অনেক দিন আগে পুলিশ সম্পর্কে একটি গল্প শুনেছিলাম। গল্পটি এ রকম, পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল তল্লাশি করতে গেছে। তল্লাশির সময় কয়েকজন পুলিশ সন্দেহভাজন একজন ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কী পড়ো? ছাত্র উত্তর দিল, ‘আমি এমবিএ পড়ি।’ পুলিশ তখন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে ছাত্রের কলার ধরে বললেন, ‘ফাজলামো করো আমাদের সাথে! এমএ আর বিএ তুমি একসঙ্গে পড়ো? মনে করো আমরা কিছুই বুঝি না!’ গল্পটিকে আমি নিছক গল্পই মনে করেছিলাম। কিন্তু আমি এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে ওটি আসলে বাস্তব ঘটনা ছিল। সেদিন (১৭ মে ২০১৫) প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় বক্স করা একটি প্রতিবেদন দেখে আমার বিশ্বাস আরও বদ্ধমূল হয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র নয়ন বাছারকে (বাছার তাঁর বংশের উপাধি) ‘বাশার’ বানিয়ে পুলিশ তাঁকে হিন্দু থেকে মুসলমানে রূপান্তরিত করেছে। অতঃপর তাঁকে শিবির বানিয়ে পায়ে শটগান ঠেকিয়ে গুলি করেছে দু-দুবার। নয়ন বাছার তিন মাস ধরে পঙ্গু হাসপাতালে পুলিশি প্রহরায় চিকিৎসাধীন আছেন। স্বস্তির খবর হচ্ছে, এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরদিনই ঢাকার দায়রা আদালত নয়নের জামিনের আদেশ দেন।
নয়ন বাছারের ঘটনাটি পড়ে সঙ্গে মনে পড়ল বিশ্বজিতের ঘটনা, যাকে ওই পুরান ঢাকায় সন্ত্রাসীরা শত শত লোক ও পুলিশের সামনে পিটিয়ে ও চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। কাকতালীয়ভাবে বিশ্বজিৎ ও নয়ন দুজনেই হিন্দু সম্প্রদায়ের। আরও মনে পড়ল লিমনের কথা, ডাকাত সন্দেহে র্যাব যার পায়ে গুলি করেছিল।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজটি অত্যন্ত কষ্টসাধ্য, ঝুঁকিপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং। এ কাজ করতে গিয়ে কিছু ভুলভ্রান্তি বা ত্রুটিবিচ্যুতি হতেই পারে। যদি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হতো, তাহলে মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম। কিন্তু ঘটনা তো একটি নয়, শত শত, যেটিকে নির্দ্বিধায় ‘সিস্টেমেটিক ভায়োলেশন অব হিউম্যান রাইটস বাই পুলিশ’ বলতে পারি। আর শত বছর ধরে চলা এই পুলিশ ‘অ্যাটোরসিটি’ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন। ওই আইনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের নির্যাতনে কারও ÿক্ষতি হলে তার জন্য দায়ী সদস্যের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। ওই একই আইনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে কারও মৃত্যু হলে দায়ী সদস্যের জন্য রয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান।
শুধু আইন করে পুলিশ ও র্যাবের নির্যাতন বন্ধ করা যাবে না, বা থামানো যাবে না। এ জন্য সরকার ও নীতিনির্ধারকদের সদিচ্ছা প্রয়োজন। পুলিশের মধ্যে এমন কিছু মৌলিক পরিবর্তন ও যুগোপযোগী সংস্কার দরকার, যাতে এ বাহিনী দীর্ঘদিনের ইমেজ সংকট কাটিয়ে জনবান্ধব হয়ে উঠতে পারে। প্রথম নজর দেওয়া দরকার মাঠপর্যায়ের ওসি থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত। কেননা, চোর-ডাকাত ধরা থেকে শুরু করে নাগরিক ও সড়কের নিরাপত্তা বিধান ও মিছিল-সমাবেশের শান্তি রক্ষার দায়িত্ব এই নিম্নস্তরের পুলিশ কর্মকর্তাদের ওপর ন্যস্ত।
পুলিশকে জনবান্ধব করার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে শিকড় পর্যায়ের পুলিশের নিয়োগকে পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত করা এবং ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ ও মনিটরিংয়ের মধ্য দিয়ে তাদের কাছ থেকে জনগণের সেবা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা। পত্রপত্রিকা এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার রিপোর্টের দিকে নজর দিলে যে কেউই সহজে বুঝতে পারবেন যে, পুলিশের দ্বারা যে নির্যাতনের ঘটনাগুলো ঘটে এবং হেফাজতে যে মৃত্যু হয়, তার অধিকাংশের জন্য দায়ী এই মাঠপর্যায়ের পুলিশ।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ২০০৯-১৩ মেয়াদের সরকারের সময় একবার ওসিদের জায়গায় এএসপিদের (বিসিএস উত্তীর্ণ পুলিশ কর্মকর্তা) প্রতিস্থাপনের চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু পরাক্রমশালী ওসিদের কারণে নাকি সে উদ্যোগ ভেস্তে যায়। অথবা তার কারণ হয়তো আরও গভীরে। ওসিদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মন্ত্রী ও এমপিদের কায়েমি স্বার্থই শেষ অবধি ওই উদ্যোগকে সফল হতে দেয়নি। আমার এক সাবেক ছাত্র, যে কিনা এখন এএসপি হিসেবে কর্মরত, সে একবার দুঃখ করে বলছিল, ‘স্যার জানেন, ওসিরা আমাদের কথা শোনে না। কারণ, ওদের সঙ্গে মন্ত্রী ও এমপিদের সরাসরি সম্পর্ক।’
দ্বিতীয়ত, যে বিষয়ে পুলিশের নজর দেওয়া দরকার সেটি হচ্ছে শিকড় পর্যায়ের পুলিশের মোটিভেশন ও প্রশিক্ষণ। গত কয়েক বছরে যে বিষয়ে আমাদের খটকা লেগেছে, সেটি হচ্ছে, যে সময়ে পুলিশের সক্রিয় হওয়ার কথা, অপরাধ প্রতিরোধে তৎপর হওয়ার কথা, তখনই পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নির্লিপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। আর যখন তাদের নিষ্ক্রিয় থাকার কথা, একটু সহিষ্ণু ও কৌশলী হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার কথা, তখনই তারা প্রবল পরাক্রম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন নিরীহ মানুষের ওপর। আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি ন্যায্য দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য আন্দোলনরত নিরীহ শিক্ষকদের ওপর পুলিশের পেপার স্প্রে নিক্ষেপের কথা। আর দিন কয়েক আগে নারী লাঞ্ছনার প্রতিবাদে সমবেত ছাত্রীদের ওপর পুরুষ পুলিশের বীরত্ব তো (!) আমরা দেখলাম। কিন্তু অভিজিৎকে যখন ঘাতকেরা কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে, পুলিশ তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, তাদের প্রাণরক্ষারও চেষ্টা করে না, অথবা ঘাতকদের ধরার জন্যও তৎপর হয় না। পাঠক নিশ্চয়ই ভুলে যাননি, আমিনবাজারে পুলিশের চোখের সামনে গ্রামবাসী ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল ছয়-ছয়জন কলেজছাত্রকে।
২০১৩ সালে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি যখন পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ শুরু করে, তখন আমরা পুলিশকে পড়ে পড়ে মার খেতে দেখেছি। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আক্রান্ত পুলিশের শরীর থেকে রক্ত ঝরেছে। টেলিভিশনের পর্দায় ওই দৃশ্য দেখে আমরা সমব্যথী হয়েছি। আমরা বেদনার্ত ও আতঙ্কিত হয়েছি যখন দেখেছি, পুলিশ বাহিনীর একজন সদস্য আক্রান্ত হলে তাঁর সঙ্গে থাকা অন্য সদস্যরা তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসছেন না।
রাজশাহীতে একজন আক্রান্ত পুলিশকে উদ্ধার করেছিলেন অসম সাহসী এক নারী। এ বছরের ৫ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া পেট্রলবোমা হামলার সময়ও পুলিশকে যথেষ্ট সক্রিয় ও তৎপর দেখা যায়নি, অথচ কথায় তাঁরা উড়িয়ে দিয়েছেন রাজা-উজির-নাজির—সব! আমরা পুলিশ প্রশিক্ষণের এই মারাত্মক ঘাটতির অবসান চাই। আমরা চাই, পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের এমন প্রশিক্ষণ দেওয়া হোক, যাতে করে তারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির সশস্ত্র আক্রমণ মোকাবিলা করতে পারে, কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করতে পারে পেট্রলবোমা সন্ত্রাসীদের।
জনগণ দেখতে চায়, বিশ্বজিৎ, অভিজিৎ এবং নিরীহ কলেজছাত্ররা যেন পুলিশের চোখের সামনে আর খুন না হন। আমরা চাই, পুলিশ যেন শিক্ষকদের ওপর পেপার স্প্রে নিক্ষেপ না করে, নিরীহ মানুষকে হেনস্তা না করে, বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে না পড়ে অসহায় নারীদের ওপর। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি, সেই রাষ্ট্রের জনগণের মানবাধিকার রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। সে কথাটি সম্যকভাবে বুঝতে হবে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। আর ওই উপলব্ধির আলোকেই আমল করতে হবে।
শেখ হাফিজুর রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক, মানবাধিকার ও অপরাধবিজ্ঞান গবেষক।