মতামত

পুরোনো সমস্যা খুঁজে বের করতে নতুন কমিটি!

চলতি বছরে বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই চার দফা বৃষ্টিতে নগরের বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে যায়। এরপরও সিটি করপোরেশন ও সিডিএ দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়নি
ফাইল ছবি

সাধারণ নগরবাসীর কথা বাদই দিলাম, খোদ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর বাড়িটি জলমগ্ন ছিল তিন দিন। বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই টানা ছয় দিনের বৃষ্টিপাতে চট্টগ্রামের অন্তত ৬০ শতাংশ এলাকা তলিয়ে গেছে। অতঃপর বৃষ্টি থেমেছে, কিন্তু পানি নামেনি। ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?’ এই প্রশ্নের উত্তরও যেন পাওয়া গেল বহদ্দারহাটে মেয়র মহোদয়ের পানিতে ডোবা বাড়িটি দেখে। এতে জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন সংস্থার হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পও প্রশ্নবিদ্ধ হলো আরও একবার।

জলাবদ্ধতার কারণ খুঁজে বের করতে সম্প্রতি চার সদস্যের কমিটি গঠন করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এখন সংস্থা দুটি বলছে, পানি নিষ্কাশনের সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করা হবে। নগরবাসী সবিস্ময় জানতে চায়, তাহলে এতকাল তারা কী করল? নতুন কমিটি ৭ থেকে ১০ দিন তদন্ত করে এমন কী রহস্য উদ্‌ঘাটন করবে, যা আগে জানা ছিল না? কমিটির সুপারিশেও বা কী এমন জাদু থাকবে যে সেই ফর্মুলা প্রয়োগ করে ‘পানি নিষ্কাশনের সব বাধা’ অপসারণ করা হবে?

পানি নিষ্কাশনের সব প্রতিবন্ধকতা অপসারণের ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়ে মেয়র বলেছেন, ‘পানি নিষ্কাশনের বাধাগুলো দূর করলে জনগণের ভোগান্তি কমে যাবে।’ পানি নিষ্কাশনের বাধা দূর হলে যে ভোগান্তি কমবে, এ কথা জানতে তো বিশেষজ্ঞ হতে হয় না, প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি নিজেই বা এ তথ্য এত দিন পরে জানলেন কেন?

এবারের বর্ষায় জলাবদ্ধতা তীব্র হবে, জনগণের ভোগান্তি বাড়বে, এমন আশঙ্কা আগেই করা হয়েছিল। কারণ, চলতি বছরে বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই চার দফা বৃষ্টিতে নগরের বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে যায়। এরপরও সিটি করপোরেশন ও সিডিএ দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অবশ্য একেবারেই কিছু করেনি বললে পুরোটা বলা হয় না। করেছে; এ দুটি সংস্থা সচরাচর যা করে থাকে, পরস্পরকে দোষারোপ করেছে। সাম্প্রতিক জলাবদ্ধতার পর কারণ খোঁজার জন্য যে রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়েছে, সেখানে দোষারোপের নাটকটি আরও একবার অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জেনেছি আমরা। সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতিকে জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী করেছেন আর সিটি করপোরেশন সচিব এর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, সব ঠিকমতোই চলছে। এসব কূটতর্কের কোনো মীমাংসা নেই, জনগণের ভোগান্তিরও শেষ নেই।

বিত্তহীন বা নিম্নবিত্তের লোকজন বাস করে ছোট ছোট পাহাড়ের ঢালে আর উচ্চবিত্তের মানুষেরা কাটেন বড় বড় পাহাড়, সেখানে তৈরি হয় বহুতল ভবন। চারপাশে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে যেসব পাহাড় কাটা হয়, সেখানে মাঝেমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর হানা দেয় বটে, কিন্তু নগদ কিছু জরিমানা আদায় করেই দায়িত্ব শেষ করে। জরিমানা গুনেও পাহাড় কাটা থামে না। এমনকি কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজও শুরু হয়।

বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ১০ হাজার ৯২১ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলছে। সিডিএ, সিটি করপোরেশন ও পাউবো এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। আগেই বলেছি, প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব তো আছেই, তদুপরি আছে সংস্থাগুলোর মধ্যে অসহযোগিতা বা বিরোধিতা। এর আগে সিটি করপোরেশনের মেয়র সিডিএকে খাল খনন প্রকল্পে দেওয়া বাঁধগুলো তুলে নিতে বলেছিলেন। প্রথম দিকে এ ব্যাপারে সিডিএ সাড়া না দিলেও পরে কিছু কিছু বাঁধ অপসারণ করেছিল। কিন্তু এখনো কিছু বাঁধ রয়ে গেছে। সিডিএ কাজের ধারাবাহিকতার জন্যই এসব বাঁধ দিয়েছিল। কিন্তু কথা হচ্ছে, বর্ষার ভরা মৌসুমে এসব বাঁধ তো পানি নিষ্কাশনে বাধা সৃষ্টি করবেই। ২০২০ সালে সিডিএর প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা থাকলেও, দুই বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তা হলো না কেন, তার উত্তর দেবে কে?

অন্য দিকে সিটি করপোরেশনকে বহদ্দারহাট থেকে বারইপাড়া পর্যন্ত তিন কিলোমিটার খাল খননের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ২০১৪ সালে। এত দিনেও সেই খাল কাটার উদ্যোগ নেওয়া হলো না কেন? এই খাল খনন হলে বাকলিয়া, বহদ্দারহাট ও চান্দগাঁওবাসী জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে রেহাই পেত। ভূমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত জটিলতার কথা বারবার আওড়ালে খোদ মেয়র ও করপোরেশনের যোগ্যতা ও সক্ষমতা নিয়েই তো প্রশ্ন উঠবে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যাপারটি নেহাত অপ্রাসঙ্গিক নয়। সিটি করপোরেশন পাইলট প্রকল্প হিসেবে চারটি বড় বাজারকে পলিথিনমুক্ত করেছে। সেসব বাজারে নিয়মিত কাপড়ের ছোট-বড় থলের ব্যবহার খুবই সুন্দর ও উত্সাহব্যঞ্জক একটি উদাহরণ। কিন্তু পথে-ঘাটে অজস্র বাজার ও দোকানে অবাধে অজস্র পলিথিনের ব্যবহার ঠেকানোর কেউ তো নেই। এই ব্যবহার বন্ধ করতে হলে নগরে পলিথিন উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করতে হবে।

জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ পাহাড় কাটা। পাহাড় কাটার ফলে একদিকে ভূমিধসে প্রাণহানির ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি পানির ঢলের সঙ্গে নেমে আসা পাহাড়ি মাটি ও বালু জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ। এ বছর বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই পাহাড়ধসে চট্টগ্রামে দুই যমজ শিশুর মা, দুই সহোদর ভাইসহ বেশ কয়েকজনের করুণ মৃত্যু ঘটেছে। এই হতভাগ্যরা পাহাড়ের ঢালে বাড়িঘর নির্মাণ করে বা ঘর ভাড়া নিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস করত। দুর্ঘটনার পর এবারও যথারীতি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়েছে, দু-একটি বাড়িঘর ভেঙে ফেলাও হয়েছে। কিন্তু কারা এসব বাড়িঘর নির্মাণ করে, সেখানে পানি বা বিদ্যুতের সংযোগ দিয়ে দরিদ্র-অসহায় মানুষদের বস্তি গড়ে তোলে, সে বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া, তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করার কাজটি কখনো হয় না। ক্ষমতাসীন দলের লোকজন, এমনকি ওয়ার্ড কাউন্সিলররা পর্যন্ত এই কাজের সঙ্গে জড়িত। এদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া না গেলে এই সমস্যারও স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।

বিত্তহীন বা নিম্নবিত্তের লোকজন বাস করে ছোট ছোট পাহাড়ের ঢালে আর উচ্চবিত্তের মানুষেরা কাটেন বড় বড় পাহাড়, সেখানে তৈরি হয় বহুতল ভবন। চারপাশে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে যেসব পাহাড় কাটা হয়, সেখানে মাঝেমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর হানা দেয় বটে, কিন্তু নগদ কিছু জরিমানা আদায় করেই দায়িত্ব শেষ করে। জরিমানা গুনেও পাহাড় কাটা থামে না। এমনকি কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজও শুরু হয়। বহুতলের নির্মাতারা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র বা সিডিএর অনুমোদন কী করে পায়, তা-ও এক বড় রহস্য।

যা-ই হোক, অতিবর্ষণের পর নগর ডোবার কারণ খুঁজতে ‘উচ্চপর্যায়ের’ কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাঁরা নতুন কোনো কারণ খুঁজে পেলেন কি না জানার জন্য ৭-১০ দিন অপেক্ষা করতে হবে, আর পুরোনো কারণগুলো নিরসনে সিটি করপোরেশন ও সিডিএ নতুন কী উদ্যোগ নেয়, সেটাও দেখার বিষয়।

  • বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক

    bishwabd@yahoo.com