বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে একসময় সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ছিল ২৫ বছর আর অবসরের বয়স ৫৫ বছর। স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুর দিক থেকে চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ২৭ বছর আর অবসরের বয়স ৫৭ বছর করা হয়। এ অবস্থা প্রায় ২০ বছর ধরে চলে।
১৯৮০-এর দশকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেশনজটের ফলে শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ স্নাতক, বিশেষত স্নাতকোত্তর শিক্ষা ২৭ বছর বয়সের মধ্যে শেষ করতে পারছিল না। বিষয়টি অনুধাবন করে নতুন গণতান্ত্রিক সরকার ১৯৯১ সালে ১৩তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স তিন বছর বাড়িয়ে ৩০ বছরে উন্নীত করে। তখনো অবসরের বয়স ৫৭ বছরই থেকে যায়।
যুক্তিসংগতভাবে ১৩তম বিসিএস দলের এবং এর সমসাময়িক সরকারি চাকরিজীবীদের অবসরের বয়সও তিন বছর বাড়িয়ে ৬০ বছর করা দরকার ছিল। কিন্তু সদাশয় সরকার সম্ভবত এদেশবাসীর গড় আয়ু বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ওই দলের অবসরের বয়স হওয়ার অনেক আগেই ২০১২ সালে দুই বছর বাড়িয়ে অবসরের বয়স ৫৯ বছরে উন্নীত করে; অল্প দিনের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসরের বয়স ৬০ বছর করা হয়।
এই শতাব্দীতে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেশনজট কিছুটা কমায় ধারণা করা যায়, প্রায় সবাই ৩০ বছর বয়সের মধ্যে শুধু স্নাতক নয়, স্নাতকোত্তর শিক্ষাও শেষ করতে পারছেন। কিন্তু শিক্ষিত যুবকদের সংখ্যার তুলনায় কর্মসংস্থানের সুযোগ কম থাকায় চাকরিপ্রার্থীরা কয়েকবার চেষ্টা করার সুযোগ প্রত্যাশা করেন। এরূপ সুযোগ সৃষ্টি করতে সরকারের কোনো অসুবিধা থাকার কথা নয়। চাকরিপ্রার্থী যুবসম্প্রদায় কর্মসংস্থানের আশায় যদি আরও কিছুদিন ছাত্রাবস্থার মতো পড়াশোনা চালিয়ে যায়, তবে পাঠাভ্যাসবিমুখতার এই যুগে তাদের ‘বাধ্যতামূলক’ এই জ্ঞানচর্চাকে তো উৎসাহ দেওয়াই ভালো!
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স কতটা বাড়ানো যায়? বর্তমান ৩০ বছর থেকে এ বয়স দুই বছর বাড়িয়ে ৩২ বছর করা তো খুবই দরকার। তবে চাকরিপ্রার্থী যুবসম্প্রদায়কে খুশি করার জন্য (এবং এ বয়সের বাধা একেবারে উঠিয়ে দেওয়ার প্রলোভন মোকাবিলার জন্য) এ বয়স ৩৫ বছর করার মধ্যেও আমি কোনো সমস্যা দেখি না। যদি অবসরের বয়স যৌক্তিকভাবে অন্তত ৬০ বছরে উন্নীত করা হয়, তবে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ বছর করা হলেও সক্রিয় কর্মকাল স্বাভাবিকভাবে প্রত্যাশিত ২৫ বছর পূর্ণ হতে পারে।
সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়স বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে বোধ হয় বিশেষত জনপ্রশাসন ক্যাডারের সিনিয়র ও জুনিয়র কর্মকর্তাদের মধ্যে মতানৈক্য তৈরি হয়েছে। গত বছর অর্থমন্ত্রীর মতো একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মন্ত্রী মিডিয়ায় বলে ফেলার পরও বয়স বৃদ্ধির বিষয়টি ঝুলে যাওয়ার কারণ নাকি জুনিয়র কর্মকর্তাদের ‘ভেটো’। আর সিনিয়র কর্মকর্তাদের দাবি বোধ হয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এবং উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অবসরের বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অবসরের বয়স ৬৫ বছর করে দেওয়া। সবারই একটি হাদিস মনে রাখা দরকার। তা হচ্ছে, ‘যারা ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না, তারা আমাদের দলভুক্ত নয়।’
আমি এখানে একটি ‘সমঝোতামূলক’ (কম্প্রোমাইজিং) ফর্মুলা প্রয়োগ করতে চাই। এর সপক্ষে আমার যুক্তিগুলোও তুলে ধরছি। আগেই উল্লেখ করেছি, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ১৯৯১ সালে তিন বছর বাড়ানোর সাপেক্ষে অবসরের বয়স ২০১২ সালে দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। আরও এক বছর বাড়িয়ে তা ৬০ বছর করা খুবই যৌক্তিক। চাকরিতে প্রবেশের আগেই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত তিন বছরের সাপেক্ষে সমানভাবে অবসরের বয়স তিন বছর বৃদ্ধিতে কারও কোনো যৌক্তিক আপত্তি থাকার কথা নয়। এতে অবসরের বয়স ‘৫৯’ সংখ্যাটি শুনতে-বলতে ভালো না লাগা থেকেও বাঁচা যায়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের আওতায় করপোরেশনগুলোয় অবসরের বয়স এখনই পূর্ণ ৬০ বছর।
এবার আশা যাক এদেশবাসীর গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৭৩ বছরে উন্নীত হওয়া সাপেক্ষে অবসরের বয়স আরও বাড়ানোর যুক্তির বিষয়ে। মনে রাখা দরকার, সরকারি চাকরি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা এবং বিচারকার্যের মতো নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক পিএইচডি ডিগ্রিধারী এবং শিক্ষার্থীদের পড়ানো ছাড়াও তাঁদের একটি বড় কাজ গবেষণা করে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা। এমনকি যেসব শিক্ষক আনুষ্ঠানিকভাবে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেননি, তাঁরাও গবেষক শিক্ষার্থীদের গবেষণা তত্ত্বাবধান করেন এবং নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে অবদান রাখেন। তাই সব দিক বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের সংস্পর্শে রেখে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা যত দিন গ্রহণ করা যায়, ততই ভালো।
উচ্চ আদালতের বিচারকাজে বিচারপতিরা নিয়োজিত হন বেশ বেশি বয়সে; তাঁদের অর্জিত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা আরও বেশি দিন জাতির কাজে ব্যবহার করাই শ্রেয়। সুতরাং বিচারপতিদের অবসরের বয়স ৬৭ বছর থাকায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয় এবং সে সাপেক্ষে নিজেদের অবসরের বয়স খুব বেশি বাড়ানোর দাবি করাও ঠিক নয়।
সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে বেশ কিছুসংখ্যক ইদানীং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করলেও তাঁদের মূল কাজ গবেষণা বা নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা নয়। তাঁদের প্রধান কাজ সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা। প্রশাসন ক্যাডারের যেসব সদস্য জেলা প্রশাসনে নিয়োজিত, তাঁদের প্রধান হচ্ছেন একজন ডেপুটি কমিশনার, যিনি মাত্র দুটি পদোন্নতিপ্রাপ্ত উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা; বয়স সাধারণত ৪৫ থেকে ৫০ বছর। ডিসিদের একটু তরুণ হওয়াই বাঞ্ছনীয়; কারণ তাঁরা মাঠকর্মী। মাঠের কাজে অনেক দৌড়ঝাঁপ দিতে হয়!
সরকারি চাকরিজীবীদের অবসরের বয়স বেশি বাড়ানোর প্রধান অসুবিধা হিসেবে ওপরে সরকারি চাকরিতে তারুণ্যের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেটি ছাড়াও একটি সামাজিক সমস্যা রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পদবিন্যাস বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো খোলা (ওপেন) বা পরিবর্তনশীল (ডাইনামিক) নয়; এখানকার পদবিন্যাস প্রায় স্থির। বয়োজ্যেষ্ঠদের অবসরে যাওয়ার ফলে এখানে অপেক্ষাকৃত তরুণ চাকরিজীবীদের পদপ্রাপ্তি তথা পদোন্নতির সুযোগ তৈরি হয়। বয়োজ্যেষ্ঠরা দীর্ঘদিন পদ ধরে রাখলে তরুণেরা আরও বেশি দিন পদোন্নতিবঞ্চিত থাকবেন। এতে বয়োজ্যেষ্ঠরা ঘটনাক্রমে বয়ঃকনিষ্ঠদের বিরক্তির কারণ হতে পারেন।
সুতরাং সব দিক ভেবে যুবসম্প্রদায়ের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র ও সময় প্রসারিত করার উদ্দেশ্যে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স যথাশিগগির ৩২ বা ৩৫ বছরে উন্নীত করা দরকার। আর একই সঙ্গে বয়োজ্যেষ্ঠদের সেবা একটি যৌক্তিক বয়স পর্যন্ত পেতে এবং নতুন প্রজন্মের জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে চাকরি থেকে অবসরের বয়স এক বছর বাড়িয়ে ৬০ বছর করাই বাঞ্ছনীয়।
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা, শিক্ষা গবেষক এবং বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার সদস্য
asmolla@ymail.com