এশীয়দের সুখ, তথা ভালো থাকার যে সূচক সংস্থাটি তৈরি করেছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান শেষের দিকে।
এশীয়দের সুখ, তথা ভালো থাকার যে সূচক সংস্থাটি তৈরি করেছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান শেষের দিকে।

প্রবৃদ্ধি আছে, উন্নয়ন আছে, সুখ কোথায় হারাল?

করোনাকালে যেখানে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের প্রবৃদ্ধি মারাত্মকভাবে নেমে গেছে, সেখানে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রেখেছে। এটি আনন্দের কথা। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। সংস্থাটির কান্ট্রি ডিরেক্টর মনমোহন প্রকাশ সম্প্রতি এডিবির প্রতিবেদন প্রকাশকালে বলেছেন, মহামারি থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার পেতে শুরু করেছে। উপযুক্ত অর্থনৈতিক প্রণোদনা ও সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে সরকার অর্থনীতিকে সুসংহত করেছে।

কোনো দেশে প্রবৃদ্ধি বাড়লেই যে মানুষ সুখে-স্বচ্ছন্দে থাকে না, সে কথাটিও মনে করিয়ে দিয়েছেন এডিবির এই কর্মকর্তা। গেল শতকের ষাটের দশকে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক এলান করেছিল যে প্রবৃদ্ধি মানেই উন্নয়ন। হালের অর্থনীতিবিদেরা এ ধারণাকে সেকেলে ও অচল বলে মনে করেন। প্রবৃদ্ধি নয়, জনগণের জীবনযাত্রার মান বাড়লেই বলা যাবে উন্নয়ন হয়েছে। মানুষের মৌলিক যে চাহিদা, যেমন: খাদ্য, বস্ত্র, আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা-পুষ্টির নিশ্চয়তা থাকতে হবে।

বাংলাদেশের মানুষ কেমন আছে, সেটি গুলশান, বনানী ও বারিধারার চাকচিক্য দেখে বোঝা যাবে না। কেননা, এর পাশেই আছে কড়াইল বস্তি। গরিষ্ঠ মানুষের আবাসস্থল, হাটবাজার, গণপরিবহন ও গণসমাবেশস্থলের চেহারা দেখেই অনুমান করা যায়, তারা কতটা সুখে বা দুঃখে আছে। করোনা আমাদের বিবর্ণ সামাজিক চেহারাকে আরও ধূসর করে দিয়েছে।

কোনো দেশে প্রবৃদ্ধি বাড়লেই যে মানুষ সুখে-স্বচ্ছন্দে থাকে না, সে কথাটিও মনে করিয়ে দিয়েছেন এডিবি

এডিবি এশিয়ার ৩০টি দেশের প্রবৃদ্ধির যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে, তাতে বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে আছে। আমাদের থেকে এগিয়ে আছে ভারত, চীন ও মালদ্বীপ। অন্যদিকে, এশীয়দের সুখ, তথা ভালো থাকার যে সূচক সংস্থাটি তৈরি করেছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান শেষের দিকে। ৩০টি দেশের মধ্যে ২৬তম। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধিতে আমরা অনেক এগিয়ে থাকলেও সুখের দিক থেকে বেশ পিছিয়ে আছি। এশিয়ায় সুখের সুচকে এগিয়ে আছে তাইওয়ান। অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে তাইওয়ান পরিচিত। পাশাপাশি তারা সেখানকার মানুষের সুখের দিকেও সমান যত্নবান থেকেছে। সেখানকার মানুষ সুখী। একই কথা প্রযোজ্য ভুটান ও মালদ্বীপের ক্ষেত্রে। দক্ষিণ এশিয়ার এই ছোট্ট দুটি দেশের মানুষ অপেক্ষাকৃত সুখী। পর্যটননির্ভর ভুটানের অর্থনীতি করোনার কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারপরও তারা বাংলাদেশের মানুষের চেয়ে সুখী।

অবশ্য আমরা এই ভেবে কিছুটা তৃপ্তি লাভ করতে পারি যে ভারত, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও আফগানিস্তান থেকে বাংলাদেশে এগিয়ে আছে। এসব দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংঘাত লেগে আছে। তুলনায় বাংলাদেশকে বলা হয় সামাজিক সম্প্রীতির দেশ। তারপরও কেন আমরা সুখী নই? এর কারণ খুঁজতে হলে অর্থনীতির কাঠামোটি বিশ্লেষণ করা দরকার।

ধনী দেশ মানেই সুখী দেশ নয়। ধনসম্পদ বণ্টনে সমতা এলে সুখের অংশীদার হন বেশির ভাগ মানুষ। কিন্তু বাংলাদেশ সমতার চেয়ে অসমতাই বেশি। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর অনেক সমস্যা ছিল। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না। গণতন্ত্রের স্থলে তারা কর্তৃত্ববাদী শাসন চাপিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সম্পদ বণ্টনে একধরনের সমতা ছিল, সবার ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা ছিল। এই সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো যখন ধনবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ল, তখন সাধারণ মানুষের সুখও কমে গেল। চীনের মাথাপিছু জিডিপি গত এক দশকে দ্বিগুণ হয়েছে। যদিও গড়পড়তা সুখের মান বেড়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৪৩ পয়েন্ট। দ্য ইকোনমিস্টের কাছে যে ১২৫টি দেশের তথ্য-উপাত্ত আছে, তাতে দেখা যায়, ৪৩টি দেশে মাথাপিছু জিডিপি ও সুখের সম্পর্ক বিপরীতধর্মী। বাংলাদেশও সেই কাতারে পড়বে।

প্রবৃদ্ধির সুফল সব মানুষের কাছে পৌঁছাতে হলে অবশ্যই একে অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে হবে। বাংলাদেশের ধনবৈষম্যের একটা চিত্র পাওয়া যায় সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসেবে। তাদের খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুযায়ী, দেশে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ পরিবারের আয় প্রায় ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। তাদের মাসিক আয় দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৯৪১ টাকায়। বিপরীতে একই সময় সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে ৫৯ শতাংশ। তাদের মাসিক আয় দাঁড়িয়েছে ৭৩৩ টাকায়, যা ২০১০ সালে ১ হাজার ৭৯১ টাকা ছিল।

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা প্রচার করে আসছেন যে বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। কিন্তু করোনা সংকটের ছয় মাসের মাথায় জনজীবনে যে বিপর্যয় নেমে এল, তাতে অনুন্নয়নের চালচিত্র প্রকটভাবে ধরা পড়েছে। সরকারের উন্নয়ন–কৌশলটা হলো তেলা মাথায় তেল দেওয়া। যাঁরা আছেন সবার পিছে, সবার নিচে, তাঁদের সামনে আনার কোনো চেষ্টা নেই।

বাংলাদেশের অর্থনীতির তিন কারিগর কৃষক, প্রবাসী শ্রমিক ও তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিক (এই খাতের ৭০ শতাংশ শ্রমিকই নারী)। এবারের করোনা কৃষি ও কৃষকের ওপর তেমন বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারেনি। কয়েক বছর ধরে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। বাংলাদেশের কৃষক হলেন সবচেয়ে কষ্টসহিষ্ণু ও ধৈর্যশীল মানুষ। ফসল মার খাক, ঝড় আসুক, খরায় মাঠ পুড়ে যাক, তারপরও তাঁরা আবাদ করবেন। জমি তাঁদের প্রথম ও শেষ আশ্রয়।

তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত। ইতিমধ্যে তারা করোনার ধাক্কা সামলে উঠেছে। গত দুই মাসে তারা ক্রয়াদেশ পেয়েছে স্বাভাবিক অবস্থার চেয়েও বেশি। কিন্তু তাতে এই শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের বিপদ কাটেনি। করোনার দোহাই দিয়ে অনেক কারাখানার মালিক শ্রমিক ছাঁটাই করেছেন, মজুরি বকেয়া রেখেছেন। বাংলাদেশের এক কোটির বেশি মানুষ বিদেশে কাজ করেন। তাঁরা গরিব কৃষক ও শ্রমিকের সন্তান। দেশে কোনো কাজ না পেয়ে কিংবা কাজ থাকলেও ভাগ্যবদলের জন্য বিদেশে গিয়ে রক্ত পানি করে অর্থ উপার্জন করেন। অর্থনীতির চাকা সচল রাখেন। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার স্ফীত করছেন। করোনাকালে তাঁদের অনেকে চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন বা আসতে বাধ্য হয়েছেন। ব্র্যাকের জরিপে দেখা যায়, অভিবাসী কর্মীদের ৮৭ শতাংশেরই আয়ের বিকল্প উৎস নেই। নিজের সঞ্চয় দিয়ে তিন মাস বা তার বেশি সময় চলতে পারবেন, এমন মানুষ ৩৩ শতাংশ। ৫২ শতাংশ বলছেন, তাঁদের জরুরি ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন।

এই যে প্রবাসীরা বিদেশ থেকে দেশে আসছেন, শহরের মানুষ গ্রাম চলে যাচ্ছেন, উভয়ের জীবন-জীবিকা অনিশ্চিত। সরকারের কোনো টেকসই পরিকল্পনা নেই তাঁদের পুনর্বাসন বা কর্মসংস্থানের। গণমাধ্যম দেশের বিভিন্ন জনপদের যে চিত্র তুলে ধরেছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। শহর থেকে গ্রামে ফেরা মানুষের হয়তো মাথা গোঁজার মতো একটা ঘর আছে। কিন্তু আয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। ধারদেনা করে কিছুদিন চলতে পারলেও পরে কী করবেন, তা জানা নেই। অনেক পরিবারই এখন তিন বেলার স্থলে দুবেলা খাচ্ছে। ইউনিসেফ বলছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশে স্বল্প আয়ের মানুষের জীবিকা বন্ধ থাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছে শিশুরা। চা-শিল্পে নিয়োজিত কয়েক লাখ শ্রমিকের জীবনও অনিশ্চিত। অনেক বাগানে মজুরি বকেয়া পড়েছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা (বিআইডিএস) পরিচালিত জরিপ বলছে, কোভিড-১৯-এর কারণে মানুষের আয় কমে গেছে, বেড়েছে বেকারত্ব। যাদের আয় কম, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। সংস্থাটির মতে, করোনার কারণে দেশের ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ৫৯ শতাংশের কাজ আছে, ১৭ শতাংশ করোনার আগেই বেকার ছিলেন আর ১৩ শতাংশ করোনার প্রাদুর্ভাবের পর কাজ হারিয়েছেন।

মুষ্টিমেয় মানুষের সুখের জন্য যে প্রবৃদ্ধি, তাতে অর্থনীতির আকার বাড়লেও কাজ হারানো, বিদেশফেরত শ্রমিক আর প্রান্তিক কৃষকের দুঃখ ঘোচাতে পারে না। সে জন্যই আমরা সমৃদ্ধিতে এগিয়ে থাকলেও পিছিয়ে আছি সুখে। সুখ ও সমৃদ্ধির মধ্যকার এই দ্বন্দ্বের শেষ কোথায়?

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com