পূর্ব ইউরোপের ন্যাটো সদস্যদের কি পুতিন ভাগিয়ে নিচ্ছেন

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবান
  ছবি: রয়টার্স

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিশ্চিত জানেন, ইউক্রেন নিয়ে চলমান উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যেও ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) তাঁর কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী ও সত্যিকারের বন্ধু আছে। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবান অবশ্যই তাঁদের একজন।

যখন প্রায় এক লাখ রুশ সেনা ভারী অস্ত্র নিয়ে ইউক্রেনের ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে, এতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ রাশিয়ার ওপর রাগে ফুঁসছে—ঠিক এমন সময়ে (১ ফেব্রুয়ারি) পুতিনের সঙ্গে আলাপ করার জন্য মস্কোতে উড়ে গেলেন ওরবান।

গত সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার গ্যাস কোম্পানি গাজপ্রমের সঙ্গে হাঙ্গেরির ১৫ বছরের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় ওরবানের মস্কো সফরের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহের মেয়াদ ও পরিমাণ আরও বাড়ানো যায় কি না, তা আলোচনা করতেই এ সফর। তবে হাঙ্গেরির সরকারবিরোধীরা ওরবানের সফরের সমালোচনা করে বলেছে, রাশিয়া যখন ইউরোপের নাকের ডগায় সেনা মোতায়েন করে ইউরোপকে হুমকি দিচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে ওরবান মস্কো সফর করে প্রকারান্তরে হাঙ্গেরির সাধারণ মানুষেরই বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।

কিন্তু ওরবান সে অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে জোর দিয়ে বলেছেন, তিনি দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং শান্তির কথা মাথায় রেখেই মস্কোতে গেছেন।

অনেকেরই মনে হতে পারে, ওরবান ক্রেমলিনের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্ককে পুঁজি করে নিজের ফায়দা হাসিলের আশায় আছেন এবং সে কারণেই তিনি ন্যাটো এবং ইইউর সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করছেন।

পূর্ব ইউরোপে ওরবানের মতো আরও কিছু নেতা থাকতে পারেন, যাঁরা মস্কোকে অসন্তুষ্ট না করার বিষয়ে সব সময় সতর্ক থাকেন। তবে এর অর্থ এই নয় যে ইউরোপের পূর্বাঞ্চলে ন্যাটো জোটের দুর্বলতা রয়েছে এবং সে কারণে ন্যাটোর রাশিয়াকে তোয়াজ করে চলতে হয়।

লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া—বাল্টিক অঞ্চলের এই তিন দেশ রাশিয়াকেও দ্ব্যর্থহীনভাবে একটি বড় হুমকি হিসেবে দেখে। বিশেষ করে ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেওয়ার পর তারা রাশিয়াকে আর বিশ্বাস করতে পারে না। এ কারণে ২০১৬ সাল থেকে তারা সাগ্রহে বহুজাতিক ন্যাটো বাহিনীকে স্বাগত জানিয়েছে।

মধ্য ইউরোপের বাকি অংশে, ওরবানের রাজনৈতিক খেলার অনুরণন আছে বলে মনে হয় না। পোল্যান্ডের রক্ষণশীল ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির সরকার প্রায়ই ইইউকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষেত্রে হাঙ্গেরির ওরবান সরকারের সঙ্গে যোগ দেয়। এ দুই সরকার বেশ ঘনিষ্ঠ মিত্র। কিন্তু ইউক্রেন ইস্যুতে পোলিশ সরকার রাশিয়ার তৎপরতাকে ভালোভাবে নেয়নি এবং মিত্র ওরবান মস্কো সফরকে ভালো চোখে দেখেনি। তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটোর দেওয়া কড়া প্রতিক্রিয়ার সবচেয়ে সোচ্চার সমর্থকদের মধ্যে অন্যতম। জার্মানি ইউক্রেনকে এ সংকটকালে অস্ত্র সরবরাহে অনাগ্রহ দেখানোয় পোলিশ সরকার জার্মানির কড়া সমালোচনা করেছে।

এ অঞ্চল থেকে ন্যাটোর সৈন্য এবং সামরিক সম্পদ সরিয়ে নেওয়ার যে দাবি মস্কো তুলেছে, তার পক্ষে ইউরোপের কোনো দেশের সমর্থন নেই। এমনকি হাঙ্গেরিও এ দাবি সমর্থন করে না। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, হাঙ্গেরির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বর্তমানে ইউক্রেনের সংকটের প্রতিক্রিয়া হিসেবে তাদের দেশে ন্যাটো বাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে আলোচনা করছে।

১ ফেব্রুয়ারি ওরবান যখন মস্কো যাচ্ছিলেন, তখন পোলিশ প্রধানমন্ত্রী মাতেউস মোরাউইকি ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে অবতরণ করেন এবং সেখানে তিনি রুশ বাহিনীকে প্রতিহত করতে ইউক্রেনীয় নাগরিকদের সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন।

অন্যদিকে রাশিয়ার প্রতি ভালোবাসা একেবারে হারিয়ে যায়নি, এমন আরেকটি দেশের নাম রোমানিয়া। তারাও রাশিয়ার হুমকির বিরুদ্ধে ন্যাটোর প্রতিক্রিয়ায় দৃঢ় সমর্থন দিয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট ক্লাউস ইওহানিস পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠার আগেই ইউক্রেনের মাটিতে আরও ‘আমেরিকান বুট’ মোতায়েনের আহ্বান জানিয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সম্প্রতি পূর্ব ইউরোপে প্রয়োজনে আরও সাড়ে আট হাজার মার্কিন সেনা মোতায়েন করা হতে পারে বলে যে ঘোষণা দিয়েছেন, তাকে প্রেসিডেন্ট ইওহানিস সাধুবাদ জানিয়েছেন।

লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া—বাল্টিক অঞ্চলের এই তিন দেশ রাশিয়াকেও দ্ব্যর্থহীনভাবে একটি বড় হুমকি হিসেবে দেখে। বিশেষ করে ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেওয়ার পর তারা রাশিয়াকে আর বিশ্বাস করতে পারে না। এ কারণে ২০১৬ সাল থেকে তারা সাগ্রহে বহুজাতিক ন্যাটো বাহিনীকে স্বাগত জানিয়েছে।

তবু ওরবান একা নন। এ অঞ্চলে আরও কিছু সরকার আছে, যারা পুতিনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে রাজি নয়। গত ২৫ জানুয়ারি ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোরান মিলানোভিচ বোমা ফাটানোর মতো একটি ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর দেশ ইউক্রেনকে সহযোগিতা করার জন্য ন্যাটোর সঙ্গে সামরিক অভিযানে অংশ নেবে না। তিনি ইউক্রেনকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। অবশ্য তার পরপরই ক্রোয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেজ প্লেনকোভিচকে বিবৃতি দিয়ে প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের ‘বিভ্রান্তিকর’ কথার ব্যাখ্যা করতে এবং ইউক্রেনের জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল।

বুলগেরিয়া আরেকটি উদাহরণ। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে, বুলগেরিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী স্তেফান ইয়ানেভ কৃষ্ণসাগরের এ দেশটিতে ন্যাটো মোতায়েনের বিরুদ্ধে লাগাতারভাবে বলে যাচ্ছেন। একটি টিভি সাক্ষাৎকারে ইয়ানেভ ঘোষণা করেছেন, ‘ইউক্রেন পরিস্থিতির অবনতি হলে বুলগেরিয়াকে বুলগেরিয়ান কমান্ডের অধীনে বুলগেরিয়ান বাহিনীই সুরক্ষিত করবে, বাইরের সেনা আমাদের দরকার হবে না।’

ন্যাটোর পূর্বাঞ্চলীয় সদস্যদের কিছু রাজনীতিবিদের এ ধরনের প্রকাশ্য ঘোষণা এবং রাজনৈতিক খেলা যা–ই হোক না কেন, ইউক্রেনের চারপাশে চলমান অচলাবস্থা মধ্য ও পূর্ব ইউরোপীয়দের কাছে ন্যাটোর সদস্যপদের মূল্য প্রমাণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের দ্বারা প্রসারিত নিরাপত্তা গ্যারান্টি যদি না থাকত, তাহলে সাবেক ওয়ারশ চুক্তির এ দেশগুলোকে হয়তো ইউক্রেনের মতোই দুর্দশার মুখোমুখি হতে হতো।

এটি পোল্যান্ড, রোমানিয়া এবং বাল্টিক দেশগুলোর ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তা তেমনই বুদাপেস্ট ও সোফিয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ওরবান নিঃসন্দেহে তাঁর জটিল খেলা চালিয়ে যাবেন। তিনি রাশিয়ানদের কাছ থেকে সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করবেন। তবে তিনি ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে না রাগিয়ে বরং তাদের নিরাপত্তাবলয়ে থেকেই তা করবেন।

বুলগেরিয়ান মন্ত্রিসভা রাশিয়াকে উত্তেজিত না করার জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে পারে। তবে এখনো আটলান্টিক জোটটি যে তার জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে, তা তাকে মাথায় রাখতে হচ্ছে।

এ কারণে এটি স্পষ্ট যে এখন যারা রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট না করার জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোট রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে শেষ পর্যন্ত তাদেরও পশ্চিমাদেরই সমর্থন করতে হবে। সে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • দিমিতার বেশেভ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অক্সফোর্ড স্কুল অব গ্লোবাল অ্যান্ড এরিয়া স্টাডিজের প্রভাষক