আফগানিস্তান নিয়ে সব বুদ্ধিবৃত্তিক কসরত শেষ হয়েছে। এসব প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে প্রকৃত সত্যটা চাপা দেওয়া যায়নি। দ্বিতীয় তালেবানের আখ্যান পুরোনো তালেবানের আকাঙ্ক্ষার বেদিতে বলি হয়েছে। এটি পশ্চিম ছাড়া আর কারও কাছেই অবাক হওয়ার মতো কোনো ব্যাপার ছিল না। বিশেষ করে আমেরিকা এখন অবাক হওয়ার চর্চা করছে। মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দের নেতৃত্বে এবং অন্য প্রভাবশালী নেতাদের নিয়ে আফগানিস্তানে একটি কট্টরপন্থী অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে।
আফগানিস্তানে প্রথম দিকে আমেরিকা যে রকম পরিস্থিতির মুখে পড়েছিল, এটা সে রকমই একটা জোর ধাক্কা। ৩৩ সদস্যের অন্তর্বর্তী সরকার থেকে এটা স্পষ্ট, কারা বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তালেবান হয়তো অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকারের কাল্পনিক একটা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তাদের এই প্রতিশ্রুতি সম্ভবত ওয়াশিংটনের ভালো বিশ্বাসযোগ্যতাও পেয়েছিল। নারী ও সংখ্যালঘুদের বাদ দেওয়া এবং হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা জালালউদ্দিন হাক্কানির ছেলে সিরাজউদ্দিন হাক্কানিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার পরই আমেরিকার বোধোদয় হলো। আর অপমানের ষোলোকলা পূর্ণ হলো ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ২০তম বর্ষপূর্তির মাত্র কয়েক দিন আগে কাবুলের শাসনক্ষমতা সন্ত্রাসীদের হাতে যাওয়ার মধ্য দিয়ে।
তালেবান কী করতে পারে, সেটা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ ছিল না। কিন্তু আমেরিকান আমলাতন্ত্রের শাশ্বত গোলকধাঁধা থেকে আশা উত্থিত হচ্ছিল। তালেবানকে সঙ্গে নিয়ে তারা আইএস ও আইএসকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযান পরিচালনা করবে, এমন এক ধারণার জন্ম তারা দিয়েছে। বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভ্যানকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তালেবান তাদের শত্রু কি না, এ প্রশ্নের জবাবে তাঁর উত্তর ছিল, ‘তাদের ওপর একটা সিল লাগানো কঠিন। কারণ, আফগানিস্তানের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর তারা আসলে কী করছে, সেটা দেখা এখনো বাকি।’
আফগানিস্তানের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তালেবান কী করবে, দুই দশক ধরে তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পর সেটা বোঝা আমেরিকার জন্য কি যথেষ্ট নয়।
তালেবান এখন কী নিয়ে ব্যস্ত? আফগান জনগণের ওপর জুলুম করছে তারা। তালেবানের বর্বরতার হাত থেকে বাঁচতে সাধারণ আফগানরা দেশজুড়ে প্রতিবাদ করছে। কাবুলের মিছিল থেকে ‘মুক্তি চাই’ স্লোগান ধ্বনিত হচ্ছে। এসব প্রতিবাদে নারীদের বড় অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে।
তালেবান শাসন শুরুর পর সমাজ ও রাজনীতিতে নিজেদের ক্রমবর্ধমান নাজুক পরিস্থিতি দেখতে পেয়ে নারীরা প্রতিবাদে শামিল হচ্ছেন। তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা মওলানা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা শরিয়াহ আইন বাস্তবায়নের কথা বলেছেন। জনগণকে সতর্কবার্তা দিয়েছে তালেবান, ‘সরকারি অফিস খোলা এবং প্রতিবাদ-সংক্রান্ত আইন ব্যাখ্যার আগপর্যন্ত’ কোনো প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করা যাবে না। এর মধ্য দিয়ে তারা স্পষ্ট করছে, তাদের শাসনের বিরুদ্ধে কোনো ভিন্নমত সহ্য করা হবে না।
এদিকে বাইডেন প্রশাসন ধ্বংসাত্মক আফগান নীতির কারণে, তাঁর দেশে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছেন। জো বাইডেনের ঘাড়ে যেন এটি আলবাট্রস পাখির মতো ঝুলে আছে। আফগান ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য মরিয়া চেষ্টা চালায় হাজার হাজার মানুষ। একেকটা বিমান শত শত আফগানে ভর্তি ছিল। ওয়াশিংটনের জন্য এটা মোকাবিলা করা ছিল তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জগুলো আরও বাস্তব। নতুন তালেবান সরকার ঘোষণার পর এর একটি সামনে এসেছে।
আফগানিস্তানে জিহাদি মতাদর্শ জয়ের পর সারা বিশ্বে সহিংস উগ্রপন্থার নতুন করে শক্তি সঞ্চয়ের পথ খুলে গেল। যে ব্যাখ্যা দেওয়া হোক না কেন, এটা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নয়। আমেরিকার নির্বুদ্ধিতা বর্তমান বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে।
জো বাইডেন যখন ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন হাক্কানি নেটওয়ার্ককে যুক্তরাষ্ট্র বিদেশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিল। এই গোষ্ঠী আমেরিকার সৈন্যদের টার্গেট করত। তারা আল-কায়েদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে কাজ করত। এখন এ সংগঠনের নেতা আফগানিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তালেবানও আল-কায়েদা ও হাক্কানি নেটওয়ার্কের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে কাজ করে। সে কারণেই উগ্রপন্থীদের নিয়ে আরও বড় পরিসরে সরকার গঠনের ধৃষ্টতা তারা দেখাতে পেরেছে। আরও মজার বিষয় হচ্ছে, সরকারের মধ্যে তারা তালেবানের চেয়েও কঠোর বিবৃতি দিচ্ছে।
এখন যুক্তরাষ্ট্র এমন একটা বিবৃতি দিয়েছে, যাতে ধন্দ সৃষ্টি হয়েছে। তারা তালেবান সরকারের কয়েকজন ‘ব্যক্তির যোগসূত্র এবং পূর্ববর্তী রেকর্ড’ সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিবৃতিতে একই সঙ্গে, ‘তালেবানকে মুখের কথা দিয়ে নয়, কাজ দিয়ে মূল্যায়ন করা হবে’, এমন কথা বলেছে তারা। কিন্তু তালেবান তাদের কাজের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট করেছে, তারা সামরিক জয়ের মধ্য দিয়েই ক্ষমতায় এসেছে। ফলে তাদের রাজনৈতিক কাজে সেটার প্রতিফলন ঘটবেই। দর-কষাকষির মধ্য দিয়ে কোনো মীমাংসা সেখানে হয়নি। বন্দুকের নল রাজনৈতিক লুণ্ঠনের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। পানশির উপত্যকায় প্রতিরোধযুদ্ধে পরাজয়ের ঘটনা সেটা বুঝে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষার পথ এখনো কিছুটা খোলা আছে, কিন্তু তাদের কী কোনো বৈশ্বিক জোট গড়ার রাজনৈতিক ইচ্ছা আছে? যে জোট আফগানিস্তানের সন্ত্রাসী সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করবে। আফগানিস্তানকে তালেবানমুক্ত করার অভিপ্রায় যাদের থাকবে। ওয়াশিংটন এখনো আশা করছে, তালেবান তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে। বিদেশি নাগরিক এবং আফগানদের মধ্যে যাদের ভ্রমণ নথি রয়েছে, তাদের নিরাপদে দেশ ছাড়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। আফগানিস্তান থেকে বিমান ছাড়ার অনুমতি দেবে।
আফগানিস্তানে জিহাদি মতাদর্শ জয়ের পর সারা বিশ্বে সহিংস উগ্রপন্থার নতুন করে শক্তি সঞ্চয়ের পথ খুলে গেল। যে ব্যাখ্যা দেওয়া হোক না কেন, এটা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নয়। আমেরিকার নির্বুদ্ধিতা বর্তমান বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে। তালেবান নেতৃত্ব এবং তাদের অনুসারীদের চিন্তার কেন্দ্রে রয়েছে উগ্রপন্থী মতাদর্শ। এই মতাদর্শকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো নীতিকৌশল যদি না থাকে, তাহলে সময়ের সঙ্গে সেটা বাড়তেই থাকবে। কিন্তু আফগানিস্তানের এখনকার ঘটনাপ্রবাহের ফলাফল দিগ্দিগন্তে ছড়িয়ে পড়বে। তাতে সবচেয়ে বড় ক্ষতির মুখে পড়বে দক্ষিণ এশিয়া।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
হর্ষ ভি পান্থ লন্ডনের কিংস কলেজের কিংস ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউটের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের অধ্যাপক।