পুরোনো পথে নতুন গন্তব্যে যেতে পারবে না ইসি

অনেক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন গঠনের পর অনেকেই মনে করেছিলেন যে নতুন কমিশন এমন কিছু সাহসী উদ্যোগ নেবে, যাতে কমিশন ও আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর বিরাজমান আস্থার সংকট কাটবে। একই সঙ্গে আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে জনমনে আশাবাদ সৃষ্টি হবে। আসন্ন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কিছু বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়ে কমিশন সে আশাবাদ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আউয়াল কমিশন যেন পুরোনো পথেই হাঁটছে। এটি কারও অজানা নয় যে পুরোনো পথে হাঁটলে নতুন গন্তব্যে পৌঁছা যাবে না।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে দায়িত্ব গ্রহণের পর বর্তমান কমিশন যে কটি দৃশ্যমান কাজ করেছে, তার প্রায় সব কটিই ছিল গতানুগতিক, ছকবাঁধা। কমিশনের প্রথম উদ্যোগ ছিল কয়েকটি সংলাপের আয়োজন করা। সমাজের নানা ক্ষেত্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে এনে গণমাধ্যমের উপস্থিতিতে বক্তৃতার সুযোগ করে দিলে সংলাপ হয় না। সংলাপের উদ্দেশ্য সমস্যার সমাধান, চটকদার বক্তৃতা প্রদান নয়। এটি সাধারণত করা হয় পর্দার অন্তরালে, সময় নিয়ে। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সংলাপে যেসব কথা বলেছেন, সেসব কথা কি কমিশনের সদস্যদের অজানা? তাঁরা তো মঙ্গল গ্রহ থেকে আসেননি! এসব গুরুত্বপূর্ণ কথা আগেও নির্বাচন কমিশনের সংলাপে কিংবা গণমাধ্যমে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা বহুবার বলেছেন। আগের সংলাপের কার্যবিরণীতেও এর অনেকগুলোই লিপিবদ্ধ আছে।

সম্প্রতি কমিশন আরেকটি কাজ শুরু করেছে, তা হলো ইভিএমের পক্ষে প্রচারণা। আমরা আশাবাদী হয়েছিলাম, যখন সিইসি বলেছিলেন যে খোলামন নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে কমিশন ইভিএম সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু তা করার আগেই কমিশন কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর কারণ আমাদের কাছে বোধগম্য নয়।

আমরা আশা করেছিলাম, নিরপেক্ষ জুরি হিসেবে পাঁচজন কমিশনার, প্রযুক্তিবিদসহ অন্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে নীরবে-নিভৃতে আলাপ-আলোচনা এবং কিছু তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে ইভিএম ব্যবহার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন। কিন্তু দুজন কমিশনার ইতিমধ্যে ইভিএমের পক্ষে সাফাই গাওয়া শুরু করেছেন। সম্প্রতি কমিশনার আনিছুর রহমান বর্তমান ইভিএমকে পৃথিবীর সেরা যন্ত্র বলে সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন। কমিশনার আহসান হাবিব খানের মতে, ইভিএম নয়, ভোটকেন্দ্রে ‘ডাকাতই’ সমস্যা। এটি সুস্পষ্ট, এই দুজন কমিশনার এরই মধ্যে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের আগেই ইভিএমের পক্ষে রায় দিয়ে দিয়েছেন।

কমিশন প্রধান নির্বাচনী আইন আরপিও বাস্তবায়নেও কঠোরতা প্রদর্শন করছে না। এ ছাড়া যেসব কর্মকর্তা প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ করা জনগণের অর্থ অতীতে লোপাট করেছেন কিংবা নানা পক্ষপাতদুষ্ট আচরণে লিপ্ত হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও কমিশন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। মনে হয় যেন সবকিছুই প্রায় ‘বিজনেস অ্যাজ ইউজুয়াল’, যা করে জনগণের আস্থা অর্জন করা যাবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।

আমরা আরও আশা করেছিলাম যে কয়টি ক্ষেত্রে ইভিএম ব্যবহারে সমস্যা হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে কমিশন তদন্ত করে সমস্যার কারণ উদ্‌ঘাটন করবে। যেমন গত নির্বাচনে পেপার ব্যালটে ভোট নেওয়া আসনগুলোতে ভোট পড়ার হার ছিল ৮০ দশমিক ৮০ শতাংশ। পক্ষান্তরে যে ছয়টি আসনে ইভিএম ব্যবহৃত হয়েছে, সেখানে ভোট পড়ার হার ছিল ৫১ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং একটি আসনে এটি ছিল মাত্র ৪৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। তাহলে ইভিএম কি ভোটারদের ভোট দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে? নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীও এমন অভিযোগই তুলেছিলেন। যদি তা–ই হয়, তাহলে ভবিষ্যতে ইভিএম ব্যবহার কোনোমতেই সমীচীন হবে না। এ ছাড়া গত জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা আসনে ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে নির্বাচনী কর্মকর্তাকে ইভিএম ওভাররাইট করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, যার মানে নির্বাচনী কর্মকর্তার পক্ষে ২৫ শতাংশ ভোট নিজের পছন্দমতো প্রার্থীকে দেওয়া সম্ভব ছিল। বিষয়টিও তদন্ত করার দাবি রাখে।

এ ছাড়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অন্তত দুবার ভোটের ফলাফল ঘোষণা করা হয়, যা ডিজিটাল জালিয়াতির সুস্পষ্ট আলামত। উপরন্তু নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তৈমুর আলম খন্দকার ডিজিটাল কারসাজির অভিযোগ তুলেছেন, যদিও সে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। এ বিষয়ও খতিয়ে দেখা দরকার। তবে বর্তমান ইভিএমে ভোটার ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) না থাকার কারণে ভোটের ফলাফল পুনর্গণনা করা সম্ভব হবে না। আর এ কারণেই নির্বাচন কমিশনের গঠিত কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির প্রধান হিসেবে প্রযুক্তিবিদ প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরী বর্তমান ইভিএম কেনার সুপারিশে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিলেন। উল্লেখ্য, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তাদের ইভিএমে ভিভিপিএটি যুক্ত করতে নির্বাচন কমিশন বাধ্য হয়।

সবচেয়ে হতাশাব্যঞ্জক হলো যে নীরবে-নিভৃতে তাঁদের মতামত নেওয়ার পরিবর্তে নির্বাচন কমিশন গত ২৫ মে কয়েকজন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে একটি মিডিয়া ইভেন্টের আয়োজন করে। সে অনুষ্ঠানে অধ্যাপক জাফর ইকবাল বর্তমান ইভিএমকে অত্যন্ত চমৎকার মেশিন বলে দাবি করেন, যদিও মার্চ মাসে সংলাপের সময় তিনি এই ‘ইভিএমের টেকনোলজিতে খুবই লো লেভেলের’ বলে মতামত দিয়েছিলেন। তবে অধ্যাপক কায়কোবাদ মত দিয়েছেন যে মেশিনকে শতভাগ বিশ্বাস করা যায় না। তাঁর এ দাবি যৌক্তিক, কারণ সফটওয়্যার দ্বারা পরিচালিত সব যন্ত্রকেই প্রযুক্তির সহায়তায় নানাভাবে পরিচালনা করা যায়। এ ক্ষেত্রে মেশিনের পেছনের মানুষগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের দেশে একসময় সাধারণ ব্যালট বাক্স দিয়েই, এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এখন স্বচ্ছ বাক্স, এমনকি যন্ত্রের সহায়তায়ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, কমিশনে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই এখন বড় প্রশ্ন রয়েছে।

এবার আসা যাক কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে, যা সুষ্ঠু হবে প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায়। কারণ, এতে সরকার লাভবানই হবে। তবে এখানেও কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু করার আছে। এখানেও মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামার মাধ্যমে তথ্য জমা দিয়েছেন। এসব তথ্য প্রদানের উদ্দেশ্য ভোটারদের তথ্য দিয়ে ক্ষমতায়িত করা, যাতে তাঁরা জেনে–শুনে-বুঝে সঠিক ব্যক্তিদের পক্ষে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। প্রার্থীরা যদি তথ্য গোপন করেন বা ভুল তথ্য দেন, তাহলে ভোটাররা ক্ষমতায়িত হওয়ার পরিবর্তে বিভ্রান্ত হন। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের মতে, এসব নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না, নিরপেক্ষও হয় না। এ কারণেই হলফনামায় ভুল তথ্য দিলে বা তথ্য গোপন করলে প্রার্থীদের প্রার্থিতা, এমনকি নির্বাচিত হলে নির্বাচনও বাতিল হতে পারে। তাই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলফনামাগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা। আমরা আউয়াল কমিশনের কাছে কুমিল্লার নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামাগুলো যাচাই-বাছাই করার দাবি করেও কোনো সাড়া পাইনি। অতীতের কমিশনও সেটি করেনি।

আমরা অতীতে দেখেছি, সিটি করপোরেশনের ঠিকাদারেরাও নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন, যদিও তাঁরা তা আইনানুযায়ী করতে পারেন না। বিষয়টিও খতিয়ে দেখার জন্য আমরা কমিশনের কাছে দাবি করেছিলাম এবং অতীতের কমিশনের মতো বর্তমান কমিশনও এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্বিকার ভূমিকা পালন করছে। আমাদের উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী, সুষ্ঠু নির্বাচনের খাতিরে কমিশন ‘বিধিবিধানের সঙ্গে সংযোজনও করতে পারে।’

নির্বাচন কমিশন জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য কিছু সাহসী সিদ্ধান্তও নিতে পারত। আরপিও অনুযায়ী, কোনো নিবন্ধিত দলের গঠনতন্ত্রে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিধান থাকতে পারে না, অর্থাৎ নিবন্ধিত দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন থাকা বেআইনি। এর উদ্দেশ্য হলো লেজুড় ছাত্রসংগঠনগুলোর তাণ্ডব বন্ধ করা, যা আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সন্ত্রাসের আখড়ায় পরিণত করেছে এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের গঠনতন্ত্র থেকে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিধান বাদ দিলেও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বলে তাদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করছে এবং তাদের অনৈতিক ও অপরাধী কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। আরও অব্যাহত রেখেছে তাদের বিদেশি শাখা, যেগুলো থাকাও নিবন্ধিত দলের জন্য বেআইনি। অর্থাৎ কমিশন প্রধান নির্বাচনী আইন আরপিও বাস্তবায়নেও কঠোরতা প্রদর্শন করছে না। এ ছাড়া যেসব কর্মকর্তা প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ করা জনগণের অর্থ অতীতে লোপাট করেছেন কিংবা নানা পক্ষপাতদুষ্ট আচরণে লিপ্ত হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও কমিশন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। মনে হয় যেন সবকিছুই প্রায় ‘বিজনেস অ্যাজ ইউজুয়াল’, যা করে জনগণের আস্থা অর্জন করা যাবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।

  • বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)