পৃথিবী এখন একটা নভোযান—স্পেসশিপ; আপনিই তার একমাত্র যাত্রী। নিজেকে নিয়েই থাকতে হবে আপনাকে। ঘরবন্দী থাকার দিনে এই তুলনা এসে যায়। স্কট কেলির নাম অনেকে শুনে থাকবেন। নিউইয়র্ক টাইমসের ২২ মার্চের সংখ্যায় নাসার সাবেক এই নভোচারী লিখেছেন, ‘ঘরে আটকে থাকা চ্যালেঞ্জিং। আমিও যখন আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে প্রায় এক বছরের জন্য বাস করেছিলাম, সেটাও সহজ ছিল না। যখন আমি ঘুমাতাম, তখনো কর্মরত; যখন জেগে উঠি, তখনো আমি কাজের মধ্যেই ছিলাম। মহাকাশে উড়াল দেওয়া এমন এক কাজ, এতে কোনো বিরতির মুহূর্ত নেই।’
যার যার বাড়িঘর, বাসস্থান, শরীর, ব্যবহারের জিনিসপত্র—সব নিয়েই আমরা একা হতে চলেছি। পরিবার নিয়ে বা একা; আমাদেরই এসব নিরাপদ রাখতে যে হবে, তাতে বিন্দুমাত্র বিরাম নেই। ঘুমও একটা কাজ। কারণ, গভীর ঘুম শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
পৃথিবী নামক এই স্পেসশিপে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। অসুখ যে হারে সংক্রমিত হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি হারে যদি প্রতিরোধ না হয়, তাহলে আমরা অনেকেই হয়তো আর বাঁচতে পারব না। আর এই প্রতিরোধের চেতনার মধ্যে যদি সমগ্র মানবজাতিকে না রাখি—একা কেউ, কোনো রাষ্ট্র, দেশ, মহাদেশ বা পরাশক্তি তেমন কিছু করতে পারবে না। আমরা মানুষেরা যে একটা নিঃসঙ্গ প্রজাতি এই মহাশূন্যের ভেতর, তা খুব করুণ ও কঠিনভাবে টের পাচ্ছে পৃথিবীর মানুষ।
চীনে গত তিন দিনে নতুন করে কেউ সংক্রামিত হয়নি। ইতালি এখন সমাধিক্ষেত্র—প্রতিদিন শয়ে শয়ে মানুষ সেখানে মারা যাচ্ছে। হংকংয়ের অধিবাসীরা তৃতীয়বারের মতো করোনার ঢেউ সামলাচ্ছে। নতুন নতুন দেশ থেকে নতুন নতুন মৃত্যুর খবর আসছে।
এর মধ্যেই আলোচনা উঠছে যে এটা কি চীনের ‘চেরনোবিল মোমেন্ট’, নাকি এটাই তার ফিনিক্স পাখির মতো নবশক্তিতে বলীয়ান পুনর্জন্ম? চেরনোবিলে পারমাণবিক দুর্ঘটনা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের শুরু ধরা হয়। করোনাভাইরাসের আক্রমণ শুরু হওয়ার সময় থেকেই পশ্চিমা পণ্ডিতেরা বলে আসছিলেন, চীনা সাম্রাজ্যের পতন শুরু হলো। সত্যিই চীনের অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি—সব থমকে দাঁড়িয়েছিল। দুর্ধর্ষ শি চিন পিংয়ের নেতৃত্বে অনাস্থা শুরু হয়েছিল। কিন্তু তিন মাসের মধ্যে চীন এখন হাজির হয়েছে বাকি বিশ্বের ত্রাতা হিসেবে। তারা ইতালিতে, ইরানে, সার্বিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে চিকিৎসক, করোনা প্রতিরোধ সরঞ্জাম ও বিশেষজ্ঞ পাঠাচ্ছে। চীনা বাজারের মহানায়ক জ্যাক মা এমনকি বাংলাদেশকেও করোনা পরীক্ষার কিট ও অন্যান্য সামগ্রী পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছেন। মনে হচ্ছে, ইউরোপ-আমেরিকার বেকায়দা অবস্থায় ময়দানে প্রথম উঠে দাঁড়ানো চীনই শেষ পর্যন্ত বিজয়ীর হাসি হাসবে।
এশিয়া টাইমসের কলামিস্ট স্প্রেংলার চীনের জয়ের পাশাপাশি করোনা মোকাবিলার পথে এশিয়ার উত্থানের সুযোগ দেখছেন। তাঁর ভাষায়, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে খুব সম্ভব যে কোভিড-১৯ মহামারি হয়তো এশিয়ার উত্থান এবং পাশ্চাত্যের পতন সূচিত করবে।’
বিপদের দিনে মানুষের ও সরকারের আসল চেহারা চেনা যায়। বাংলাদেশ সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই চলেছে নির্বাচন, চলেছে সাংবাদিক কাজলকে নিখোঁজ করে দেওয়া। করোনা–আতঙ্কের মধ্যেই ব্রাজিলে আদিবাসী তরুণেরা নিখোঁজ হচ্ছেন। বাংলাদেশে মৃত ব্যক্তি করোনায় নাকি অন্য অসুখে মারা গেছে, তা নিয়ে কোন্দলে একজন নিহত হয়েছে।
বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলেও পোশাক কারখানাগুলো বন্ধ হয়নি। ঢাকাতেই প্রায় ৪০ লাখ পোশাকশ্রমিক গাদাগাদি করে কাজ করেন, গণপরিবহনে চলেন এবং অস্বাস্থ্যকর জনঘনত্বে বাস করেন। সরকারি বৈঠক থেকে ফিরে এক শ্রমিক নেত্রী জানালেন, বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। শ্রমজীবীদের জীবনে বড় প্রশ্ন কোনটি? করোনা নাকি অভাব? কাজ চালিয়ে গেলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর আশঙ্কা। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পোশাকশ্রমিক নারী ও শিশুরা দারুণ অপুষ্টির শিকার। তাই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকবে কম। সুতরাং করোনার জন্য তারা নিদারুণ উপযুক্ত শিকার। আবার কাজ না থাকলে তাঁরা খাবেন কী? অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্য প্রশ্নে যে মানুষদের জীবনে একাকার, তাঁরা হলেন এঁরা।
কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার দরিদ্রদের জন্য রেশনে খাবার, বিদ্যুৎ ও পানির বিল মওকুফ এবং বাড়িভাড়া পরিশোধের বিষয়ে সাহায্যের সিদ্ধান্ত দিয়েছে। যদি মানুষজনকে ঘরের মধ্যে থাকতে বাধ্য করতে হয়, তাহলে তাদের জীবিকার সমাধান দিতে হবে। যদি তা না করা হয়, লোকে কাজের খোঁজে বেরোবে এবং আক্রান্ত হবে। একজন আক্রান্ত হলে তিন থেকে সাতজনের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াবে। এই ধারা চললে করোনা সংক্রমণকে এক জায়গায় আটকে দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। এই চিন্তা থেকেই আল–জাজিরার এক কলামে প্রশ্ন তুলেছেন গবেষক নেইল হাওয়ার্ড ও শরৎ দাভালা। তাঁদের কথা থেকে অনুবাদ করে তুলে দিচ্ছি, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় ৮০ ভাগ অকৃষি শ্রমিক অনানুষ্ঠানিক খাতে বিনা চুক্তিতে কাজ করেন, তাঁদের জন্য কোনো নিরাপত্তা জাল নেই, নিয়োগদাতাদেরও নেই কোনো দায়।…এই লোকগুলোকে বাঁচাতে কী করা যেতে পারে?’
চল্লিশ বছর আগে নোবেল পুরস্কারজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের দুনিয়া কাঁপানো কাজ দেখিয়েছিল যে দুর্ভিক্ষে মানুষ মারা যায় যতটা না খাদ্যের ফলনের অভাবে, তার চেয়ে বেশি বাজারে থাকা খাদ্য কিনতে না পারায়। এর কারণ সর্বদাই আর্থসামাজিক চাহিদা মেটাতে যা দরকার, তা নিতে আইন তাদের বাধা দেয়, ধনীদের মুজতদারির কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়, অকার্যকর রেশনিং ইত্যাদি।
এই গল্পে নগদ টাকাই আসল। ১৯৪৩–এর বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় ১৯৪১–এর চেয়ে খাদ্য উৎপাদন অনেক বেশি ছিল। এরপরও কৃষি মজুরি না বাড়লেও খাদ্যের দাম আকাশে গিয়ে ঠেকে। কারণ, ঔপনিবেশিক সরকার যুদ্ধের দরকারে খাদ্য মজুত করেছিল। এর অর্থ হলো স্থানীয় শ্রমিকেরা না খেয়ে মরেছিলেন, কেননা তাঁদের উৎপাদিত ফসল আবার কিনে নেওয়ার মতো টাকা তাঁদের হাতে ছিল না…এ রকম পরিস্থিতিতে সামান্য পরিমাণ টাকাও বাস্তবে মানুষের জীবন বাঁচায়।’
এ কারণেই আজকাল মানবতাবাদী সংস্থাগুলো যুদ্ধবিধ্বস্ত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার মানুষের হাতে সরাসরি টাকা পৌঁছে দেওয়াকে তাদের নৈমিত্তিক কাজ করে নিয়েছে। সত্যিই মোট সাহায্যের ১০ ভাগ আসে নগদ টাকার আকারে।
বাজার অর্থনীতিতে নগদ টাকার সাহায্য ছাড়া উপায় নেই। মানুষকে ঘরেও রাখতে হবে, আবার তাদের খাওয়াতেও হবে। সরকার চাইলেই এটা করতে পারে। আজকাল সবার হাতেই মোবাইল আছে, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর আছে। এসব ধরে ধরে নিম্নবিত্তদের পাশে দাঁড়ানো যদি না যায়, তাহলে করোনা ও দারিদ্র্য—দুটিই গণমৃত্যুর সংখ্যা বাড়াবে। দারিদ্র্য ও অসুখ দুজনে দুজনার হয়ে সমাজ-রাষ্ট্র-সভ্যতা তছনছ করে দেবে। যে মানুষেরা মারা যাবে বলে নিশ্চিত হবে, ক্ষুধায় যাদের পেটে আগুন জ্বলবে, তারা চুপচাপ মরে যাবে না। তারা সমাজে আরও নৈরাজ্যের আগুন জ্বালাবে। সময় থাকতেই তাই সাধু সাবধান।
ইতিমধ্যে ঘরে থাকুন, প্রচুর হাত ধুয়ে নিন এবং কিছু রুটিন তৈরি করুন। স্কট কেলি বলছেন, মহাকাশযানে তাঁকে বাঁচিয়েছিল দৈনন্দিন রুটিন। প্রতিদিন শরীর-মনের জন্য নির্ধারিত কাজগুলো সময়মতো তিনি করতেন। সময় কাটাতে আপনার কোনো না কোনো শখের কাজ লাগবেই, বলছেন তিনি। বই পড়া, গান শোনা ইত্যাদি। ডায়েরিও লিখতেন তিনি। আপনিও লিখে রাখুন করোনার দিনরাত্রির নানান কথা। হয়তো অনাগত সময়ের মানুষ এ থেকে কিছু শিখবে। জানবে, কত সম্পদ, কত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও শুধু অপরিণামদর্শিতায় বুদ্ধিমান মানব প্রজাতি কতটা অসহায় ও অক্ষম হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে গিয়েছিল। আর হ্যাঁ, কাগজের ফুলও বানাতে পারেন। স্কট কেলি নভো স্টেশনে পরীক্ষামূলকভাবে ফুলগাছ জন্মাতে চেয়েছিলেন। প্রতিদিন কাজের ফাঁকে দেখতেন কোনো বীজ অঙ্কুরিত হলো কি না। ফুল ফোটাতে পারেন বা না পারেন, সন্তানের দিকে নজর দিতে মোটেই ভুলবেন না। তারা কাগজের নয়, রক্তমাংসের। তাদের জন্যই মানবতার সংক্রমণ দিয়ে ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে হবে।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothomalo.com