হ্যামেলিনের বংশীবাদকের গল্প আগাগোড়া কল্পগল্প নয়, বরং খানিকটা ইতিহাসাশ্রিত। তেরো শতকের মাঝামাঝি থেকে চৌদ্দ শতকের শুরুতে সব বিড়াল মেরে ফেলায় ইউরোপে অস্বাভাবিক হারে ইঁদুর বেড়ে যায়। ১২৪০ দশকের শুরুতে পোপ নবম গ্রেগরির দেওয়া একটি ফতোয়া নির্বিচার বিড়ালনিধনের কারণ হয়ে উঠেছিল। পোপ উসকে দিলেন যে শয়তান লুসিফার বিড়ালের রূপ নিয়ে বিড়াল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। জানালেন, বিড়াল ডাইনি, প্রেতিনী ও কুহকিনীদের বাহন। বিড়াল মানেই অমঙ্গল। যদিও দায়ী করা হয়েছিল শুধুই কালো বিড়ালকে, হুঁশ-বুদ্ধিহীন ও ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ অতশত কালো-সাদা মনে রাখেনি। যে যেখানে, যেভাবে পেরেছিল, বিড়াল মেরে সাফ করে ফেলেছিল। সঙ্গে ডাইনি-কুহকিনী সন্দেহে অনেক নারীকেও হত্যা করার মচ্ছব শুরু হয়েছিল। কেন বিড়ালকে ভিলেন বানানো হয়েছিল, সে এক ভিন্ন ইতিহাস, তা এই আলোচনার জন্য প্রয়োজনীয় নয়। প্রসঙ্গটি শুধু এ কথা বলার জন্য যে ভীতিজর্জরতা (ম্যাস হিস্টিরিয়া) মহামারির জন্ম দিতে পারে। বিড়াল বিষয়ে মধ্যযুগের জনগণের সীমাছাড়া ভীতিজর্জরতার কারণে প্লেগ যেমন মহামারির রূপ নিয়েছিল।
বিড়াল নেই, তাই ইঁদুর বাড়ল। ময়লা স্যাঁতসেঁতে প্রতিবেশ ইঁদুরের প্রিয়। এই পরিবেশে ইঁদুরের গায়ে উকুনের মতো একধরনের অণুজীবের জন্ম ও বিস্তার ঘটাল। একেকটি ইঁদুরের গায়ে লাখো কোটি জীবাণু। তারা দৌড়ায় দ্রুতগতিতে। মুখ দেয় সবকিছুতে। ইঁদুরের উপদ্রবে শুরু হলো একধরনের প্লেগ মহামারি। তাতে বিলীন হলো অন্তত ২০০ মিলিয়ন মানুষ। ম্যালথাস যে বলেছিলেন, জনসংখ্যা বেড়ে গেলে প্রকৃতি কোনো দুর্যোগ দিয়ে সমন্বয় করে দেবে। বা গ্যারেট হার্ডিন যেভাবে ‘ট্র্যাজেডি অব দ্য কমন্স’-এ প্রকৃতির ধারণক্ষমতা বিনষ্টের ফলে প্রতিশোধের কথা বলেন, অনেকেই ‘ব্ল্যাক ডেথ’-কে সেসব তত্ত্বের সেরা উদাহরণ হিসেবে হাজির করেন।
ইতিহাসে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নাম পাওয়া এই মহামারি গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে ফেলেছিল। এই বিশাল মৃত্যুর বহরের পেছনে ‘ভীতিকর আতঙ্ক’ বা ‘প্যানিক’ও ছিল বড় ক্রীড়নক। বিড়াল বিষয়ে প্যানিক, ডাইনি সম্পর্কে প্যানিক, অমঙ্গলের ভীতিতে প্যানিক ইত্যাদি। আধুনিক রোগতত্ত্ববিদ্যামতে, কোনো মহামারিতে মৃত্যুর এবং দ্রুতমৃত্যুর অন্তত ৫০ শতাংশই ঘটে ‘প্যানিক অ্যাটক’-এর কারণে। ২০১৬ সালের এক গবেষণা প্রবন্ধে সান্ড্রা মেয়্যার নামের এক রোগতত্ত্ববিদ এ তথ্য জানান।
বিষাক্ত সাপের কামড়েও ৫ শতাংশের বেশি মৃত্যু হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ছোবল খাওয়া মানুষ ভীতিবিহ্বলতা ও আতঙ্কের চোটে যখন মনে করতে থাকে যে তার আর বাঁচার সম্ভাবনা নেই, তখনই মস্তিষ্কে সেরোটনিন নামের নিউরোট্রান্সমিশন ক্ষমতার কেমিক্যালটির লেভেল একেবারে নিচে নেমে যায় এবং ভয়ার্ত ব্যক্তির মৃত্যুর সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়। কেতাবি ভাষায় এই আতঙ্ককর অবস্থাগুলোকে আমরা অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার, প্যানিক ডিসঅর্ডার ইত্যাদি বলি। ইউরোপে ইনক্যুইজিশনের সময়ে উইচহান্টিং বা ডাকিনীদের পিটিয়ে পুড়িয়ে ফেলাও প্যানিকের ফল। সাম্প্রতিক ছেলেধরা সন্দেহে হত্যাকাণ্ডগুলোতেও প্যানিকের ক্রীড়নক হয়ে গিয়েছিল অনেক মানুষ।
সাম্প্রতিক ডেঙ্গুর প্যানিকও মৃত্যু বাড়িয়ে তুলছে—এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সাম্প্রতিক অনেকগুলো চিকিৎসা-গবেষণার আলোকে ব্রিটেনের ‘নো প্যানিক’ নামের সংস্থাটি জানাচ্ছে যে প্যানিকে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কা প্যানিকমুক্ত ব্যক্তির রোগ-সম্ভাবনার চেয়ে আট গুণ বেশি। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তিও যদি ধরেই নেন তিনি আর বাঁচছেন না, তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত, তাঁর না বাঁচার সম্ভাবনা তখনই আট গুণ বেড়ে যাচ্ছে, তা বলা যায়। একই রকম প্যানিক দেখা গিয়েছিল আশির দশকের শুরুতে এইডস বিষয়ে। পত্রপত্রিকাসহ লোকমুখে গুজব প্রচার পেয়েছিল যে এইডস অনিরাময়যোগ্য এবং এতে মানবজাতি বিলুপ্ত হয়ে পড়বে। ইতিমধ্যে প্রমাণিত যে এইডসও সম্পূর্ণই নিরাময়যোগ্য। ডেঙ্গু তো আরও সহজে নিরাময়যোগ্য। ধরা যাক, সারা দেশে এক লাখ লোক আক্রান্ত। তার মধ্যে ২০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও প্যানিক না করলে বোঝা যাবে ৯৯ হাজার ৮০০ জন তো বেঁচে আছেন। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রোগ প্রতিরোধের ও প্রতিকারের জন্য খুবই প্রয়োজন।
মিডিয়াও প্যানিক তৈরি করতে পারে। পত্রিকার শিরোনাম দায়িত্বপূর্ণ না হলে প্যানিক বাড়ে। পত্রিকাগুলোর শিরোনাম যদি হয় ‘ডেঙ্গু মহামারির রূপ নিচ্ছে’, ‘অনিরাময়যোগ্য হয়ে পড়েছে’, ‘আশঙ্কা-আতঙ্কে মানুষ’ ইত্যাদি মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও ভীতি বহুগুণ বেশি বাড়বে। ‘বাজারে ওষুধ নেই’, ‘ওষুধ আসা অনিশ্চিত’ ইত্যাদি শিরোনামের শতভাগ সত্যতা থাকার পরও নেতিবাচক শিরোনাম মিডিয়ায় না আসাই ভালো। সিটি করপোরেশনসহ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা–সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে আরও কার্যকর, সচেষ্ট ও দায়িত্বপূর্ণ রাখার জন্য বিভাগগুলোর দুর্বলতা ধরিয়ে দেওয়া অবশ্য মিডিয়ার দায়িত্বের অংশ। শিরোনামে বিভাগগুলোর সমালোচনা থাকতে পারে। পরামর্শও থাকতে পারে। অমর্ত্য সেন যেমনটি বলেছিলেন, মিডিয়া শক্তিশালী থাকলে দুর্ভিক্ষ হয় না। মিডিয়া ধরিয়ে দেয় ব্যবস্থাপনার গলদ কোথায় হচ্ছে। অমর্ত্য সেনের কথার সুরে বলা যায়, দায়িত্বপূর্ণ মিডিয়া থাকলে রোগ মহামারির রূপ নেয় না।
হাসপাতাল, ডাক্তার, ডিসপেনসারিও অনেক সময় প্যানিক বাড়ায়। নামকরা একটি ওষুধের দোকানে গিয়েছিলাম। সেলসম্যান বারবার একই গল্প দিচ্ছিলেন যে ১০০টি স্প্রে এনেছিলেন, ১০ মিনিটে শেষ হয়ে গিয়েছে। সবাই কিনে নিয়েছে। হাসপাতালে ডাক্তারের গম্ভীর চেহারা, নার্সদের ‘গেল গেল উপায় নেই’ মুখভঙ্গিও রোগী ও স্বজনদের প্যানিক বাড়ায়। সতর্কতা অত্যন্ত প্রয়োজন বটে, কিন্তু একটি মশা উড়তে দেখলেই লোকজন যেভাবে আতঙ্কিত হয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করছে, তাতে ম্যাস হিস্টিরিয়াও যে দেশব্যাপী রোগে পরিণত হচ্ছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
ম্যাস হিস্টিরিয়ার মধ্যে সারা দেশের রোগের ও রোগীর মনস্তত্ত্বই ধরা পড়ে। মানুষ বিশ্বাস হারিয়েছে, আস্থা হারিয়েছে। রোগ নিরাময় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থাহীনতা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রতি আস্থাহীনতা ইত্যাদি গণমনস্তত্ত্ব ডেঙ্গু বিষয়ে আরও বেশি দৃশ্যমান। এসব প্যানিক রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতার ফল। নেতিবাচক মনোভঙ্গি একধরনের মানসিক রোগ। এই রোগ বিপর্যয়কর সীমায় চলে গেছে। তার পেছনে কারণগুলো কী, তা বোঝা প্রয়োজন।
২০১৬ থেকে শুরু করে প্রতিটি বছরই ডেঙ্গু দেখা দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অন্তত এক বছর আগে থেকেই ব্যাপক অগ্রিম প্রস্তুতি দরকার ছিল। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকার দরকার না হলে যা হয়! অগ্রিম কোনো প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে কোনো কিছু পত্রিকায় আসেনি। অগ্রিম সতর্কতামূলক, জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের কিছুও কেউ দেখেনি। বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো সম্ভবত ঝড়-বন্যা-ঘূর্ণিঝড়-ভূমিকম্প ছাড়া অন্য কিছুকে দুর্যোগ মনে করে না। সে জন্য নগর কর্তৃপক্ষগুলোর সঙ্গে এই বিভাগের কোনো যৌথ কার্যক্রম কারও চোখে পড়েনি। অথচ ‘আত্মহত্যা বেড়ে যাওয়া’কেও উন্নত গণতন্ত্রের দেশগুলোয় দুর্যোগ ধরা হয়। এবারও ডেঙ্গু সমস্যাটি নাকের ওপর এসে পড়ার পর রাষ্ট্রময় ভীতির কারণে রাষ্ট্রের এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর আস্তেধীরে টনক নড়েছে। ইতিমধ্যে প্যানিক রাষ্ট্রময় একটি রোগের ওপর আরেকটি রোগ হয়ে জড়িয়ে পড়েছে।
নানা রকম সতর্কতামূলক লেখালেখি, সচেতনতা তৈরি করার মতো ছবি-পোস্টার প্রচারিত হচ্ছে, ভালো কথা। কিন্তু কোনো ছবি-পোস্টারেই ভয় না পাওয়ার পরামর্শ দেওয়া নেই। অথচ সেটি হওয়ার কথা সবকিছুর ওপরে। সামাজিক মাধ্যমেও এই বিষয় আলোচিত হওয়া দরকার। প্যানিক থেকে প্যারানয়া বা বদ্ধমূল ভীতির জন্ম হয়। প্যারানয়া বড় মানসিক রোগ। এই দেশের জনগণকে যেন আর কোনো নতুন মানসিক রোগের শিকার না হতে হয়, জনস্বাস্থ্য-সংশ্লিষ্ট সব বিভাগ সেদিকে নজর দিক।
লেখক: নৃবিজ্ঞানী, কানাডার মানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো।