আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের পর মুক্ত শেখ মুজিব। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের পর মুক্ত শেখ মুজিব। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯

প্রত্যাহার করা হলো আগরতলা মামলা

সে এক উত্তপ্ত সময়। গণঅভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব খানের সিংহাসন টলোমলো। এমনি উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে আইয়ুব সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় এবং শেখ মুজিবসহ সব বন্দীকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হয়।

১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের এই প্রেক্ষাপটে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থে পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থ যে ভিন্ন, তা স্পষ্টতর হয়ে ওঠে।

বাঙালি রাজনৈতিক নেতা, সামরিক অফিসারসহ আপামর জনসাধারণ বুঝতে পারে যে পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে পূর্ববাংলার অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব নয়।

নিজেদের বাঁচাতে স্বদেশভূমিকে স্বাধীন করাই একমাত্র পথ। আর তা একমাত্র সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই সম্ভব।

আর এই মানসিকতা নিয়ে ১৯৬২ সালের করাচির মনোরা দ্বীপে হিমালয়ের পাকিস্তান নৌবাহিনী ঘাঁটিতে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য পূর্ববাংলাকে স্বাধীন করার প্রথম প্রচেষ্টা নেওয়া হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনসহ আরও অনেকে।

বঙ্গবন্ধু ১৯৬৪ সালে করাচিতে গেলে কামাল উদ্দিন আহমেদের করাচির বাসভবনের ৩/৪৭, এসএম জিপি স্কুল টিচার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটিতে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

ওই বৈঠকে বঙ্গবন্ধু, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান, এস এম সুলতান উদ্দিন, নূর মোহাম্মদ ও আহমেদ ফজলুর রহমান সিএসপি উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর কাছে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনার বিষয়ে জানানো হয়।

১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু আবারও করাচি গেলে লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের বাসায় অন্যান্য নেতার সঙ্গে এই আন্দোলনকে আরও গতিশীল করাসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।

যাতে ছিল—

(ক) অতর্কিতে আক্রমণ করে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক ঘাঁটিগুলোর অস্ত্রাগার দখল করে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাদের নিরস্ত্র করে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া;

(খ) বেতার, টেলিভিশন, টেলিফোন ও টেলিগ্রাম অফিস দখল করা;

(গ) গেরিলাযুদ্ধের কায়দায় আক্রমণের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করে একটি নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করা এবং বঙ্গবন্ধুর হাতে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার ভার অর্পণ করা।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই আন্দোলনকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত টিকিয়ে রাখার শপথ নেয় সবাই।

এ সময় বঙ্গবন্ধু সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ, উপদেশসহ অর্থিকভাবে সাহায্য করতে থাকেন।

সবাই একমত হন যে সশস্ত্র পথই হচ্ছে স্বাধীনতা অর্জনের একমাত্র পথ। এবং এর সমস্ত পরিকল্পনাও চূড়ান্ত করা হয়—একটি নির্দিষ্ট রাতে, নির্দিষ্ট সময়ে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের সবগুলো ক্যান্টনমেন্টে সশস্ত্র বিপ্লবী বাঙালিরা একযোগে আক্রমণ চালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদের বন্দী করবে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হবে।

শেখ মুজিবর রহমান ছয় দফার মূলমন্ত্র সর্বত্র পৌঁছে দেওয়ার জন্য পূর্ব বাংলার প্রতিটি মহকুমায় ভাষণ দিতে থাকেন।

ভীতসন্ত্রস্ত গভর্নর মুনেম খান বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রতিটি মহুকুমায় মামলা দায়ের করেন এবং জারি হয় ১২টি হুলিয়া।

১৯৬৬ সালের ৮ মে বঙ্গবন্ধু গভীর রাতে আটক হন। সেই সঙ্গে অন্য বিপ্লবীরাও আটক হন।

১৯৬৬ সালের ৮ মে থেকে ২০ মাস কারারুদ্ধ রাখার পর ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির আদেশ দিলেও ১৯৬৮ সালের ১১ এপ্রিল এক সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে পাকিস্তান সরকার একটি মামলা দায়ের করে।

মামলার শিরোনাম ‘পাকিস্তান রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’। এতে এক নম্বর আসামি শেখ মুজিবুর রহমান।

দেশ-বিদেশে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এর নাম দেওয়া হয় ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। তবে বাংলার মানুষ এর নাম দেয় ‘ইসলামাবাদ ষড়যন্ত্র মামলা’।

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী

১৯৬৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে মামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে শত শত বাঙালিকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আর ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন থেকে ঢাকার ক্যান্টমেন্ট এলাকায় স্থাপিত হয় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আদালত।

এক প্রহসনমূলক বিচার শুরু হয় সেখানে।১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে কারাগারে বন্দী আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক (অভিযুক্ত নং-১৭) কারাগারে বন্দী অন্য বাঙালিদের বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করায় কর্মরত পাকিস্তানি কর্নেলদের রোষানলে পড়েন এবং পাকিস্তানি কর্নেল দ্বারা বাঙালি বন্দীদের অত্যাচারের একপর্যায়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি তাঁদের উদ্দেশে বলে ওঠেন-

One day you will be kicked out from here like that.

এ ঘটনার পর ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোরে সার্জেন্ট জহুরুল হক বাথরুমে যাওয়ার পথে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।

সার্জেন্ট জহুরুল হক শহীদ হওয়ার খবরটি বাইরে ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ জনতা প্রতিবাদ করতে থাকে, যা গণআন্দোলনে রূপ নেয়।

আর এর নেতৃত্ব দেন জননেতা মওলানা ভাসানী।

এটি আরও বেগবান হয়ে ১৯৬৯-এ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ভীতসন্ত্রস্ত সামরিক শাসক আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুসহ অন্যদের এই মামলা থেকে মুক্ত করে দিতে বাধ্য হন।

এই গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিলাভ আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করে এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করি।