ভূমিকম্প

প্রথম প্রস্তুতি ভূমিকম্পসহনীয় ভবন নির্মাণ

এবার ২৬ অক্টোবর আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে ২৫০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে হিন্দুকুশ অঞ্চলে রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভূমিকম্পটি ভারতকেও কাঁপিয়েছে। এ বছরের ২৫ এপ্রিল নেপালে রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পটি নেপালের সঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশের জনগণকেও নাড়া দিয়েছিল। পার্শ্ববর্তী দেশে ভূমিকম্প হলে আমরা খানিকটা নড়েচড়ে বসি। কারণ ভারত, নেপাল ও মিয়ানমারে ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশকেও বড় তীব্রতায় কাঁপাতে পারে। যেমন ১১৮ বছর আগে ১৮৯৭ সালে আসামে রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প ঢাকাকে ৭-এর অধিক তীব্রতায় কাঁপিয়েছিল। এমন একটি ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তি হলে আমাদের ভবনগুলো টিকবে কি না, ভাবা দরকার।
ভূমিকম্পের সময় দৌড়ঝাঁপ করে উঁচুতলা ভবন থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা ইতিবাচক ফল দেয় না। বরং আতঙ্ক সৃষ্টি হয়ে পিষ্ট হওয়ার আশঙ্কা অধিক। সে জন্য একটি বড় তীব্রতার ঝাঁকুনি সহ্য করে টিকে থাকতে পারে এমন ভবনে বাস করা অপরিহার্য। দেশের মানুষ ফ্ল্যাট কিনে শহরে একটি স্থায়ী ঠিকানার ব্যবস্থা করছে, যা পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও অপরিবর্তিত থাকবে বলা যায়। ফ্ল্যাটগুলো তৈরি করছে দেশের ছোট-বড় কয়েক হাজার ডেভেলপার। এই ডেভেলপারদের রিহ্যাব নামে একটি সংগঠন আছে, কিন্তু ফ্ল্যাট ক্রয়কারীদের কোনো সংগঠন নেই। এমনকি একটি ভবনের ফ্ল্যাট ক্রয়কারীদের মধ্যে ক্রয়কালীন পরিচয়ও থাকে না। সুতরাং ভবনের নকশা, কাঠামোর ডিজাইন, ভবন নির্মাণ হওয়াকালীন তাঁরা ভালো-মন্দ যাচাই করার সুযোগ পান না। ফ্ল্যাট ক্রয়কারীদের এই দুর্বল দিকটি রাজউক দেখতে পারে। রাজউক একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে টেন্ডারের মাধ্যমে প্রয়োজনীয়সংখ্যক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন করতে পারে, যাদের ভূমিকম্পে সহনশীল ভবনের নকশা ও কাঠামো বিশেষজ্ঞ স্থপতি ও প্রকৌশলী থাকবে। বিশেষজ্ঞ তৈরি করতে রাজউক ও রিহ্যাব যৌথভাবে প্রতিবছর ওয়ার্কশপের আয়োজন করতে পারে। রাজউকে নিবন্ধিত হতে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানে এই ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণকারী স্থপতি ও প্রকৌশলীরা থাকবেন।
নকশা অনুমোদন, ভবন নির্মাণ ও ফ্ল্যাট হস্তান্তর—এই তিন স্তরে ডেভেলপার কর্তৃক রাজউক নিবন্ধিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে। ফ্ল্যাট ক্রয়কারীরা বায়না করা বা কেনার সময় এই ছাড়পত্র দেখে কিনবেন। তিনবারের এই সার্ভিসের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ফি রাজউক নির্ধারণ করবে। যেমন ১৫০০ বর্গফুটের ২০-টি ফ্ল্যাট থাকা ভবনের এই ফি প্রতি বর্গফুট ২০ টাকা হারে (উদাহরণস্বরূপ) হয় ছয় লাখ টাকা। অর্থাৎ, একটি ফ্ল্যাট ক্রয়কারীকে মাত্র ৩০ হাজার টাকা বাড়তি খরচ করতে হবে। যেসব ভবন ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে আছে, সেসব ভবনের ক্ষেত্রেও উল্লিখিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠানই ভূমিকম্প সহনশীলতা যাচাই করে ঘাটতি পাওয়া গেলে ভবনের কোন কাঠামো কতটা শক্তিশালী করতে হবে, তা নির্ধারণ করবে, যা প্রকৌশলের ভাষায় রেট্রোফিটিং। জটিলতার কারণে রেট্রোফিটিংয়ের সময়কালে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের নজরদারি থাকতে হবে। তৈরি হওয়া ভবনের বিষয়ে রাজউক একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে ফ্ল্যাটের মালিকদের ভবন রেট্রোফিটিং করার জন্য সচেতন করবে। যে ডেভেলপার দিয়ে ভবনটি নির্মিত হয়েছিল, তাদেরও ভূমিকা থাকবে।

>ভারী ইট ভবনের ওজন বাড়িয়ে দেয় বলে ভূমিকম্পে ভবন বিধ্বস্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়। ভূমিকম্পের মুহূর্তে একটি ভবনের বড় শত্রু তার নিজের ওজন। এ জন্য রড ব্যবহারের সুযোগ থাকা হালকা হলোব্রিক ব্যবহার করা যেতে পারে

ঢাকায় খাল-বিল-ঝিল ভরাট করে তৈরি হওয়া ভবনগুলো ভূমিকম্পে অতিশয় ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, মাটি ভরাটের সময় পুরকৌশলের নির্দেশনা অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রেই মাটির কমপ্যাকশনের কাজটি করা হয় না। এসব ভবনের ফাউন্ডেশনে ৫০ থেকে ১০০ ফুট গভীর কংক্রিট পাইল নির্মাণ করা হয়; যার সংখ্যা, দৈর্ঘ্য ও ব্যস নির্ণয়ে উলম্ব দিকে ভবনের ভরকে হিসাবে নেওয়া হয়। এই ভর উলম্ব দিকে সব সময়ের জন্য কাজ করলেও ভূমিকম্পের শক্তি কাজ করে পার্শ্বদিকে। পার্শ্বদিকে কাজ করা এই শক্তি ঠেকাতে মাটির পর্যাপ্ত কর্তনীয় পীড়ন সহ্য করার ক্ষমতা থাকা দরকার, যা পুরকৌশলের নির্দেশনা অনুসারে হতে হবে।
এ ছাড়া বাংলাদেশে ভবন নির্মাণে যে ইট ব্যবহার করা হয়, তা ভূমিকম্পবান্ধব নয়। এই ইটগুলো ভারী এবং বালু-সিমেন্টের মর্টার দিয়েই যতটুকু আটকানো যায়, কিন্তু সেখানে রড ব্যবহারের সুযোগ নেই। ভারী ইট ভবনের ওজন বাড়িয়ে দেয় বলে ভূমিকম্পে ভবন বিধ্বস্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়। ভূমিকম্পের মুহূর্তে একটি ভবনের বড় শত্রু তার নিজের ওজন। এ জন্য রড ব্যবহারের সুযোগ থাকা হালকা হলোব্রিক ব্যবহার করা যেতে পারে। বাংলাদেশের জন্য উপযোগী হলো, ব্রিক নির্ধারণে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে।
১৯৯৫ সালের ১৭ জানুয়ারি জাপানের নৌবন্দর বা বাণিজ্যিক শহর কোবের ২০ কিলোমিটার দূরে রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্প ঘটে। ভূমিকম্পটি ঘনবসতিপূর্ণ কোবে শহরে সর্বোচ্চ তীব্রতায় লয়-প্রলয় ঘটায়। অথচ লোক মারা যায় ৬ হাজার ৪৩৪ জন, যা ছিল টেকসই ভবন ও সচেতনতার ফল। হাইতিতে ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ৩ লাখ ১৬ হাজার লোক মারা যায়। চিলিতে ২০১০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে মারা যায় ৫২৫ জন। অথচ চিলির ভূমিকম্পটি হাইতির থেকে ৫০১ গুণ শক্তিশালী ছিল। ক্ষয়ক্ষতি কম হওয়ার কারণ, চিলির প্রস্তুতি ও সচেতনতা হাইতির চেয়ে অনেক বেশি ছিল। এভাবে দেখা যায়, ভূমিকম্পে প্রস্তুতি ও সচেতনতা জানমাল ক্ষয়ের পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারে। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দৌড়ঝাঁপ করে লাভ হয় না, যদি না নিজের বাসভবনটি বড় তীব্রতার ঝাঁকুনি সহ্য করার শক্তি রাখে।
ড. আলী আকবর মল্লিক: কাঠামো প্রকৌশলী, ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটির সাবেক মহাসচিব।