প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন দূরদর্শী নেতা। প্রমত্ত পদ্মা নদীর ওপর সেতু একটি নির্মাণ তাঁর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন দূরদর্শী নেতা। প্রমত্ত পদ্মা নদীর ওপর সেতু একটি নির্মাণ তাঁর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন।

প্রধানমন্ত্রীর সততা ও সাহসিকতার প্রতীক পদ্মা সেতু

১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, তখন বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের দরিদ্রতম দশটি দেশের একটি। ৮৮ শতাংশ মানুষ ছিল দরিদ্র। বৈদেশিক সাহায্যের নির্ভরতাও ছিল ৮৮ ভাগ। বাংলাদেশ টিকে থাকবে কি না, এ নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, বাংলাদেশ হলো ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র দেশ। বঙ্গবন্ধু ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে শূন্য হাতে সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮) প্রণয়নের দ্বিতীয় বছরে ১৯৭৪-৭৫ সালে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বাংলাদেশের জিডিপি ৯ দশমিক ৫৯ শতাংশে উন্নীত হয়, যা আজও রেকর্ড। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সামরিক ও আধা গণতন্ত্রী শাসকেরা স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতার অংশীদার করে দীর্ঘ ২১ বছর ধরে দেশ শাসন করে। তাদের আমলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কখনোই ৪ থেকে ৫ শতাংশের ওপরে ওঠেনি।

কিন্তু আমরা যদি ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্র পরিচালনার সময়কে বিবেচনায় নিই, তাহলে কী দেখতে পাই? বঙ্গবন্ধুর পরে অর্থনীতি, উন্নয়নসহ সব ক্ষেত্রকে তিনি ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। দেশকে পৌঁছে দিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়। ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ, যা কোভিড-১৯ মহামারির আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ৮ শতাংশের ওপর। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ৪১তম অর্থনীতির দেশ। বিশ্বের কাছে উন্নয়নের বিস্ময়। বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নয়ন অভিযাত্রায় এবার বিশ্বের কাছে বিস্ময় জাগানো আরও মাইলফলক অর্জন যোগ হতে যাচ্ছে ২৫ জুন। এদিন প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন। এটি শুধুই একটি সেতু নয়; এটি একদিকে যেমন একসময়ের ৮৮ ভাগ বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার ইতিহাস সৃষ্টির সেতু, অন্যদিকে তেমনি ষড়যন্ত্র ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সাহস ও সততার উদাহরণ সৃষ্টির সেতু। এ নিবন্ধের অবতারণা পদ্মা সেতু নির্মাণকে ঘিরেই।

২০১৫ সাল থেকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়। এ নির্মাণযজ্ঞ চলার মধ্যেই কানাডার ফেডারেল কোর্টের রায়ে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। সরকার সাত বছরে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়। অর্থনীতিবিদসহ অনেকেই বলেছিলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে বাংলাদেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন দূরদর্শী নেতা। প্রমত্ত পদ্মা নদীর ওপর সেতু একটি নির্মাণ তাঁর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন। কারণ, পদ্মা সেতু নির্মিত হলে তা শুধু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটাবে না, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখবে। কৃষি, শিল্প, অর্থনীতি, শিক্ষা, বাণিজ্য—সব ক্ষেত্রেই এ সেতুর বিশাল ভূমিকা থাকবে। সমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে উঠবে। এ অঞ্চলকে ট্রান্সএশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্সএশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত করবে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে আন্তর্জাতিক কানেক্টিভিটি প্রতিষ্ঠিত হবে। মোংলা বন্দরের গুরুত্ব বেড়ে যাবে বহুগুণ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পর্যটনসহ শিল্পের প্রসার ঘটবে। পদ্মার দুই পারে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই নগরীর আদলে শহর গড়ে উঠবে। বিশ্বব্যাংকের স্বাধীন পরামর্শক এবং সেতু বিভাগের নিয়োজিত পরামর্শক সংস্থার সমীক্ষা থেকেও জানা যায় পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে। সমীক্ষায় বলা হয়, পদ্মা সেতু নির্মিত হলে জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। এ ছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ২ দশমিক ৩ শতাংশ।

১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন সরকার যাত্রা শুরু করে। অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অগ্রাধিকার তালিকায় স্থান পায় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের পদ্মা সেতু। ১৯৯৯ সালে পদ্মা সেতুর প্রাক্‌-সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

পরিতাপের বিষয়, পদ্মা সেতু প্রকল্পের বাস্তবায়নের শুরু সরল পথে হয়নি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এ সেতুর বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করে। বিশদ সমীক্ষার পর ২০০৪ সালে জাইকা মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতু নির্মাণের সুপারিশ করে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ায় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। তারা বিশদ সমীক্ষার আলোকে পদ্মা সেতু প্রকল্প একনেকের সভায় পাস করেনি। এর কারণ ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন। প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু নির্মাণে এতটাই আগ্রহী ছিলেন যে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে পদ্মা সেতু নির্মাণ অঙ্গীকার আকারে অন্তর্ভুক্ত করেন। দেশের মানুষের সৌভাগ্য, ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। তিনি আবারও পদ্মা সেতু নির্মাণ অগ্রাধিকার দিয়ে এর বাস্তবায়ন দ্রুততর করার উদ্যোগ নেন।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পদ্মা সেতু প্রকল্প দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংক অভিযোগ করে, তারা পদ্মা সেতু প্রকল্পে ‘বিশ্বাসযোগ্য’ দুর্নীতির ষড়যন্ত্র খুঁজে পেয়েছে, উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ অভিযোগের ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং বিশ্বব্যাংককেই অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করতে বলেন। বিশ্বব্যাংক কানাডীয় এসএনসি-লাভালিনের বিরুদ্ধে কানাডীয় রয়্যাল মাউন্টেড পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করে। পরবর্তী সময়ে কানাডীয় আদালতে একটি মামলা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালের ২৯ জুন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিল করেন। প্রশ্ন হলো, যে প্রকল্প ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগ, এর বাস্তবায়নে তো একটি টাকাও ছাড় করা হয়নি।

পুনরায় ঋণ পেতে বিশ্বব্যাংক সরকারকে একের পর শর্ত দিতে থাকে। বিশ্বব্যাংকের দাবি অনুসারে সরকার সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তারের দাবি তোলে এবং তাঁকে কারাগারে যেতে হয়। তিনি চাকরিও হারান। প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমানকে ছুটিতে যেতে হয়। কিন্তু এত কিছুর পরও বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণসহায়তা পাওয়ার ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি।

এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর অবস্থান নেন, তিনি ২০১২ সালের জুলাইয়ে জাতীয় সংসদে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। এটি ছিল সময়োপযোগী সাহসী উচ্চারণ, যা দেশ-বিদেশে সব মহল কর্তৃক সমাদৃত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে ৩১ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট এবং এডিবি, জাইকা ও আইডিবিকে লেখা দুটি পত্রে পদ্মা সেতু প্রকল্পে তাদের অর্থায়নের প্রয়োজন নেই বলে সরকারের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন।

২০১৫ সাল থেকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়। এ নির্মাণযজ্ঞ চলার মধ্যেই কানাডার ফেডারেল কোর্টের রায়ে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। সরকার সাত বছরে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়। অর্থনীতিবিদসহ অনেকেই বলেছিলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে বাংলাদেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু তা হয়নি। প্রকৃত সত্য হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তা, সাহস ও সততার কাছে ষড়যন্ত্র পরাভূত হয়েছে। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা প্রমাণিত হয়েছে। দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। তাই পদ্মা সেতু কেবলই একটি সেতু নয়, এটি জননেত্রী শেখ হাসিনার সততা ও সাহসিকতার প্রতীক।

জুনাইদ আহমেদ পলক সংসদ সদস্য এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী
me@palak.net.bd