প্রবীণ নিবাস নিয়ে নেতিবাচক ধারণা নয়

ধামরাই উপজেলার শৈলান গ্রামে গড়ে উঠেছে হতদরিদ্রদের জন্য প্রবীণ নিবাস
ছবি : লেখক

ফেসবুক লাইভে মাথায় গুলি চালিয়ে ব্যবসায়ী মহসিন খানের আত্মহত্যার সংবাদ আমাদের বিচলিত করেছে। এর আগেও অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমানের মৃতদেহ পাওয়া যায় তাঁর ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে। তিনি তাঁর ফ্ল্যাটে দুই বছর ধরে একাই বসবাস করছিলেন। বৃদ্ধ বয়সটা আসলেই অনেক কষ্টের। এ সময় আলস্য, অসুস্থতা, জরা ও পরনির্ভরশীলতা ব্যক্তিকে গ্রাস করে। ফলে তাঁরা অবহেলা, দুর্নাম ও বঞ্চনার শিকার হন। যার পরিণতিতে ওপরের দুটো ঘটনা ঘটেছে। দরিদ্রদের জন্য এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া আরও কঠিন, কেননা তাঁদের এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার আর্থিক সামর্থ্য নেই। পল্লির বৃদ্ধ ও দরিদ্র নারীদের পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। তাঁদের বেশির ভাগ অবহেলিত এবং প্রায়ই তাঁরা পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নির্যাতিত হন।

এ ধরনের ব্যক্তিদের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা আছে, যা ‘ওল্ড এজ হোম’ নামে পরিচিত। সচ্ছলদের জন্য অর্থের বিনিময়ে, ও দরিদ্রদের জন্য (দানশীল ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে) বিনা মূল্যে এসব প্রতিষ্ঠানে বাসস্থান, পোশাক, আহার, বিনোদন, ব্যায়াম ও চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়। সবচেয়ে বড় কথা, এখানে তাঁরা নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে সমবয়সীদের সঙ্গে জীবন যাপন করতে পারেন।

আমাদের দেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সীমিত। কেননা ওল্ড এজ হোম বা বৃদ্ধাশ্রমের প্রতি আমাদের একটি বিরাগ আছে, যার ভিত্তি ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনুশাসন। আমাদের ইসলাম ধর্মে পিতা–মাতাকে অতীব যত্নে লালন-পালনের জন্য সন্তানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্য ধর্মেও অনুরূপ বিধান আছে। পিতা–মাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩-এ প্রবীণদের দেখভালের দায়িত্ব সন্তানদের ওপর ন্যস্ত করে, প্রতিপালনে ব্যর্থতার জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। নচিকেতার বিখ্যাত গান ‘বৃদ্ধাশ্রম’-এ সন্তানের বিলাসী জীবনযাপনের বিপরীতে পিতা–মাতার বৃদ্ধাশ্রমে করুণ জীবনযাপনের কাহিনি বিধৃত আছে।

বৃদ্ধ বয়সে পিতা–মাতা সন্তান, নাতি-নাতনিদের নিয়ে আনন্দে দিন কাটাবেন, এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না এবং এটাই হওয়া উচিত। কিন্তু সমস্যা বেধেছে বাস্তবতা নিয়ে। যে ছেলে নিজের পরিবারের ভরণপোষণ করতে পারেন না, তিনি কীভাবে পিতা–মাতার ভরণপোষণ করবেন? এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জীবিকার প্রয়োজনে দেশের ভেতরে ও বাইরে অভিবাসন। ছেলেমেয়েকে যদি নিজ গ্রাম বা দেশের বাইরে আবাস গড়ে তুলতে হয় এবং পিতা–মাতাকে যদি সেখানে নেওয়া সম্ভব না হয় বা তাঁরা যেতে না চান, তাহলে সন্তানেরা কীভাবে তাঁদের দেখভাল করবেন?

ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসন ছাড়াও পিতা–মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আরেক ধরনের যুক্তি আছে। তা হলো তাঁরা আমাদের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাই আমাদেরও তাঁদের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। পাশ্চাত্যে এ যুক্তি এখন আর গ্রহণযোগ্য নয়।

ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসন ছাড়াও পিতা–মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আরেক ধরনের যুক্তি আছে। তা হলো তাঁরা আমাদের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাই আমাদেরও তাঁদের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। পাশ্চাত্যে এ যুক্তি এখন আর গ্রহণযোগ্য নয়। সিডনি পঁয়তিয়ে অভিনীত গেস হু ইজ কামিং টু ডিনার ছবির একটি দৃশ্যে কৃষ্ণাঙ্গ পঁয়তিয়ে তাঁর বাবাকে শ্বেতাঙ্গিনীর পাণিগ্রহণের সিদ্ধান্ত জানালে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘আমি তোমাকে বড় করতে মিলিয়ন মাইল ডাকের বস্তা বহন করেছি।’ জবাবে পঁয়তিয়ে বলেন, ‘বাবা, আমি তোমার সন্তান, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি এবং চিরদিন ভালোবাসব। কিন্তু তুমি আমার মালিক নও। তুমি আমার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারো না। তোমার কাছে আমার কোনো ঋণ নেই। তোমার পিতা–মাতা তোমাকে মানুষ করেছেন। তুমি আমাকে করেছ। আমি আমার সন্তানদের মানুষ করব। এটাই পরম্পরা।’ আমাদের সন্তানেরাও ধীরে ধীরে এ ধারণাকে গ্রহণ করছে।

এবার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি। বার্ধক্যের চার সমস্যা নিঃসঙ্গতা, দারিদ্র্য, জরা ও ব্যাধির সমস্যার কিছুটা সমাধানের লক্ষ্যে ঢাকার অদূরে ধামরাই উপজেলার শৈলান গ্রামে আমরা ৮০ শয্যার প্রবীণ নিবাস প্রতিষ্ঠা করেছি। পুরুষ ও নারীদের জন্য এখানে স্বতন্ত্র দুটি উইং আছে। এ নিবাসে আমরা হতদরিদ্র প্রবীণদের বিনা মূল্যে বাসস্থান, পোশাক, আহার ও নিকটস্থ গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের সহযোগিতায় চিকিৎসাসেবা প্রদান করব। শৈলান প্রবীণ নিবাসে বসবাসের যোগ্যতা চারটি, (১) প্রবীণ, অর্থাৎ বয়স ৬০–এর কাছাকাছি হতে হবে; (২) দরিদ্র হতে হবে; (৩) চলাচল করতে সক্ষম হতে হবে: নিজের কাজ, যেমন বিছানা করা, মশারি লাগানো, ঘর পরিষ্কার করায় সক্ষম হতে হবে এবং ৪) ভালো মানুষ হতে হবে, অর্থাৎ ভিক্ষুক, নেশায় আসক্ত, অপরাধসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এখানে গ্রহণ করা হবে না। মনে রাখতে হবে, এটা কোনো হোটেল বা হাসপাতাল নয়। তাই গুরুতর অসুস্থ বা পঙ্গু ব্যক্তিদের এখানে সেবা প্রদানের সুযোগ নেই। তবে নিবাসে অবস্থানের সময় কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে তাঁকে হাসপাতালে ও পঙ্গু হয়ে পড়লে উপযুক্ত সেবা প্রদানে সক্ষম প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করা হবে। অর্থাৎ কোনো বাসিন্দাকেই পরিত্যাগ করা হবে না।

নিবাসটিতে বৃদ্ধদের থাকার উপযোগী সব ধরনের সুযোগ–সুবিধা রয়েছে, যাতে তাঁরা একটি কর্মব্যস্ত অবসরজীবন কাটাতে পারেন। এ ছাড়া তাঁদের পরিবার চাইলে তাঁরা ঈদ, পূজা–পার্বণ, বিয়ে, জন্মদিন ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে আবার প্রবীণ নিবাসে ফিরে আসতে পারবেন। প্রবীণ নিবাসে অবস্থানকালে তাঁদের অভাবগুলো মেটালেও আমরা তাঁদের কোনোভাবেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাই না।

শৈলান প্রবীণ নিবাসের চারতলা ভবন নির্মিত হওয়ার পর আমরা যখন বাসিন্দা নির্বাচনে মন দিয়েছি, তখন দেখা গেল আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছি না। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরসহ বিভিন্ন এনজিওর কাছেও চিঠি লিখেছি। সাড়া না পাওয়ার কতগুলো কারণ আছে, যার মধ্যে প্রধান হলো প্রবীণ নিবাস সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা; যার কারণগুলো আগেই উল্লেখ করেছি। পিতা–মাতাকে দেখতে আর্থিক ও বাস্তবসম্মত কারণে (দেশের ভেতরে ও বাইরে অভিবাসন) দেখতে অসমর্থ হলেও সন্তানেরা তাঁদের পিতা–মাতাকে প্রবীণ নিবাসে পাঠাতে আগ্রহী নয়, পাছে লোকে কিছু বলে। এ ছাড়া দারিদ্র্য মানুষকে সংশয়ী করে তোলে—আজীবন যিনি সমাজ থেকে কোনো সহায়তা পাননি, তিনি বিশ্বাস করতে পারেন না যে কেউ তাঁকে বিনা মূল্যে বাসস্থান, পোশাক, আহার ও চিকিৎসা দেবে। কত দিন দেবে? কেন দেবে? আসল মতলবটা কী?

তাই প্রবীণ নিবাস-সম্পর্কিত নেতিবাচক ধারণা দূর করা জরুরি। এটা পরিবারের বিকল্প কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। পরিবারই হচ্ছে প্রবীণদের জন্য আদর্শ স্থান। এটা কেবল সেসব পরিবারের জন্য, যারা এ দায়িত্ব পালনে নিতান্তই অক্ষম। সরকারকে প্রবীণ নিবাসের নীতিমালা প্রণয়ন করে এসব প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন ও সেবার মান নির্ধারণ করে প্রবীণদের আশ্বস্ত করতে হবে। এটা করা না গেলে দেশের এক উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী ধুঁকে ধুঁকে জীবনপাত করবে। মহসিন খান ও তারেক শামসুর রেহমান তবু তাঁদের সামাজিক অবস্থানের জন্য সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সে সুযোগ নেই।

পরিশেষে শৈলান প্রবীণ নিবাসে অবস্থানের যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন এবং তাঁদের শৈলান প্রবীণ নিবাসে আবাস গ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধকরণে সবার সহযোগিতা কামনা করছি।

  • দিলরুবা কবির চেয়ারপারসন ও ট্রাস্টি, মনোয়ারা ইসলাম–তাজুল ইসলাম ট্রাস্ট এবং উদ্যোক্তা, শৈলান প্রবীণ নিবাস

    Shailanprobeennibash@gmail.com