মেজর সিনহা হত্যা মামলার রায়, ওসি প্রদীপ এবং পুলিশের ভূমিকা নিয়ে নানান আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। অনেকেই প্রশ্ন করছেন, সিনহার নামের পাশে ‘মেজর’ না থাকলে এ মামলা কি আদৌ এত দ্রুত আলোর মুখ দেখত? কিংবা মামলার রায় কি এমনই হতো? নাকি যারা মামলা করেছে, উল্টো তাদের নামেই মামলা হতো?
বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে নানা সময় নানা মহলে আলোচনা হয়। মাঝেমধ্যে প্রশংসা হলেও বেশির ভাগ সময়ই সমালোচনামূলক প্রতিবেদনই আমরা জেনে থাকি। এ থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যেও একটা ধারণা তৈরি হয়েছে, যেটা হয়তো খুব একটা ভালো কিছু নয়। আমিও এর ব্যতিক্রম নই।
দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে থাকায় দেশের সার্বিক পরিস্থিতি হয়তো খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব নয় আমার জন্য। তবে নিয়মিত পত্রিকা পড়ে যা ধারণা পাই, তাতে আমারও মনে হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সাহায্য চাইলে হয়তো তা পাওয়া যাবে না কিংবা হিতে বিপরীত হতে পারে!
ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া যাব দিন দুয়েকের জন্য গবেষণাকাজে এবং বেড়াতেও। দেশে ট্রেনে ভ্রমণ করা হয় না অনেক দিন। তাই পরিবারের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ট্রেনে করে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা যাব। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ট্রেন ভেড়ামারা স্টেশনে গিয়ে পৌঁছাবে রাত ১২টায়। সঙ্গে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া আমার ভাগনিরাও যাচ্ছে। আমি বাদে আর সবাই মেয়ে। ভাবছিলাম, এত রাতে সেখানে পৌঁছালে তো সমস্যা। কারণ, ওই স্টেশন থেকে আমাদের যেতে হবে একটা গ্রামে। সেটিও প্রায় আধা ঘণ্টার পথ গাড়ি কিংবা অটোরিকশায় করে। এত রাতে এসব পাওয়া যাবে কি না কিংবা পেলেও ভাগনিদের নিয়ে সেখানে যাওয়া নিরাপদ হবে কি না, এই ভাবতে ভাবতে মনে হলো, আচ্ছা, এক কাজ করলে কেমন হয়, কুষ্টিয়া কিংবা ভেড়ামারা থানার পুলিশের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া যায় কি না।
কিন্তু আমি তো কাউকে চিনি না। বাংলাদেশে তো আবার চেনাপরিচিত না থাকলে কোথাও কোনো কাজ হয় না। যেহেতু অনেক দিন বিদেশে থাকি, তাই মনে হলো একবার দেখিই না তাদের কোনো ওয়েবসাইট আছে কি না। সেখানে কোনো তথ্য পাওয়া যায় কি না। খুঁজতেই পেয়ে গেলাম কুষ্টিয়ার এসপি (পুলিশ সুপারের) ই-মেইল অ্যাড্রেস। সঙ্গে সঙ্গেই একটা মেইল পাঠিয়ে দিলাম। বিস্তারিত জানিয়ে লিখেছি, এত রাতে পৌঁছাব, সঙ্গে আমার কম বয়সী অনেক ভাগনি থাকবে; আপনাদের থানা থেকে কোনো পুলিশ সদস্য কি আমাদের ওই গ্রাম পর্যন্ত একটু এগিয়ে দিয়ে আসবে পারবেন?
মেইল করে আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম কিছু হবে না। কেউ মেইল পড়বে না কিংবা পড়লেও নিশ্চয় আমার মতো অতি সাধারণ একজন নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য তারা ব্যস্ত হবে না। ই-মেইলে আমি আমার ফোন নম্বর দিয়েছিলাম। যেদিন যাব, বোধকরি ডিসেম্বরের ৫ তারিখ হবে, সেদিন সকালবেলা একজন ফোন করে জিজ্ঞেস করছে, ‘আপনারা কি আজ কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা আসছেন? সব প্ল্যান কি ঠিক আছে?’ আমি উল্টো প্রশ্ন করে জিজ্ঞেস করেছি, ‘আপনি কে?’
আমার ঠিক জানা নেই বাংলাদেশের কয়টা মানুষ ভালোভাবে জানে যে ওয়েবসাইট খুঁজে জেলা কিংবা থানাগুলোর এসপি বা ওসির ই-মেইল অ্যাড্রেস পাওয়া সম্ভব। কিংবা জানলেও তারা কি বিশ্বাস করে, উত্তর পাবে বা সাহায্য পাবে স্রেফ একটা ই-মেইল লেখার কারণে? আমার বেলায় কিন্তু সেটা হয়েছে। আমার মতো অতি সাধারণ মানুষ, যার কোনো চেনাজানা নেই, তার মেইলেরও উত্তর কিন্তু তারা দিয়েছে। এমনই তো হওয়া উচিত, যাতে দেশের মানুষ পুলিশকে ভয় না পায়।
এরপর যে উত্তর পেয়েছি, এর জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি বললেন, ‘আমি ভেড়ামারা থানা থেকে বলছি। আমাদের কুষ্টিয়া জেলার এসপি স্যার আমাকে ফোন করে বলেছেন, আপনারা আজ রাতে ভেড়ামারা আসবেন। আপনারা যে গ্রামে যাবেন, সেখানে যেন নিরাপদে পৌঁছে দিই। আমার থানা থেকে লোক থাকবে স্টেশনে। তারা আপনাদের পৌঁছে দেবে।’ এরপর তিনি কোনো গ্রামে যাব ইত্যাদি বিস্তারিত তথ্য নিয়ে রাখলেন। সেদিন ট্রেন পৌঁছাতে দেরি করেছিল। ভেড়ামারা পৌঁছাতে রাত প্রায় একটা বেজে গিয়েছিল। পুলিশ সদস্যরা সেখানে ছিলেন এবং আমাদের নিরাপদে ভেড়ামারা থানার গোলাপনগর বাজারের ফকিরাবাদ গ্রামে পৌঁছে দিয়েছেন। আমি সেখানে গিয়েছিলাম কিছু গবেষণাকাজে।
ঢাকায় ফিরে এসে নাখালপাড়ার রাস্তায় হাঁটছি; হঠাৎ একদিন পরিচয় হলো একটা ফটোকপির দোকানের ঠিক সামনে টেবিল নিয়ে বসে থাকা ২০ থেকে ২২ বছর বয়সী একটা ছেলের সঙ্গে। ছেলেটা টেবিল নিয়ে বসে আছে। সঙ্গে একটা ল্যাপটপ ও প্রিন্টার। কেউ কম্পিউটার কম্পোজ কিংবা প্রিন্ট করতে চাইলে করে দিচ্ছে। কম বয়সী ছেলেটাকে দেখে মনে হলো জিজ্ঞাসা করি, এটাই কি তার পেশা নাকি সে পড়াশোনাও করে। তার সঙ্গে পরিচিত হলাম। ঢাকায় এসেছে পড়াশোনা করার জন্য। অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ছাত্র অবস্থায় নিজের খরচ নিজেই চালাচ্ছে। সম্ভব হলে মা–বাবার জন্যও কিছু করার চেষ্টা করছে। ছেলেটা পড়াশোনা করা অবস্থায় রাস্তার সামনে টেবিল নিয়ে বসে কাজ করছে; এতটুকু সংকোচ নেই। বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে কথা বলছিল। ওমর নামের এই ছেলেকে দেখেই মনে হচ্ছিল, তারুণ্যের একটা আলাদা উচ্ছলতা আছে। কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘পড়াশোনা শেষে কী করতে চাও?’ ছেলেটা বলেছে, সে পুলিশের এসআই হতে চায়। আমি পাল্টা জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন এসআই হতে চাও?’উত্তরে সে বলল, ‘আমাদের গ্রামের কেউ এখন পর্যন্ত পুলিশ হতে পারেনি। আমি পুলিশ হলে মানুষ আমাকে ভয় পাবে। তা ছাড়া পুলিশের অনেক অর্থ ও ক্ষমতাও থাকে।’
আমি এরপর তাকে বলেছি, ‘তুমি তো ছোটখাটো ব্যবসা করছ এখন। পড়াশোনা শেষ করে তো ব্যবসাটাকে আরও বড় করতে পারো। ব্যবসা করেও তো ধনী হওয়া সম্ভব।’ কিন্তু সে পুলিশই হতে চায়। কারণ, তার ক্ষমতা দরকার। যাতে মানুষ তাকে ভয় পায়।
পুলিশ হলে তার অনেক অর্থ থাকবে। ক্ষমতা থাকবে। মানুষ তাকে ভয় পাবে। কম বয়সী এই ছেলের মনে এ ধারণা কে ঢুকিয়েছে? নিশ্চয় আমাদের সমাজ এবং সমাজের মানুষ, যেখানে তারা দেখেছে, ওসি প্রদীপের মতো মানুষ বছরের পর বছর ধরে অন্যায় করেও পার পেয়ে গিয়েছেন। তিনি তাঁর কাজের জন্য পুরস্কারও পেয়েছিলেন। সিনহার নামের পাশে ‘মেজর’ না থাকলে হয়তো আজও ওসি প্রদীপ ‘বীর’ই থাকতেন। এসব দেখে হয়তো ওমরের মতো তরুণেরা পুলিশ হতে চায়। ক্ষমতা পেতে চায়। মানুষ যাতে তাদের ভয় পায়।
কিন্তু হওয়ার তো কথা ছিল উল্টো। পুলিশকে মানুষ নিজেদের বন্ধু ভাববে। বিপদে পড়লে তাদের কাছে সাহায্য চাইবে। ঠিক যেমনটা আমি চেয়েছিলাম কুষ্টিয়ার এসপিকে ই-মেইল করে। কেন আমাদের পুলিশ বাহিনী সামগ্রিকভাবে এমন হয় না? কেন আমরা ভাবতে পারি না, তারা সব সময় আমাদের বিপদে এগিয়ে আসবে। আমাদের সাহায্য করবে। তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে আমাদের নিরাপদে রাখবে। কেন আমরা তাদের ভয় পাব?
আমার ঠিক জানা নেই বাংলাদেশের কয়টা মানুষ ভালোভাবে জানে যে ওয়েবসাইট খুঁজে জেলা কিংবা থানাগুলোর এসপি বা ওসির ই-মেইল অ্যাড্রেস পাওয়া সম্ভব। কিংবা জানলেও তারা কি বিশ্বাস করে, উত্তর পাবে বা সাহায্য পাবে স্রেফ একটা ই-মেইল লেখার কারণে? আমার বেলায় কিন্তু সেটা হয়েছে। আমার মতো অতি সাধারণ মানুষ, যার কোনো চেনাজানা নেই, তার মেইলেরও উত্তর কিন্তু তারা দিয়েছে। এমনই তো হওয়া উচিত, যাতে দেশের মানুষ পুলিশকে ভয় না পায়।
ঢাকায় ফিরে এসে আমি কুষ্টিয়ার এসপিকে ধন্যবাদ জানিয়ে আরেকটা মেইল লিখেছিলাম। সেদিন বিকেলে কুষ্টিয়া থেকে একজন এসআই আমাকে ফোন করেছিলেন। তাঁর নামটা আমি আর মনে করতে পারছি না। আমি সেই মেইলে লিখেছিলাম, ‘ধন্যবাদ আপনাদের। বাংলাদেশ পুলিশ সম্পর্কে কিছুটা হলেও আমার ধারণা বদলে দেওয়ার জন্য।’ সেই এসআই আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘আমাদের স্যার বলেছেন, আপনাকে বলতে, আপনাকেও ধন্যবাদ বাংলাদেশ পুলিশ সম্পর্কে কিছুটা হলেও আপনার ধারণার পরিবর্তন হওয়ার জন্য।’
কিন্তু ওমর নামের যে ছেলেটা ক্ষমতার জন্য, মানুষ তাকে ভয় পাবে, এ জন্য পুলিশ হতে চাইছে এবং তার মতো এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েগুলোর জন্য এমন হাজারটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে, যাতে তাদের ধারণারও পরিবর্তন হয়। আর সেটা বাংলাদেশ পুলিশকেই করতে হবে। ভালো দৃষ্টান্ত তো খুব একটা আমাদের সামনে নেই। বর্তমান দৃষ্টান্তগুলো হচ্ছে ভয়ের, গুমের কিংবা ইয়াবার! এর পরিবর্তন পুলিশ বাহিনীকেই করতে হবে।
ড. আমিনুল ইসলাম, এস্তনিয়ায়ন এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটির ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড ইনোভেশন বিভাগের সিনিয়র লেকচারার।
ই-মেইল: aminulislam1255@yahoo.com