বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে থাকা দেশ চীনে আইনের শাসনের ঘাটতি আশঙ্কাজনক জায়গায় চলে গেছে। দেশটির রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট দেশের ভেতরের মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে একের পর এক অন্যায্য আইন প্রণয়ন করে যাচ্ছে। এ ছাড়া নিজের ভৌগোলিক সীমা বাড়ানোর জন্য দেশটি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করছে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক আইনের অপব্যবহার করে তারা রীতিমতো নিজের দেশের নাগরিক ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে একধরনের যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই ‘যুদ্ধকে’ অনেকে ‘লফেয়ার’ বা ‘আইনি অস্ত্রের যুদ্ধ’ বলে আখ্যায়িত করছে।
দেশটি মনে হচ্ছে সান জং ঝানফার ‘তিন যুদ্ধ’ মতবাদকে এতটাই আত্মস্থ করেছে যে তাদের কাছে যুদ্ধ ও শান্তির বিভেদরেখা ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে। তরবারির চেয়ে কলম শক্তিশালী—এই প্রবাদের মতোই বলা হয়ে থাকে সামরিক যুদ্ধে জেতার চেয়ে আরও তিনটি যুদ্ধে জেতা অধিক জরুরি। এগুলো হলো আইনি যুদ্ধ, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ ও জনমত যুদ্ধ। সি চিন পিং এই তিন পদ্ধতি অনুসরণ করে কোনোরকম গোলাগুলি ছাড়াই সম্প্রসারণবাদের দিকে এগোচ্ছেন। তাঁর বুলেটবিহীন আগ্রাসন ইতিমধ্যেই এশিয়ার রাজনৈতিক হিসাব–নিকাশ বদলে দিতে শুরু করেছে। এই তিন ধরনের যুদ্ধকৌশলের সঙ্গে সামরিক শক্তি খাঁটিয়ে চীন প্রতিবেশীদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভূমি দখল করে নিয়েছে।
এই তিন যুদ্ধের মধ্যে আইনি যুদ্ধকে আশ্রয় করে চীন আন্তর্জাতিক আইনকে তাদের নিজেদের মতো করে বদলাতে চাইছে। ঐতিহাসিক কল্পকথাকে ভিত্তি হিসেবে ধরে তারা বেআইনি কাজ–কারবারকে আইন হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চীন অতিসম্প্রতি স্থলসীমান্ত আইন নামের একটি আইন পাস করেছে। মূলত হিমালয়সংলগ্ন সীমান্ত এলাকায় নিজের দখল সম্প্রসারিত করতে চীন যে তৎপরতা চালাচ্ছে, তাকে আইনি ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতেই দেশটি এই আইন করেছে। এ ছাড়া দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সাগরে নিজের দখল বাড়াতে তারা এ বছরের শুরুতে কোস্ট গার্ড ল নামের একটি এবং মেরিটাইম ট্রাফিক সেফটি ল নামের আরেকটি আইন পাস করেছে।
এই নতুন আইনগুলো অমীমাংসিত স্থলসীমা ও নৌসীমানায় চীনা বাহিনীকে টহল দেওয়াকে অনুমোদন দিয়েছে। এর ফলে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে তার উত্তেজনা বেড়ে গেছে। চীন তার পার্লামেন্টে স্থলসীমান্ত আইন পাস করেছে এমন এক সময়ে, যখন ভারতীয় সীমান্তে চীনের জোরপূর্বক ঢুকে পড়ার জের ধরে সীমান্ত এলাকায় দুই দেশ এক লাখের বেশি সেনা গত ২০ মাস ধরে মোতায়েন করে রেখেছে।
দ্য কোস্ট গার্ড ল নামে যে আইনটি চীন পাস করেছে, তা শুধু জাতিসংঘ সনদে উল্লেখিত সমুদ্র আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘনই নয়, এটি জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়ারও ঝুঁকি তৈরি করেছে। আর তার স্থলসীমান্ত আইন ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ তৈরি করার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। কেননা, প্রতিমুহূর্তে চীন ভারতের ভূমির মধ্যে নিজের সীমানা ঠেলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া তিব্বত থেকে উদ্ভূত আন্তসীমান্ত নদীতে চীন বাঁধ দিয়ে সেই নদীর পানি নিজের ভূখণ্ডে ঘুরিয়ে নিচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
দক্ষিণ চীন সাগরে নিজেদের সীমানা নিয়ে চীন নতুন যে মানচিত্র তৈরি করেছে, তা আন্তর্জাতিক সালিসি ট্রাইব্যুনাল খারিজ করে দিয়েছে। কিন্তু চীন ঐতিহাসিক সমস্ত দলিল উড়িয়ে দিয়ে গায়ের জোরে সেখানে ‘লফেয়ার’ চালিয়ে যাচ্ছে। সি চিন পিং সরকার নিজেদের ক্ষমতাকে সংহত করতে বিতর্কিত মালিকানার দুটি দ্বীপে নতুন দুটি প্রশাসনিক জেলা ঘোষণা করেছে। দক্ষিণ চীন সাগরে ৮০টি দ্বীপ, প্রবালপ্রাচীর ও চরের নামকরণ করেছে মান্দারিন ভাষায়।
গত বছরের মাঝামাঝিতে চীন দ্য হংকং ন্যাশনাল সিকিউরিটি ল নামের একটি আইন পাস করেছে, যা আরেকটি আগ্রাসী ‘আইনযুদ্ধ’কে উসকে দিয়েছে। এই আইনের মাধ্যমে সি চিন পিং সরকার হংকংয়ের গণতন্ত্রের পথে উত্তরণে বড় বাধা সৃষ্টি করেছে। চীনের আগ্রাসী সম্প্রসারণবাদ থেকে অতি ক্ষুদ্র দেশ ভুটানও রেহাই পাচ্ছে না। মাত্র ৭ লাখ ৮৪ হাজার লোকের আবাসস্থল এই দেশটির উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তে ঢুকে চীন সামরিক শিবিরের কায়দায় অনেক গ্রাম গড়ে তুলেছে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক