কয়েক দিন আগে ‘প্রথম আলো অনলাইনে’ আমি ২৫ মিনিট ছিলাম। প্রথম আলোর ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজে প্রায় দেড় কোটি শ্রোতা-দর্শক। আমি জীবনেও ভাবিনি এত লোক আমাকে একসঙ্গে দেখার সুযোগ পাচ্ছে। তাহলে আরও ভালো পাঞ্জাবিটা পরতাম, গালে একটু পাউডার ঘষতাম, চুলটাও আঁচড়াতাম ভালো করে, যদিও মাত্র কয়েকটি অবশিষ্ট রয়েছে।
আমার উত্তেজনা দেখে কে? আমার আলোচ্য বিষয় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ১১ জ্যৈষ্ঠ নজরুলের জন্মদিন উপলক্ষে। সে তো আমার নিজের আয়ত্তের মধ্যেই। যা বলব, তাই হবে নতুন। কিন্তু আমি ভাবছি নতুন এই গেজেটের কথা। মাত্র একটি মোবাইলে সারা পৃথিবীকে আমার বক্তৃতা শোনাতে পারি। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ইতিমধ্যে বেশ কয়েক হাজার মানুষ আমার আবৃত্তি করা ‘শেষ বসন্ত’ [আজিকার দিন না ফুরাতে, হবে মোর এ আশা পুরাতে] মন দিয়ে দেখেছে।
তাহলে এখন আর বড় বড় জনসভার প্রয়োজন নেই। আমি একাই বক্তা, একাই সঞ্চালক, একাই বোতাম টিপে সমস্ত পৃথিবীর লোককে আমার বক্তব্য জানাতে পারি। ‘প্রথম আলো অনলাইনে’ যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা সবাই নবীন। আমার ইচ্ছে করছিল ওঁদেরই একটি টেবিল অধিকার করতে, যাতে আমি সহজেই সব রকমের কলকবজা বুঝে নিতে পারি। সত্যি বলতে কি, আমার এই দিনের অভিজ্ঞতা আমাকে সঞ্জীবিত করেছে। যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা এত আনন্দের সঙ্গে কাজ করছেন যে বলার নয়। সবচেয়ে বড় তাঁদের কাজ করার স্বাধীনতা। আমি জানি, আমার সুযোগ রোজ রোজ হবে না। কিন্তু যেহেতু নজরুলের অধিকাংশ খবর আমার কাছে, আমি কয়েকটি বই লিখেছি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য তাঁর ওপর রচিত প্রথম উপন্যাস পুড়িব একাকী, তাই আমার ডাক আবার আসবে। আমার বাবার সবগুলো গানের ইতিহাস আমার জানা। সেগুলো লিখে ফেলেছি। এখন প্রতিদিনের বক্তৃতায় আমি জগৎকে সব জানাবার জন্য প্রস্তুত।
অনলাইনে এত মজার মজার কথা হয় যে বলার নয়। যেমন, আমাকে বলা হলো, আপনার বাবার গাওয়া প্রথম গানটি মনে আছে? সঙ্গে সঙ্গে গেয়ে দিলাম পুরোনো ঢঙে, ‘কোন বিরহীর নয়ন জলে বাদল ঝরে গো’। এক গানে সমস্ত কলকাতার লোক মেনে নিল বাংলার সংগীত জগতে প্রথম মুসলিম গায়কের নাম। আব্বা নজরুলকে বলে লিখিয়ে নিলেন, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’। সঙ্গে সঙ্গে গানটি গেয়ে শোনালাম। আর ওর মধ্যে যে গল্পটি, সেটিও। কত দিনের কত গল্প। এখন আর লোকে কাগজ কিনবে না, কিনলেও পড়বে না। পড়ার সময় নেই। জীবন অনেক দ্রুত এগিয়ে চলেছে।
আমি সামান্য লেখক। অনেকগুলো বই লিখে নানা লাইব্রেরিতে দান করেছি। সেগুলোও কেউ পড়বে না। অথচ অনলাইনে আমি প্রায় হিরোর পর্যায়ে। আমাকে অনেকে দেখে এখন চিনতে পারে। আরে, ওই লোকটা না, যে হাসতে হাসতে লোকের দম ফাটায়। এ ব্যাপারে অবশ্য আমি কারও প্রতিদ্বন্দ্বী নই। যদি হাসির কথায় হাসি আসে, তাহলে নিশ্চয়ই হাসবেন, আর কান্নার কথায় কান্না হলে, জানবেন ওটিই ছিল আমার শ্রেষ্ঠ কথা। বেদনার গানই সবচেয়ে সুমধুর। প্রথম আলো আমাকে সব সময়ই নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করে, যা আমার জীবনে আনে একটা ফুরফুরে ভাব। যে ভাবে আমার এত কিছু লেখা। আমার ভাই আমার চেয়ে খুব ভালো লিখতেন। কিন্তু তাঁর মনটি আমার মতো ফুরফুরে ছিল না। কারণ প্রধান বিচারকের অনেক দায়িত্ব। আমার কোনো দায়িত্ব নেই। আমার দায়িত্ব শুধু মানুষকে ভালোবাসা, সব মানুষকে বুকে জড়িয়ে ধরা, সব ধর্ম ও মতের ওপরে উঠে মানুষকে মানুষ বলে অধিকার দেওয়ার। প্রথম আলো আমাকে অনেক শিখিয়েছে। আমি তার ঋণ স্বীকার করলাম।
আমার সব লেখাই বই আকারে ছাড়া হয়েছে। সবগুলোই বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু যা বিক্রি হয়নি, তা এখনো লেখাই হয়নি। আমি সারা দিন বই লেখার স্বপ্ন দেখি, যেটি হবে আমার শ্রেষ্ঠ বই, যেটি কখনো নোবেল হাতড়াবে না, পৌঁছে যাবে তাদের কাছে, যারা এখনো লেখাপড়া শেখেনি, যারা এই জীবনযাপনের অর্থই শেখেনি, প্রভুকে চেনেনি, প্রভু যে সঙ্গেই আছেন, তাও বুঝতে পারেনি। সবার জন্য যে হৃদয় সব সময় উন্মুক্ত, সেই হৃদয়েই প্রভু বাস করেন। আমি গান করি বলে, মসজিদে আমার সহযাত্রীরা আমার দিকে কটাক্ষের দৃষ্টিতে তাকান। আমি কোথায় যাব? দুই তীরের কোনো তীরেই আমার জায়গা নেই। প্রভু আমাকে একটু জায়গা দিয়ো। আমার কলবে স্থান নিয়ো। তাহলেই আমি নিরাপদ।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীতব্যক্তিত্ব