দুই দুগুণে পাঁচ

পুনশ্চ প্রেসিডেনশিয়াল হিউমার

সম্প্রতি সমাপ্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সব সংবাদমাধ্যম ও জনমত জরিপকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হিলারি ক্লিনটনকে ধরাশায়ী করে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন দৃঢ় পদক্ষেপে হোয়াইট হাউসের দিকে এগিয়ে গেছেন, তখন আমার মনে পড়ে গেছে আমেরিকার ৩৩তম প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান কর্তৃক উচ্চারিত একটি মুখরোচক কথা: নির্বাচন কিংবা ঘোড়দৌড়ের ক্ষেত্রে কোনো একসময়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের কেউ একজন এগিয়ে থাকাটা বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে কোন ঘোড়াটা ফিনিশিং লাইনে ফার্স্ট হয়, সেটা।
কথাটার উল্লেখ করেছেন সুদীর্ঘকাল হোয়াইট হাউসের গণসংযোগের দায়িত্বে নিয়োজিত মিসেস লিজ কার্পেন্টার, তাঁর দ্য প্রেসিডেনশিয়াল হিউমার গ্রন্থে। তিনি আরও লিখেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান নাকি একদা হোয়াইট হাউস প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘ইট ইজ দ্য ফাইনেস্ট প্রিজন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।’ হোয়াইট হাউস নাকি দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর কয়েদখানা। তবে হোয়াইট হাউসের সামনে অসংখ্য ট্যুরিস্টের ভিড়ে দাঁড়িয়ে আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। জনৈক সাংবাদিক লিখেছেন, ‘কল্পনা করুন, হিলারি যদি জয়যুক্ত হন তাহলে হোয়াইট হাউসে বিল ক্লিনটন বেকার সময় কাটাবেন।’
আর হোয়াইট হাউসে প্রথম বসবাসকারী আমেরিকার দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস নাকি গৃহ-প্রবেশকালে প্রার্থনা করেছিলেন, ‘ঈশ্বর কবুল করুন, কেবল সৎ ও বিজ্ঞ লোকেরাই যেন এই ছাদের নিচে বাস করে।’ তাই বিল ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন মনিকা লিউনস্কির সঙ্গে যে কাণ্ডকারখানা করেছেন, তাঁর পক্ষে দ্বিতীয়বার ওই ছাদের নিচে অবস্থান হয়তো নাও ঘটতে পারে। হাজার হোক, ইংরেজিতে ‘পোয়েটিক জাস্টিস’ বলে একটা কথা আছে না? এক্ষণে দেখা যাচ্ছে, বাস্তবেও তা-ই ঘটেছে।

>প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের অন্যতম বিখ্যাত সরস উক্তি হচ্ছে, ‘রাজনীতি খারাপ পেশা নয়। আপনি সফল হলে অনেক পুরস্কার এবং বিফল হলে সর্বদাই একটা বই লিখতে পারেন।’


সে যা–ই হোক। জন এফ কেনেডি ছিলেন আমেরিকার ৩৫তম প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণকালে তিনি যে একটি আপ্তবাক্য উচ্চারণ করেছিলেন, সেটা অদ্যাবধি স্মরণীয় হয়ে আছে, ‘আস্ক নট হোয়াট ইওর কান্ট্রি ক্যান ডু ফর ইউ, আস্ক হোয়াট ইউ ক্যান ডু ফর দ্য কান্ট্রি’। অর্থাৎ ‘জিজ্ঞেস করবেন না আপনার দেশ আপনার জন্য কী করতে পারে, জিজ্ঞেস করুন আপনি দেশের জন্য কী করতে পারেন।’ বাস্তবিক, মহৎপ্রাণ ব্যক্তিদের চিন্তাভাবনাই আলাদা।
জন কেনেডির স্ত্রী জ্যাকুলিন কেনেডি (অতঃপর ওনাসিস) ছিলেন একজন সুন্দরী, শৌখিন নারী। তাই প্রেসিডেন্ট কেনেডি একবার হোয়াইট হাউসে সমবেত সাংবাদিকদের হিউমার করে বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয়, সম্মানিত উপস্থিতজনের কাছে আমার নিজেকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া নেহাত বেমানান হবে না। আমি সেই ব্যক্তি, যিনি জ্যাকুলিন কেনেডির সঙ্গে প্যারিস গিয়েছিলাম এবং ব্যাপারটা আমি খুব উপভোগ করেছি।’ উপস্থিত সবাই তখন অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিলেন।
লিজ কার্পেন্টার তাঁর গ্রন্থে এই ঘটনার উল্লেখ করে পাঠকদের উদ্দেশে বৃত্তবন্দী উপদেশবাণী রেখেছেন, ‘জর্জ ডব্লিউ বুশ তাঁর স্ত্রী লরা বুশের ক্ষেত্রে এটার প্রয়োগ করেছেন, আপনিও করতে পারেন।’ আমি তাঁর এই উপদেশবাণী পঠনের আগেই যা ঘটানোর ঘটিয়ে দিয়ে এসেছি। একজন গুলবাজ লোক সগৌরবে পৃথিবীর বিখ্যাত শহরগুলো ভ্রমণের গুল মারার সময় তাঁকে যখন বলা হলো, ‘তাহলে তো ভূগোল সম্পর্কে আপনার ভালো জ্ঞান আছে’, তখন তিনি বলে উঠেছিলেন, ‘হ্যাঁ, ভূগোলেও আমি দুই সপ্তাহ ছিলাম।’ আমার ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়, আমি সত্যি সত্যিই এবার মার্কিন মুল্লুকে সস্ত্রীক ভ্রমণকালে নিউইয়র্ক ছাড়াও ওয়াশিংটন ডিসি, হিউস্টন, ডালাস ও অস্টিন শহরে গিয়েছি এবং সর্বত্র যাকে যাকে বলার বলে দিয়ে এসেছি, ‘বিলেতের রানি এলিজাবেথ যখন বিদেশসফরে যান, তখন সঙ্গে থাকেন তাঁর স্বামী প্রিন্স ফিলিপ, যাঁকে সংবাদমাধ্যমে অভিহিত করা হয় কুইন্স কনসর্ট তথা রানির সঙ্গী বলে। তেমনিভাবে আমিও এবার এসেছি কুইন্স কনসর্ট হিসেবে।’ এবং বলাই বাহুল্য, সবাই সর্বত্র সেটা উপভোগ করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
আমেরিকার আরেক প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলিন ছিলেন খুব অল্প কথার লোক। তিনি যেকোনো কথার উত্তর মাত্র একটি কিংবা দুটি শব্দে দিতেন, যেটাকে ইংরেজিতে বলে ‘ল্যাকোনিক রিপ্লাই’। একবার ওয়াশিংটনের এক ডিনার পার্টিতে প্রেসিডেন্টের পাশে বসা এক সম্ভ্রান্ত মহিলা নাকি তাঁকে বলেছিলেন, ‘ওহ মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আমি আজ আমার প্রতিবেশীর সঙ্গে বাজি ধরেছি যে আপনার কাছ থেকে দুই শব্দের বেশি আদায় করব।’ তখন তিনি স্মিতহাস্যে জবাব দিয়েছিলেন, ‘আপনি হেরেছেন’। সরকারের ট্যাক্স–সম্পর্কিত তাঁর আরেকটি সরস উক্তি নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য, ‘নেহাত প্রয়োজনের অধিক ট্যাক্স আদায় করা হচ্ছে আইন দ্বারা বৈধকৃত ডাকাতি।’
আমেরিকার ৪০তম প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানও ছিলেন হাস্যরসে ভরপুর একজন মানুষ। মনে পড়ে, আমেরিকার এক যুবক, যে এত বছর পরে সদ্য জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে, তার প্রেমিকাকে ‘ইমপ্রেস’ করার উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের ওপর গুলি চালায়। প্রেসিডেন্টকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার সময় তিনি টেলিফোনে স্ত্রী ন্যান্সিকে উদ্দেশ করে সহাস্যে বলেছিলেন, ‘হানি, আমি ডাক করতে (মাথা নিচু করতে) ভুলে গিয়েছিলাম’। টেলিভিশনের কল্যাণে সেটা আমরা তখন দেখতে পেয়েছি। আর হ্যাঁ, প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের অন্যতম বিখ্যাত সরস উক্তি হচ্ছে, ‘রাজনীতি খারাপ পেশা নয়। আপনি সফল হলে অনেক পুরস্কার এবং বিফল হলে সর্বদাই একটা বই লিখতে পারেন।’ এখন হিলারি ক্লিনটন বই লিখবেন কি, তিনি তো আগেই বই (আত্মজীবনী) লিখে ফেলেছেন।
পরিশেষে পরিবেশন করছি লব্ধপ্রতিষ্ঠ আমেরিকান হিউমারিস্ট মিল্টন বার্লের প্রাইভেট জোক ফাইল বই থেকে একটি প্রাসঙ্গিক হিউমার: হাল আমলের একজন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বলেছেন যে সে দেশের প্রত্যেক নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের উচিত তিনটি খাম সঙ্গে রাখা। প্রথম বছরে যখন সবকিছু ঠিকঠাক যাচ্ছে না তখন তাঁর উচিত প্রথম খামটি খোলা। সেটার ভেতরে তিনি দেখতে পাবেন, ‘আপনার পূর্বসূরিকে দোষারোপ করতে থাকুন’। দ্বিতীয় বছর শেষে যদি আরও খারাপ সময় আসে তাহলে তাঁর উচিত দ্বিতীয় খামটি খোলা। সেটাতে তিনি পড়বেন, ‘কংগ্রেসকে দোষারোপ করুন’। তৃতীয় বছরান্তে যদি তিনি পুরো পর্যুদস্ত হন তাহলে তৃতীয় খামটি খুলবেন এবং ভেতরের বার্তাটি মনোযোগসহকারে পড়বেন, ‘অনুরূপ তিনটি খাম তৈরি করুন’।
বলা বাহুল্য, সব রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা প্রযোজ্য হতে পারে।
বি. দ্র.: বিগত কিস্তির লেখায় মুদ্রণপ্রমাদ হেতু প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসনের জায়গায় লিওন জনসন ছাপা হয়েছে। তরুণ শিক্ষার্থী, পাঠকদের কথা বিবেচনায় রেখে সংশোধনীটি নজরে আনলাম।

আতাউর রহমান: রম্য লেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷