সরকারি কর্মকর্তার সন্তান হিসেবে পেনশনের সঙ্গে আমার পরিচিতি দীর্ঘদিনের। আব্বার মৃত্যুর পর আম্মাকে নিয়ে পেনশন অনুমোদন পেতে শিক্ষা বিভাগ, এজি অফিস, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে নিজে গিয়ে, অন্যকে পাঠিয়ে অনেক শ্রমঘণ্টা এবং অর্থ ব্যয় করেছি। পেনশনের পদ্ধতি এতটাই দীর্ঘসূত্রতা ও হয়রানিমূলক ছিল যে সেটা আমাদের কাছে কৌতুকের বিষয়ই হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেমন এক ভদ্রলোকের মার্চ মাসের পেনশন তুলতে গিয়ে দেখলেন, তার আগের দুই মাসের পেনশন পাননি। কারণ হিসেবে তাঁকে বলা হলো, যেহেতু তিনি আগের দুই মাস হাজিরা দিয়ে জীবিত প্রমাণ করতে পারেননি, তাই তাঁকে ওই দুই মাস পেনশন দেওয়া হয়নি। বকেয়া পেতে তাঁকে আগের দুই মাস জীবিত থাকার প্রমাণ দিতে হবে!
তাই নিজে অবসর গ্রহণের সময় এককালীন অর্থের প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও শতভাগ পেনশন সমর্পণ করি, যাতে সরকারি অফিসের চৌহদ্দি মাড়াতে না হয়। গড়পড়তা আয়ু বৃদ্ধি ও পেনশনারদের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে সরকার ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে ১৫ বছর অতিবাহিত হলে শতভাগ সমর্পণকারীদের পেনশন পুনঃস্থাপনের বিধান করেছে। এ বিষয়ে জানার জন্য আমার আগে অবসর গ্রহণ করেছেন, এমন এক বন্ধুকে ফোন করি। তিনি জানালেন, পদ্ধতিটি খুব সহজ এবং তিনি পুনঃস্থাপিত পেনশন পাচ্ছেন। তবু সাবধানের মার নেই ভেবে প্রীতিভাজন সাবেক অর্থসচিব ও বর্তমানে বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মুসলিম চৌধুরীকে ফোন করি। তিনি সহায়তার আশ্বাস দেন। কিছুক্ষণ পরই একজন কর্মকর্তা আমার অবসর গ্রহণের তারিখ ও ফোন নম্বর নেন। পরদিনই আমার পেনশন পুনঃস্থাপিত হয়ে যায়!
পত্রিকায় কলাম লিখতে গিয়ে প্রায়ই সরকারি কার্যক্রম সম্পর্কে হতাশা ও ব্যর্থতার কথা লিখতে হয়। অনেকের ধারণা, অবসর গ্রহণের পর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা হয় এক্সটেনশন বা নতুন পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে সরকারের গুণকীর্তন করতে থাকেন আর বাকিরা বিরোধী দল বনে গিয়ে সরকারের অযাচিত সমালোচনা করে থাকেন। বিষয়টি এমন নয়। যেমন আমি যখন সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনা করি, তখন মনোবেদনা অনুভব করি। এ ব্যর্থতা আমারও, কেননা অতীতে আমিও সরকারি দপ্তরে কাজ করেছি। যাহোক, আজ একটি আশাব্যঞ্জক বিষয়ে লিখছি—কীভাবে আমাদের জরাজীর্ণ পেনশন ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে।
পেনশন প্রক্রিয়াকে দুটি ধাপে ভাগ করা যায়। ক. অবসর–পূর্ববর্তী কার্যক্রম; খ. অবসর–পরবর্তী কার্যক্রম। অবসর–পূর্ববর্তী কার্যক্রম শুরু হয় ভবিষ্য তহবিলে (প্রভিডেন্ট ফান্ড) টাকা জমাদানের শুরু থেকে। অবসর–পরবর্তী ছুটির (পিআরএল) সময় গ্র্যাচুইটি ও পেনশন অনুমোদনের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া শেষ হয়। প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৩০ হাজার সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী অবসর গ্রহণ করে থাকেন।
পরের ধাপে অবসর–পরবর্তী কার্যক্রম শুরু হয়। এ পর্যায়ে অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে পেনশন প্রদান করা হয়। বর্তমানে আট লক্ষাধিক ব্যক্তি পেনশন ভোগ করছেন।
অবসর–পরবর্তী কার্যক্রমের সংস্কার সম্পন্ন হয়েছে। অবসর–পূর্ববর্তী কার্যক্রমের সংস্কার চলমান। ইতিমধ্যে পেনশন অনুমোদন প্রক্রিয়া সহজতর করার লক্ষ্যে ‘পেনশন সহজীকরণ আদেশ-২০২০’ জারি করা হয়েছে।
অর্থবছর ২০১৬-১৭–এর আগপর্যন্ত বেসামরিক পেনশন ও ভাতাদির বাজেট মন্ত্রণালয়ভিত্তিক ছিল। ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে পেনশন ও ভাতাদির বাজেট মন্ত্রণালয়ভিত্তিক ধারার পরিবর্তে একক বাজেট হিসেবে অর্থ বিভাগের অধিভুক্ত করা হয়। বেসামরিক পেনশন ছাড়া প্রতিরক্ষা এবং রেলওয়ে বিভাগের পেনশন ও ভাতাদি একক বাজেট হিসেবে যথাক্রমে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে পরিশোধ করা হয়। আগে বেসামরিক অবসরভোগীদের পেমেন্ট ৫৪০টি পে পয়েন্ট এবং ১ হাজার ২০০-এর মতো ব্যাংকের শাখা থেকে দেওয়া হতো। বর্তমানে এসব অবসরভোগীর বেতন ও ভাতাদি পরিশোধের জন্য তিনটি কেন্দ্রীয় পেনশন অফিস তৈরি করা হয়েছে বেসামরিক, প্রতিরক্ষা ও রেল বিভাগে। বর্তমানে অবসরভোগীদের পেনশন ও ভাতাদি
এ তিন কেন্দ্রীয় অফিস থেকে মাসের প্রথম কর্মদিবসে দেওয়া হচ্ছে।
মাসিক পেনশন ও ভাতাদি প্রদান প্রক্রিয়ার সংস্কার ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হয়। ২০২১ সালের ১৭ মার্চের মধ্যে শতভাগ অবসরভোগীদের ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের (ইএফটি) আওতায় আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় এবং তা সময়সীমার মধ্যে অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।
পেনশন সংস্কারের মূল বিষয়গুলো হলো—এক. অবসরভোগীদের জন্য ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি) অ্যাকাউন্ট প্রস্তুতকরণ এবং প্রতি মাসের প্রথম কর্মদিবসে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাঁদের অ্যাকাউন্টে পেনশন ও ভাতা পরিশোধ করা। দুই. স্বয়ংক্রিয় ফিক্সেশন ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং পেনশন প্রসেসিং প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজ করার মাধ্যমে পেনশন পেমেন্টে সঠিকতা, সময়োপযোগিতা নিশ্চিত করা; তিন. পেনশন ফিক্সেশন ও বকেয়া নির্ধারণে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি প্রবর্তনের ফলে সব পে পয়েন্টে পেনশন ফিক্সেশনে অভিন্নতা নিশ্চিত করা। চার. কেন্দ্রীভূত পেনশন তথ্যভান্ডার তৈরি করা। পাঁচ. কেন্দ্রীভূত এবং প্রকৃত সময়ভিত্তিক (রিয়েল টাইম) হিসাবায়ন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। ছয়. সহজলভ্য এবং নির্ভরযোগ্য লাইফ ভেরিফিকেশন ব্যবস্থা চালু করা এবং পেনশনারদের দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে তাঁর লাইফ ভেরিফিকেশন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারার প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করা। সাত. নিবেদিত (ডেডিকেটেড) এবং প্রতিক্রিয়াশীল (রেসপন্সিভ) অভিযোগ নিষ্পত্তিব্যবস্থার (জিআরএস) মাধ্যমে পেনশনারের বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ গ্রহণ এবং সেগুলো সমাধানের প্রক্রিয়া প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা।
প্রজাতন্ত্রের পেনশনারের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছে এবং অযোগ্য পেনশনারদের পেনশন ডেটাবেইজ থেকে বাদ দেওয়া সম্ভব হয়েছে; সার্ভিস ডেলিভারিতে সময় কম লাগছে। ফলে কর্মদক্ষতা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে; পেপারলেস কার্যালয় তৈরির মাধ্যমে অফিসের সার্বিক পরিবেশের উন্নয়ন ঘটেছে; পেনশন পেমেন্টে পুনর্ভরণ সার্ভিস চার্জ বাবদ ব্যয় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে; পেনশন বাজেট এবং ব্যয় ব্যবস্থাপনায় সঠিকতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে; পেনশনারের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ, কেন্দ্রীভূত, তথ্যবহুল পেনশন ডেটাবেইজ তৈরি হয়েছে, যা পেনশনার ব্যবস্থাপনা এবং এ–সংক্রান্ত পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করবে।
পেনশনারের সব ধরনের পেমেন্ট প্রক্রিয়ায় ইএফটি পদ্ধতিতে প্রবর্তন করা হয়েছে, পেনশনারের ম্যানুয়াল পেনশন পেমেন্ট অর্ডারকে (পিপিও) ইলেকট্রনিক পিপিওতে (ইপিপিও) রূপান্তর করা হয়েছে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে বার্ষিক ইনক্রিমেন্টসহ বিধিগতভাবে প্রাপ্য সব সুবিধা নির্ধারিত হচ্ছে, যথাসময়ে সব পেনশনারের পেমেন্ট নিশ্চত করা সম্ভব হচ্ছে, অবসরভোগীর ভোগান্তি লাঘব করা সম্ভব হয়েছে এবং অবসরভোগীদের পেনশন ভাতাদি গ্রহণের সময় ও ব্যয় হ্রাস পেয়েছে।
বিপুল অর্থব্যয়, দামি বিশেষজ্ঞ, টেবিলে টেবিলে কম্পিউটার, লেজারজেট প্রিন্টার, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষ—এর কোনোটাই তথ্যপ্রযুক্তির সফল ব্যবহার নির্দেশ করে না। ‘পুডিংয়ের স্বাদ যেমন চেখে দেখায়’ তেমনি তথ্যপ্রযুক্তির সফল ব্যবহারের মানদণ্ডগুলো হলো ক. সেবার মান বৃদ্ধি—সময় হ্রাস ও সেবাগ্রহীতার সন্তুষ্টি; খ. নির্ভুলতা; গ. ব্যয় ও অপব্যয় হ্রাস এবং ঘ. সরকারি দপ্তরে যাতায়াতের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস। এসব মানদণ্ডের সব কটিতেই পেনশন সংস্কার সফলভাবে উত্তীর্ণ।
বর্তমানে তাৎক্ষণিকভাবে পেনশন–ভাতাদি প্রদান করা হচ্ছে। প্রায় ১ লাখ ১৭ হাজার অযোগ্য পেনশনভোগীকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রতিবছর সরকারের ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। সার্ভিস চার্জ পুনর্ভরণ বাবদ বছরে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা খরচ কমেছে।
আগেই বলেছি, অবসর–পূর্ববর্তী কার্যক্রমের সংস্কার চলমান। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি শেষ করতে হবে, যাতে করে অবসরভোগী কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অবসর গ্রহণের দিনই তাঁদের পেনশন মঞ্জুরির আদেশ পেতে পারেন। সরকারি দপ্তরে না গিয়েই জীবিত প্রমাণের নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। অবসরভোগীদের আরেকটি দাবি আছে, তা হলো শতভাগ পেনশন সমর্পণকারীদের পেনশন পুনঃস্থাপনের সময়সীমা ১৫ বছর থেকে কমানো। বর্তমান আক্রার বাজারে এ ব্যবস্থা দারিদ্র্য ও আয়বৈষম্য দূরীকরণে সহায়ক হবে।
আমি পেনশন সংস্কারে সাফল্যের জন্য হিসাব মহানিরীক্ষক ও মহানিয়ন্ত্রকের দপ্তর, অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ