প্যারেড, সোজা হও

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর

একটি রাষ্ট্রের মর্যাদাবান রাষ্ট্র হয়ে ওঠার কতগুলো বৈশিষ্ট্য আছে। এর মধ্যে বেসামরিক বিমান চলাচল অন্যতম। বাংলাদেশের সরকারগুলো রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বাংলাদেশ বিমানকে একটি লাভজনক সংস্থায় পরিণত করার চেষ্টা করে আসছে বলেই সংবাদমাধ্যমের খবরে প্রকাশ। কিন্তু সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থের দ্বন্দ্ব, ক্ষমতার অপব্যবহার, ভ্রান্ত নীতি, দুর্নীতি ইত্যাদি কারণে বিমানের ভাবমূর্তি ঠিক সেভাবে কোনো পর্বেই খুব পরিচ্ছন্ন ছিল বলে স্মরণ করা কঠিন। তবে ইদানীং এমন কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে, যা উড়োজাহাজ পরিচালনা, বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনা বা বাংলাদেশের পতাকাবাহী বিমানের জন্য কোনো গৌরব বয়ে আনছে না। বরং জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের কারণে চোখ-কান খোলা রাখা মানুষের মনে ভয়মিশ্রিত একটা সংশয় তৈরি করছে।

সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে নিরাপত্তা ছিদ্রের সন্ধান মিলছে, তাতে এই প্রশ্ন স্বাভাবিক যে বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোর হলোটা কী? গত ফেব্রুয়ারিতে ব্যর্থ বিমান ছিনতাইচেষ্টা, তার আগে একজন ইউনিফর্মধারী পুলিশ তাঁর আত্মীয়কে বিদায় জানাতে চার স্তরের নিরাপত্তা ও তল্লাশির স্তর ভেদ করে আরোহণ করলেন উড়োজাহাজে। গত এপ্রিলে শাহ মখদুমে একই কায়দায় রাজশাহী পুলিশের ডিসি বিমানে উঠেছিলেন। এখন প্রকাশ পেল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আনতে একজন অভিজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ পাইলট ড্রিমলাইনার বোয়িং নিয়ে কাতার পর্যন্ত চলে গেছেন পাসপোর্ট ছাড়াই। মানবিক ভুল স্বাভাবিক, সেটা অপরাধ নয়। কিন্তু তাঁর ভুলটি শনাক্ত হওয়ার কথা। সেটা না হওয়া অস্বাভাবিক এবং সেটা অপরাধ। উত্তম একটি ব্যবস্থা ও নিয়মকানুন গড়ে তোলা অপরিহার্য সে কারণেই। বিমানবন্দরের নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই সংবেদনশীল এবং এ ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে জিরো টলারেন্সের নীতি নেওয়া হয়। কঠোর নিয়ম মেনে চলা যত ক্লেশকরই হোক না কেন, এখানে কোনো ছাড় নেই। এবং এই নিয়ম সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিত। ইকুয়ালিটি বিফোর ল বা আইনের চোখে সমতার বিধান শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ও নন্দিত হওয়ার কারণ শুধু মানুষে মানুষে ভেদাভেদের বিরুদ্ধে বর্ম তৈরির জন্যই নয়। এটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক শৃঙ্খলা, বিশেষ করে ব্যক্তি ও সমষ্টিগত নিরাপত্তা সুরক্ষা নিশ্চিত করার স্বার্থে।

গত এপ্রিলে চট্টগ্রামের বিমানবন্দরে ঢাকার উদ্দেশে ইমিগ্রেশন পেরোতে গিয়ে বেল্ট ও জুতা খুলতে হলো। সেটা ছিল পলাশ আহমেদের ‘ময়ূরপঙ্খী’ ছিনতাইচেষ্টার প্রতিক্রিয়া। এখন এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন। কেনেডি বিমানবন্দরে দেখেছি, যখন নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জুতা বা বেল্ট খুলতে বলেন, তখন তাঁরা অধিকতর বিনয়ী আচরণ করেন। এক তরুণ আমাকে ‘স্যার’ সম্বোধন করে জুতা খুলতে বলেন। আমাদের কর্মকর্তারাও অনুরূপ বিনয়ী হলে কড়া নিরাপত্তার যে ঝক্কি, তা যাত্রীরা অনেকটাই সহজভাবে নেবেন বলে মনে হয়। কিন্তু আমরা দেখলাম বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি দুঃখজনকভাবে ভিআইপিদের জন্য নিরাপত্তাজনিত কড়াকড়ি এড়াতে চাইলেন। কল্পনা করুন, লাইন ধরে মানুষ নিরাপত্তা চাহিদা মেটাচ্ছে। তার মধ্যে হঠাৎ এক বা একদল লোক, যাঁরা প্রধানমন্ত্রী বর্ণিত ‘ভি’, তাঁরা শিথিল ব্যবস্থায় নিরাপত্তাচৌকি পার হলেন। কত বিসদৃশ বিষয়। এ রকম একটি প্রস্তাব সংসদীয় কমিটিতে পাস হয়। কারণ, অপ্রিয় হলেও এটা আমাদের কালচারে আছে।

ওই কালচারের কারণেই ইউনিফর্ম পরা পুলিশ বা পাইলট প্রতিষ্ঠিত আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই নিরাপত্তা স্তরগুলো তরতরিয়ে পার হতে পারেন। কাতারে আটক পাইলট তাঁর ‘আটক’ হওয়ার খবর ভুল বলে খণ্ডন করেছেন। বলেছেন কী করে তিনি ভুলে পাসপোর্ট ফেলে এসেছেন। আর এটা করতে গিয়ে তিনি কিন্তু কার্যত পাসপোর্ট পরীক্ষা না করার দায় নিজে নেননি। নিরাপত্তাব্যবস্থার, যথা ‘ছিদ্রের’ প্রতি ঠিকই তিনি অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন। বলেছেন, ‘আমার কাছে পাসপোর্ট চাওয়া হয়নি।’ কিন্তু ভ্রমণকারী মাত্রই জানেন, যাত্রীরা তাঁদের নিজের গরজেই পাসপোর্ট দর্শনীয়ভাবে হাতে রাখেন। আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি, দায়িত্বরত একজন এসআইকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এমনও হতে পারে, প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানের পাইলটের পাসপোর্ট দেখতে চাওয়ার সাহস হয়তো অভিযুক্ত এসআইয়ের হয়নি। ভিআইপিদের ছাড় দেওয়াটাই তাঁর মতো চুনোপুঁটির অভ্যাসগত আদব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্ট পাইলট এখন নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, সিস্টেম সঠিকভাবে সচল ও কার্যকর থাকলে তাঁর বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে এমন একটা দাগ লাগত না।

ইদানীং সরকারের কিছু কাজকর্মে সমন্বয়হীনতার ছাপ বেশি চোখে পড়ছে। ঈদের চাঁদ দর্শন বিপর্যয়ের মধ্যে পাসপোর্টহীন পাইলট আটকের খবর বেরোল। আবার তাঁর আটক নিয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বক্তব্যে ফারাক দেখা গেল। মন্ত্রণালয় বলছে, আটক হননি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বলছে, পাইলট ‘আটকের’ ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফেও একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কমিটির কর্মপরিধিতে আমরা তিনটি আলাদা বিষয় দেখি। এর মধ্যে ক্যাপ্টেন ফজল মাহমুদ চৌধুরীর পাসপোর্টবিহীন দোহা ভ্রমণের কারণ এবং ঢাকায় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি ইতিমধ্যে বহুলাংশে উদ্‌ঘাটিত বলে প্রতীয়মান হয়। তাই তিনটির মধ্যে যেটি সুদূরপ্রসারী এবং বেশি তাৎপর্যপূর্ণ সেটি হলো ‘বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কর্মপদ্ধতির ত্রুটি নিরূপণ।’ চট্টগ্রামে ময়ূরপঙ্খী ছিনতাইচেষ্টার ঘটনায় কী করে ‘খেলনা’ পিস্তল বা বন্দুক নিয়ে পলাশ বিমানে উঠেছিলেন, তার ব্যাখ্যা জনগণের কাছে পরিষ্কার নয়। এ ধরনের তদন্ত রিপোর্টে গোপনীয়তা রাখতে নেই। এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত ফল প্রকাশের চেয়ে বেশি স্বচ্ছতা দরকার এ ধরনের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত তদন্তের ফল প্রকাশে। আশা করব, এবার যে দুটি তদন্ত কমিটি হলো তার বিবরণ আমরা ওয়েবসাইটে পাব।

আমাদের কাছে যা সব থেকে উদ্বেগজনক মনে হয়, সেটি হলো ভিআইপিদের নিয়মরীতি অগ্রাহ্য করে চলাই যেন এখন একটি অলিখিত বিশেষ অধিকার। এটা চূড়ান্ত বিচারে সবার জন্য আত্মঘাতী। তিন বছরের ব্যবধানে প্রধানমন্ত্রীর তিনটি সফর ঘিরে উড়োজাহাজ বা বিমানবন্দরের নিরাপত্তা প্রসঙ্গ মানুষের নজরে এল। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী একটি বোয়িংয়ে ‘মানবসৃষ্ট ত্রুটি’ ঘটে। নাট-বল্টু ঢিলা হওয়ার কারণে সেটি তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশখাবাদে জরুরি অবতরণ করেছিল। প্রধানমন্ত্রীর চট্টগ্রাম সফরের দিনটি, যেদিন বাড়তি কড়াকড়ি প্রত্যাশিত, সেদিন পলাশ-কাণ্ড ঘটল।

আমরা স্মরণ করতে পারি, নিরাপত্তাব্যবস্থায় ত্রুটির কারণে মার্চ ২০১৬ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে কার্গো ফ্লাইট যেতে পারেনি। নিরাপত্তায় উদ্বিগ্ন যুক্তরাজ্যও একটি চেকলিস্ট দিয়েছিল। যদিও তা মেটানো হয়েছে। একইভাবে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা এসেছিল অস্ট্রেলিয়ার তরফেও। সুতরাং নিরাপত্তার বিষয়গুলোর সবকিছুই ঠিকঠাক চলছে না। যুক্তরাজ্যের পরিবহন মন্ত্রণালয়ের বর্তমান ভাষ্য, দেশটির অভ্যন্তরীণ রুটের উড়োজাহাজগুলোর সবগুলোর ব্যাপারেই তারা শতভাগ ওয়াকিবহাল নয়।

উড়োজাহাজ তদারককারী জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা আইকাওর ওয়েবসাইট পর্যালোচনায় দেখি, আটটি গুণমান বিচারে (আইন, সংগঠন, ছাড়পত্র, অপারেশনস, নিরাপদ ভ্রমণ, দুর্ঘটনা তদন্ত, বিমান চালনা এবং রানওয়ে) ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান বা মালয়েশিয়ার তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান খারাপ নয়। তবে তুলনাটা যদি উৎসাহী অনেকের মতো আমরা সিঙ্গাপুরের সঙ্গেই করি, তাহলে আমরা ঢের পিছিয়ে। আইন ও সংগঠন হিসেবে তারা ১০০ মার্কস (শতাংশ হিসাবে) পেয়েছে। বাংলাদেশের স্কোর ওই দুটিতে যথাক্রমে ৭১ ও ৮০। আইনি ক্ষেত্রে বিশ্বের গড় স্কোরের (৭৪) নিচে বাংলাদেশ। সিঙ্গাপুর অন্য ছয়টিতে ৮৯ বা তার ওপরে। দুর্ঘটনা তদন্ত ও রানওয়েতে বাংলাদেশের স্কোর ৭০-এর নিচে। প্রধানমন্ত্রী গতকাল নিজেই বলেছেন, আইকাওর সকিউরিটি লেভেলের ৭০ শতাংশ অর্জন করতে পেরেছে বিমান।

এবারের আলোচ্য পর্বটির মূল উদ্বেগ নিরাপত্তা প্রশ্নে ঢিলেঢালা মনোভাব। সহকর্মী এ কে এম জাকারিয়া গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁর এক লেখায় রসিকতা করে মন্তব্য করেছিলেন, আমাদের বিমানবন্দরের নিরাপত্তার ভঙ্গিটা ‘আরামে দাঁড়াও’। বিনা পাসপোর্টে পাইলটের ভ্রমণ মনে করিয়ে দিল, তারা একই আয়েশি ভঙ্গিতে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। প্যারেড, সোজা হও, ‘স্বর্ণ প্রসবিনী’ বিমানকে কমান্ড দেওয়ার এখনই সময়।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
mrkhanbd@gmail.com