জনশক্তি

প্রবাসী-আয় যেভাবে বাড়ানো সম্ভব

এমন এক সময় ছিল যখন ভাগ্যে বিদেশ যাওয়া আছে কি না, হাতের রেখা দেখে পরখ করা হতো। এখন বিদেশ যাওয়া ডালভাত হয়ে যাওয়ায় এমনটা কেউ আর করে না। মোটা দাগে বলা যায়, আমাদের ১৬ কোটি জনসংখ্যার প্রায় এক কোটি বিদেশে থাকেন, অর্থাৎ ১৬ ভাগের এক ভাগ আজ প্রবাসী। এই প্রবাসীদের অধিকাংশ অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অদক্ষ শ্রমিক হওয়ায় কম পারিশ্রমিকের কাজ করেন। তবে তাঁরা একাই শ্রম দিতে বিদেশে থাকেন এবং মাস শেষে উপার্জিত অর্থ প্রিয়জনদের জন্য নিয়মিতভাবে দেশে পাঠিয়ে দেন। প্রবাসীদের মধ্যে অপর একটি অংশ সুশিক্ষিত ও দক্ষ হওয়ায় তুলনামূলকভাবে ভালো আয় করেন। কিন্তু এই অংশটির বেশির ভাগ পরিবার-পরিজন নিয়ে বিদেশে থাকেন (যাঁদের অনেকে দেশান্তরী হয়েছেন) এবং তাঁদের অনেককে দেশে অর্থ পাঠাতে হয় না বা পাঠালেও কদাচিৎ। তাই মূল রেমিট্যান্সের ধারাটি অব্যাহত আছে নিম্ন আয়ের প্রবাসীদের দ্বারা।
গত বছর প্রবাসীরা ১ হাজার ৪২২ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন। উল্লিখিত নিম্ন আয়ের প্রবাসীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে এই পরিমাণ অর্থ দেশে এসেছে। তাই নিম্ন আয়ের এই প্রবাসীদের আয় যদি দেড় থেকে দ্বিগুণ করা যেত, তবে বছরে আমাদের আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স আসত। এটা সম্ভব কি না, যাচাই করার জন্য এশিয়ারই অন্য একটি দেশের দ্বারস্থ হব।
১০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ফিলিপাইনের প্রায় এক কোটি লোক বিদেশে থাকেন, অর্থাৎ দশ ভাগের এক ভাগ প্রবাসী। তাই বলা চলে, বাংলাদেশ ও ফিলিপাইনের প্রবাসী সংখ্যায় বড় ব্যবধান নেই। অথচ গত বছর বাংলাদেশি প্রবাসীরা যখন দেড় হাজার কোটি মার্কিন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, তখন একই সময়ে ফিলিপিনোরা পাঠিয়েছেন ২ হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার। প্রায় সমসংখ্যক লোক বিদেশে থাকলেও ফিলিপিনোদের রেমিট্যান্স প্রায় দ্বিগুণ হওয়ার কারণ হচ্ছে:
(১) ফিলিপিনোরা যে যাঁর কাজে অত্যন্ত দক্ষ। পেশাগত এই দক্ষতা অর্জন তাঁরা বিদেশে পাড়ি জমানোর আগে দেশের মাটিতেই করে থাকেন। তবে কাজ করে করে আরও দক্ষতা অর্জন করা যেকোনো মানুষের সহজাত বিষয়।
(২) ফিলিপিনোরা কমপক্ষে সেকেন্ডারি স্কুল পাস করা এবং ইংরাজিতে দক্ষ। এই দক্ষতার নিয়ামকগুলো হচ্ছে: (ক) ফিলিপাইনের স্কুলগুলোতে ইংরেজি পড়া, লেখা, শোনা ও বলা—এই চার দিকই গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়। যেমন, ইংরেজি ক্লাসের সময় শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার জন্য মাতৃভাষায় কথা বলা নিষেধ। (খ) ম্যানিলাসহ দেশের সব শহর-বন্দর-গ্রামের বিজ্ঞাপন, নির্দেশনা সবটাই ইংরেজিতে। যেমন, গ্রামগঞ্জের যত্রতত্র ধানের জমিতে ট্রেসপাসিং ইজ স্ট্রিকলি প্রহিবিটেড (অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ) লেখাটি প্রায়ই চোখে পড়ে। লক্ষণীয় যে নিরেট গ্রামে হলেও বিজ্ঞাপনটি মাতৃভাষা তাগালোগে নয়, বিদেশি ভাষা ইংরেজিতে। মহাসড়কের ট্রাফিক-সংক্রান্ত নির্দেশনাগুলো সবই ইংরাজিতে লেখা। যেমন নো লোডিং অর আনলোডিং, অর্থাৎ লোক, মালামাল ওঠানো–নামানো নিষেধ। পাবলিক মোটরগাড়ির পেছনে দেখা যায়, হাউ ইজ মাই ড্রাইভিং (আমার গাড়ি চালানোয় আপনার কোনো সমস্যা হচ্ছে কি) এবং সঙ্গে অভিযোগ করার মতো একটি যোগাযোগের নম্বর। অফিসের দরজায় চোখে পড়ে ‘নো ভ্যালিড আইডি, নো এন্ট্রি’ (বৈধ পরিচয়পত্র ছাড়া ঢোকা নিষেধ)। এসব লেখা বারবার চোখে পড়ায় তা ‘ন্যাচারাল’ বইয়ের মতো কাজ করে, যা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন জনতা মাত্রেরই ইংরেজি চর্চা সমুন্নত রাখে। (গ) পরিবারে ভাইবোন ইংরেজিতে বা তাগালোগ ও ইংরেজির সংমিশ্রণে কথা বলেন, যেন তাঁরা বিদেশে গিয়ে ইংরেজি ভাষায় স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলতে পারেন।
(৩) ফিলিপিনোরা অত্যন্ত ঠান্ডা মেজাজের। উগ্র মেজাজ দেখানো বা দেশের বদনাম হতে পারে, এমন কোনো কাজ তাঁরা সহজে করেন না। কর্মস্থলে ওপরের বা সমপর্যায়ের যে কাউকে খুব সহজে স্যার, ম্যাডাম সম্বোধন করে আনুগত্য প্রকাশ করেন। অন্যের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে গিয়ে সহনশীলতার পরিচয় দেন। খুব সহজে অন্যের বন্ধু হয়ে যান।
এভাবেই ফিলিপিনোরা পেশাগত দক্ষতা ও ভালো ইংরেজি জানার কারণে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে বিদেশে সুনাম অর্জন করেছেন এবং একই কর্মক্ষেত্রে একজন বাংলাদেশির চেয়ে অনেক বেশি পারিশ্রমিক পান। জেদ্দা, দুবাই বা কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের প্রায় সবাই যখন বিদেশি, তখন একজন ফিলিপিনোও সেখানে দেখা যায় না। কারণ বেশি মূল্যে তাঁদের অন্যত্র চাহিদা আছে। এমনকি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপালের লোকজনও খুব কম দেখা যায়। কম পারিশ্রমিকে বাংলাদেশিরা কষ্টের কাজ করতে বাধ্য হন পেশাগত ও ভাষার দক্ষতা না থাকার কারণে। তবে কষ্টের কাজগুলোও কারও না কারও করতে হবে। সে জন্য অত্যন্ত উচ্চ হারে পারিশ্রমিক পাওয়ার কথা। সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের পারিশ্রমিক ওই দেশের সরকারপ্রধানের চেয়ে বেশি, এমন দেশ এশিয়াতেই আছে।
ফিলিপিনোদের মতো পেশাগত দক্ষতা অর্জন করা বাংলাদেশিদের পক্ষেও সম্ভব। যেমন একজন ধান, সবজি, ফলচাষি যদি দেশে তিন থেকে পাঁচ বছর কাজ করেন, তবে তাঁর এ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করার কথা। তেমনি রাজমিস্ত্রি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, প্লাম্বিং মিস্ত্রি, মোটর ড্রাইভিং, মেকানিকসসহ এমন হাতের কাজ করার ক্ষেত্রেও। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা পেলে মধ্যপ্রাচ্যে ভালো পারিশ্রমিকের কাজ যেমন সেবিকা, এয়ার ক্রু, হোটেল, বিমানবন্দর, এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনার কাজে বর্তমানে কদাচিৎ দেখা পাওয়া বাংলাদেশিরা সংখ্যাধিক্যে পরিণত হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে এসব ক্ষেত্রে দিনে দিনে প্রসার বাড়ছে।
বাংলাদেশে শিক্ষা কার্যক্রমে ইংরেজি ভাষাটি মাতৃভাষা বাংলার সঙ্গে সমানতালে শেখানোর অন্যতম কারণ পৃথিবীব্যাপী ইংরেজি ভাষার গ্রহণযোগ্যতা। মার্কিন ডলার, ইংরেজি ভাষা ও পাসপোর্টে একটি বৈধ ভিসা থাকলে বিদেশে বসে আত্মবিশ্বাসের পারদ ঊর্ধ্বমুখী থাকে। তবে ইংরেজি শিক্ষায় পড়া, লেখা, শোনা ও বলা—এই চার দিকেই সমান গুরুত্ব দেওয়া দরকার। তাহলে এমনকি যারা পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণিতে ঝরে পড়ছে, তারাও কর্মজীবনে ইংরেজির দক্ষতা বাড়াতে পারবে। শুধু বিদেশের জন্য নয়, দেশেও বিদেশিদের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় ইংরেজিতে যোগাযোগ করতে সক্ষম গাড়ি ভাড়া দেওয়ার প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমন গাড়িচালক ও তৈরি পোশাকের বায়ার হাউজগুলোতে এমন দক্ষÿ কর্মীর কদর বাড়ছে।
ভাষা ও পেশাগত দক্ষতা ছাড়াও সবুজ পাসপোর্টধারী বাংলাদেশিদের পাসপোর্টের মর্যাদা রক্ষায় প্রয়োজন আত্মসম্মানবোধের। অবৈধ উপায়ে সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়ায় যেতে চাওয়া আর থাইল্যান্ডের বনজঙ্গলে আশ্রয় নেওয়া লোকজনকে কে কত মূল্য দিতে চাইবে! কোটি টাকা কুড়িয়ে পেয়ে প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দিয়ে অনেক দেশে বাংলাদেশিরা যেমন সুনাম অর্জন করেছেন, আবার সবুজ পাসপোর্টের দিকে বাঁকা চোখে তাকানোর দেশ এশিয়াতেই অনেক আছে। উগ্র বা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ আমাদের পুরো জাতির ওপর কলঙ্ক বয়ে আনে। কারণ একেকজন বাংলাদেশি বিদেশের মাটিতে আলাদা একক ব্যক্তি নন, বরং একেকজন রাষ্ট্রদূত।
আলী আকবর মল্লিক: কাঠামো প্রকৌশলী, ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটির সাবেক মহাসচিব। কম্বোডিয়ার নমপেনে কর্মরত।