যশোর রোড

প্রাচীন বৃক্ষগুলোর অপরাধ কী

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিজড়িত যশোর রোডের প্রায় আড়াই হাজার শতবর্ষী বৃক্ষ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যশোর জেলা প্রশাসন। এই যশোর রোডেরই ভারতীয় অংশে ঘটেছে উল্টোটা। তারা গাছগুলি মাঝখানে রেখে সড়ক সম্প্রসারণ করেছে। এতদিন চোরাগোপ্তাভাবে বৃক্ষ নিধনের পর এখন প্রকাশ্যেই এত প্রাণ ধ্বংসের লুটপাটের আয়োজন? প্রশ্ন তুলেছেন মোকাররম হোসেন

৭ জানুয়ারি। দৈনিক প্রথম আলোর ছোট্ট একটি সচিত্র খবর-যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক ৪ লেনে উন্নীত করার প্রয়োজনে যশোর রোডের পুরোনো বৃক্ষগুলো কেটে ফেলার পক্ষে মত দিয়েছে জেলা প্রশাসন। খবরটি আপাতদৃষ্টিতে ছোট মনে হলেও এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল মোটেও সুখকর নয়। কারণ, যশোর রোড অন্য দশটি রোডের মতো সাদামাটা কিছু নয়, এর ভেতর লুকিয়ে আছে দীর্ঘ এক ইতিহাস। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় স্মৃতি, বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর সুদীর্ঘ সময়ের যোগাযোগমাধ্যম এবং সর্বোপরি প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার তাগিদ থেকে যশোর রোড এখন আর কোনো আঞ্চলিক সম্পদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি একাধারে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ঐতিহ্য-সম্পদ।

অবিভক্ত ভারতবর্ষে দীর্ঘ এই পথ পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গজুড়ে বিস্তৃত ছিল। পূর্ব থেকে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার একমাত্র আনুষ্ঠানিক সড়কও ছিল এটি। দেশভাগের পর কিছু অংশ ভারতে আর কিছু অংশ পড়েছে বাংলাদেশে। ভারতীয় অংশে গাছের সংখ্যায় খুব একটা হেরফের না হলেও বাংলাদেশ সীমানায় তা স্পষ্টভাবেই দৃশ্যমান। জেলা প্রশাসনের দায়িত্বহীন মতামতের কারণে এত দিন গাছ লোপাটের ক্ষেত্রে কিছুটা লুকোছাপা থাকলেও এখন বাদবাকি গাছের ক্ষেত্রে বিষয়টি বৈধতা পেতে যাচ্ছে! ভাবতেই অবাক লাগছে। বিস্মিত না হয়ে পারি না। সরকারের একটি দায়িত্বশীল সংস্থা কীভাবে এমন একটি ঘৃণ্য ও হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে পারে!

জেলা প্রশাসনের এমন একটি অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত দেশের প্রকৃতিপ্রেমীদের মনে ক্ষোভ ও হতাশার জন্ম দিয়েছে। কারণ, শতোর্ধ্ববর্ষী বৃক্ষহীন যশোর রোড আমাদের চোখের সামনে কেবল বিভীষিকার চিহ্নই এঁকে দিতে পারে। এমন একটি দৃশ্য আমরা কল্পনাও করতে চাই না, যা আমাদের স্বস্তির পরিবর্তে শুধু আতঙ্কিতই করবে। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ বিষয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। ৮ জানুয়ারি প্রথম আলোর সম্পাদকীয় বিভাগেও সড়ক উন্নয়নের বিকল্প প্রস্তাবসংবলিত মতামত ছাপা হয়েছে। জেলা প্রশাসন অতি দ্রুত এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করলে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার কথাও জানিয়েছেন কেউ কেউ।

যশোর রোডের প্রসঙ্গ এলেই বিখ্যাত মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটির কথা মনে পড়ে। গিন্সবার্গ একাত্তরের শেষ দিকে কলকাতা হয়ে যশোর সীমান্তে আসেন শরণার্থী ক্যাম্পগুলো দেখতে। অতিবর্ষণ ও প্লাবনে যশোর রোড তখন পানির নিচে। অগত্যা নৌকা নিয়েই তিনি সেখানে পৌঁছান। শরণার্থীশিবিরে মানুষের দুর্দশা তাঁর মনে দাগ কেটেছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি বিখ্যাত এই কবিতা লিখেছিলেন। পরে কবিতাটি গানে রূপান্তরিত হলে তাঁর মার্কিন গায়ক বন্ধু বব ডিলান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন কনসার্টে গেয়ে শোনান। মুক্তিযুদ্ধ ও এমন একটি আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততাই যশোর রোডের ঐতিহাসিক মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ।

পাঠক, যাঁরা বেনাপোল হয়ে কলকাতা গিয়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই স্মরণ করতে পারবেন, সীমান্তের ওপারে বনগাঁয়ের দিকে গাছের সংখ্যা নিঃসন্দেহে আরও বেশি। বেনাপোলের ওপারে পেট্রাপোল থেকে কলকাতা পর্যন্ত ভারতীয় অংশের এই সড়কটিও কোথাও কোথাও চার লেনের। ওখানে সারিবদ্ধ গাছগুলো রাস্তার সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা গাছগুলোকে সড়ক বিভাজকের মতো মাঝখানে রেখে পাশে আরেকটি সড়ক তৈরি করে নিয়েছে। তাতে দুদিকই রক্ষা পেয়েছে। আমরা কেন তা ভাবতে পারছি না। যশোরের জেলা প্রশাসনের এ খবরটি কি জানা নেই? আমরা তো নানান অজুহাতে ইতিমধ্যেই সড়কটির অনেক গাছ ধ্বংস করেছি। ঠুনকো কারণে কাটা পড়েছে অসংখ্য গাছ। পত্রিকার পাতায় এমন খবর আমরা ঢের দেখেছি।

যশোর শহরের দড়াটানা মোড় থেকে বেনাপোল বন্দর পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার এই মহাসড়কের দুই পাশে রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার গাছ। এর মধ্যে ১৭৪ বছরের পুরোনো যশোরের তৎকালীন জমিদার কালী পোদ্দারের লাগানো তিন শতাধিক মেঘ শিরীষও রয়েছে। বর্তমানে যশোর রোড মানেই এই সব প্রাচীন বৃক্ষের সমাহার। গাছগুলো বাদ দিয়ে সড়কটির অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। তা ছাড়া মহিরুহসম এই বৃক্ষগুলো এখন আর নিরেট বৃক্ষই নয়, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক প্রাণবৈচিত্র্য-পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ ও পরজীবীদের বাঁচা-মরার বিষয়।

আমরা কি ইচ্ছা করলে এমন একটিও বৃক্ষ বানাতে পারব? এমনকি একটি ডালও? ওদের তো পৌনে দুই শ বছরের সঞ্চিত জীবন। একটি তরু শিশু জন্মের পর থেকে প্রায় দুই শ বছরের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছে। বিষয়টি হেলাফেলা করার মতো নয়। আমরা যদি এমন একটি গাছেরও জীবন দিতে না পারি, এমনকি একটি পাতাও বানাতে না পারি, তাহলে প্রাণসংহার করব কোন যুক্তিতে? সাধারণ মানুষের যাতায়াতের সুবিধার জন্য? উন্নয়নের জন্য? তা হতেই পারে, তবে গাছগুলো অক্ষত রেখে। যদি একটি গাছের জন্য কোনো পথ এক কিলোমিটারও ঘুরিয়ে নিতে হয়, তা-ই নিতে হবে। এটাই সভ্যতা। এই একবিংশ শতাব্দীতে আমরা এমন সভ্যতা এবং দূরদর্শিতাই প্রত্যাশা করি। কাজেই জেলা প্রশাসনকে বিকল্প কিছু ভাবতে হবে। একটু মাথা খাটালেই জুতসই কোনো উপায়ও খুঁজে পাওয়া যাবে।

মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক। সাধারণ সম্পাদক, তরুপল্লব।
tarupallab@gmail.com