক্ষায় ঘি আর তেল এক দরে বিকানোর অপচেষ্টাও কারও নজর এড়ায়নি। খবরে জানা গেল, সহকারী শিক্ষকেরা একই বেতন পাবেন, ট্রেনিং থাকলে যা, না থাকলেও তা-ই।
বুঝতে অসুবিধা হয় না, এসব সিদ্ধান্ত আসলে সমস্যাকে আড়াল করা, তা আরও জটিল করা, যাতে আন্দোলনকারীরা বিভ্রান্ত হন, বিভক্ত হন এবং ইহজনমেও সে সমস্যার কোনো হিল্লে না হয়। একেই বলে চাণক্য বুদ্ধি।
বাংলাদেশে চাণক্যদের চিনতে কারও বাকি থাকার কথা নয়। জনগণ নয়, যাদের কূটচাল ও কূটকৌশল দুরবস্থা ডেকে আনছে, এরা হলো সেই গোষ্ঠী। হওয়ার কথা সেবক, বনে গেছে মনিব। তারাই সব ভন্ডুল করছে। দেশের মানুষের সব অধিকার খর্ব করার আসল কলকাঠি নাড়ে তারাই।
শিক্ষকদের জন্য খাজাঞ্চিতে টান চিরকালই। কিন্তু ভুয়া প্রকল্প বানিয়ে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে, ক্যাসিনো বসিয়ে দেশ থেকে যাঁরা লক্ষ-কোটি টাকা লুটে বাইরে নিয়ে যাওয়ার রাস্তা বানিয়ে দেন, তাঁরা বড়ই পেয়ারের বান্দা।
সভ্যতার ভিত্তি শিক্ষা। সেটি সাধনার বিষয়। শিক্ষা আর শিক্ষাদান এক নয়। শিক্ষিত হলেই শিক্ষক হওয়া যায় না। শিক্ষকতা একই সঙ্গে পেশা ও ব্রত। ব্রত নিয়ে কথা না-ইবা বললাম। পেশা অর্থ ঠিক জীবিকা নয়, পেশাদারি। অর্থাৎ মনপ্রাণ, সাধ্য, সামর্থ্য উজাড় করে লক্ষ্য সাধনের চেষ্টা; একটি নির্দিষ্ট কাজ করার জন্য বিশেষ দক্ষতা উজাড় করে দেওয়া।
‘মানুষ তার শিক্ষাজীবনের সবচেয়ে মৌলিক আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটি অর্জন করে থাকে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। এখানে তাকে প্রথমেই ভাষার কিছু বিমূর্ত চিহ্ন বা প্রতীক গভীরভাবে আত্মস্থ করতে শেখানো হয়। এটি একজন মানুষের একমাত্র মৌলিক শিখন; মানুষের সারা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে বিস্ময়কর অর্জন। বাকি সব শিখন এবং শিক্ষণ এসব প্রতীকের ওপর নির্মিত হতে থাকে। এর ওপরই নির্মিত হয় শিক্ষা, জ্ঞান, নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং এ রকম সবকিছুর বিশাল, সমৃদ্ধ ইমারত।’ প্রথম আলোর এক পাঠক দোলন এক খবরের প্রতিক্রিয়ায় প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে লিখেছেন কথাগুলো। তাঁর সংজ্ঞায় জাতির ভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষা, আর তার নির্মাতা প্রাথমিক শিক্ষক। কিন্তু এ দেশে সেই আসল কারিগরদের কোন মূল্য নেই, সম্মান নেই, বেঁচে থাকার ন্যূনতম সুযোগ নেই, মর্যাদা নেই!
প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তা অর্জন করতে হয়, লাগাতার প্রচেষ্টায় উন্নত করতে হয়। শিক্ষা হলো জ্ঞান আহরণ, জ্ঞান অর্জন; শিক্ষকতা জ্ঞান বিস্তরণ। অর্থাৎ অর্জিত জ্ঞান অন্যের (এখানে ছাত্র) মাঝে সঞ্চালন করা, সন্দীপন ঘটানো। জ্ঞান সঞ্চালন একটি প্রক্রিয়া, একটি বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়া। তাকে সহজ ভাষায় বলে শিক্ষাবিজ্ঞান। যে বিজ্ঞান জ্ঞান বিতরণ বা সঞ্চালনে সাহায্য করে। শিক্ষাবিজ্ঞান তাই শিক্ষাদানের কৌশল শেখায়। কৌশল শেখাতে গেলে সমস্যা বুঝতে হয়, সমাধানের বিজ্ঞানভিত্তিক উপায় খুঁজতে হয়। শিক্ষাদানের সঙ্গে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক প্রত্যক্ষ। যাকে শেখানো হবে তার বয়স, রুচি, আগ্রহ, সামর্থ্য বুঝতে হয়। এবং সে মতো কৌশল অবলম্বন করলে সাফল্য আসে। কিন্তু শিক্ষাদান সফল হলো কি না, তার মূল্যায়ন দরকার। মূল্যায়ন পরিমাপযোগ্য না হলে অর্থহীন। সেটি একটি গাণিতিক বিজ্ঞান। তা রপ্ত করতে হয়। এ দেশে আমরা পড়ুয়ার জ্ঞানের একটা পরিমাপের চেষ্টা করি; কখনো শিক্ষকের মান পরিমাপ করি না। সেটা যে জরুরি, তা স্বীকারও করি না। ফলে মূল্যায়ন একপেশে, খণ্ডিত ও অকেজো।
শিক্ষকদের বেতন-ভাতার কারিগরি বুদ্ধিদাতারা শিক্ষা এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সেই চাণক্য গোষ্ঠী। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা তারা কতটা ধ্বংস করেছে, এ থেকে তা অনুমান করা সহজ। সরকারের এই সিদ্ধান্ত শিক্ষার গোড়া ধরে টান দিয়েছে। পষ্টাপষ্টি বললে, শিক্ষা ধ্বংসের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকতে চায়। এ চক্রান্ত বুঝতে শিক্ষকদের সামান্য কষ্ট হয়নি। তাঁরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, এ চক্রান্ত তাঁরা সহ্য করবেন না।
দুনিয়ার তাবৎ পেশাজীবী লাগাতার ট্রেনিং নিয়ে সেরা হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে আমলা-কেরানিদের কত নামের, কত রঙের ট্রেনিং, দেশ-বিদেশ সফর হয় তার খবর কেউ জানে না। শিক্ষকদের জন্য তাবৎ বৃত্তি, ট্রেনিং, সফর তাঁরা লোপাট করেন। শিক্ষকের প্রশিক্ষণের কথা উঠলেই তাঁরা হই হই করে ওঠে। বেতন-পদোন্নতির কথা উঠলেই খাজাঞ্চি নাকি শূন্য হয়ে যায়! ন্যায্য দাবি তুললেই পুলিশের লাঠি পড়ে পিঠে। ওদিকে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকে ভাবেন, তাঁরা তো পণ্ডিত, তাঁদের আবার ট্রেনিং কী দরকার? নিজেদের তারা ‘স্বপ্রশিক্ষিত’ ভাবেন। দেশে-বিদেশে কনফারেন্স, সেমিনার করে বেড়ান। তাঁদের আবার পেডাগজি, এন্ডাগজি শিখতে হবে কেন? এমন পাণ্ডিত্যাভিমানীদের ঠেলায় বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষাও ডুবতে বসেছে। তাঁরা যখন বিদেশে কনফারেন্স, সেমিনার কিংবা উচ্চ ডিগ্রি নিতে যান, তখন কি দেখেন না যে, সেসব দেশে সব শিক্ষকের জন্য পেডাগজি, এন্ডাগজি বাধ্যতামূলক? শোনা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের শিক্ষাবিজ্ঞানে ডিগ্রির প্রস্তাব করায় নাকি দেশের মহাপণ্ডিত শিক্ষকেরা তুমুল বাদ সেধেছেন।
কাজেই বোঝা যাচ্ছে, শিক্ষা সম্পর্কে আমাদের দেশের পণ্ডিতদেরও নাক খুব উঁচু। একজন অনেক জানতে পারেন। কিন্তু অন্যকে জানানোর কৌশল যে একটি বিজ্ঞান, তা কি জানেন, মানেন? এমন অদক্ষ শিক্ষক দিয়েই চলছে একুশ শতকে বাংলাদেশের শিক্ষা! শিক্ষার এই গরুর গাড়িতে সওয়ার হয়ে আমরা চন্দ্রজয়ের স্বপ্ন দেখছি!
আমিরুল আলম খান: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।
amirulkhan7@gmail.com