ইউক্রেনে রাশিয়ার অব্যাহত আগ্রাসন এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে আগামী দিনগুলোয় পরিস্থিতি আরও বেশি বিপজ্জনক জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে। এটি কেবল যুদ্ধক্ষেত্রেই ঘটবে তা নয়, এই বিপদের আশঙ্কা রাশিয়ার ভেতরের সম্ভাব্য পরিস্থিতি এবং পুতিনের আচরণের মধ্যেও। এরপরও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এই যুদ্ধের যে প্রভাব ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে, তা আরও বেশি বিস্তার লাভ করবে। এ কারণে ইউক্রেনের যুদ্ধ আগামী দিনগুলোয় আরও বেশি মাত্রায় ভয়াবহ রূপ নেবে। যে যেখানেই থাকি না কেন, এই যুদ্ধের উত্তাপ আমাদের গায়ে এসে লাগবে, ইতিমধ্যে তা লাগতেও শুরু করেছে।
যেকোনো ধরনের যুদ্ধে, যারা আগ্রাসন চালায়, তারা বিভিন্ন ধরনের হিসাব-নিকাশ করেই যুদ্ধের সূচনা করে। যুদ্ধের সম্ভাব্য পথরেখা কী হবে, সেটা ভাবা হয়ে থাকে। তাতে বিভিন্ন ধরনের দৃশ্যকল্প তৈরি করা হয়। এ ধরনের অনুশীলন যুদ্ধপ্রস্তুতির অংশ। এতে কেবল যুদ্ধক্ষেত্রের বিষয়ই বিবেচনা করা হয় না, বিবেচনা করা হয় এর প্রতিক্রিয়া কী হবে এবং সেগুলো কীভাবে মোকাবিলা করা হবে। রাশিয়া অকস্মাৎ ইউক্রেনে আগ্রাসন চালায়নি। এ যুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল ২০২১ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে। সে সময়েই ক্রিমিয়া ও ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার সেনাসমাবেশ শুরু হয়, সীমান্তে রাশিয়ার সেনারা অনুশীলন চালিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল এ উপলক্ষে সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে আসা এবং পরে তা আগ্রাসনের সময় ব্যবহার করা। এ আগ্রাসন পরিকল্পনার দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গত বছরের শেষ দিকে যে প্রতিবেদন তৈরি করেছিল, তাতে বলা হয়েছিল, রাশিয়া ২০২২ সালের শুরুর দিকে ১ লাখ ৭৫ হাজার সেনা নিয়ে ইউক্রেনে হামলা চালাতে পারে (ওয়াশিংটন পোস্ট–এর প্রতিবেদন, ডিসেম্বর ৩, ২০২১)। এ কারণে ২৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া রাশিয়ার আগ্রাসন অপরিকল্পিত বা হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া ঘটনা নয়।
কিন্তু যেটা বিস্ময়কর, তা হলো রাশিয়া যেসব হিসাব করে এ যুদ্ধের শুরু করেছিল, তার অনেকটাই মনে হচ্ছে ভুল হিসাব। খুব স্বল্প সময়ে রাশিয়া ইউক্রেন দখল করতে সক্ষম হবে—এমন ধারণা সঠিক হয়নি। দুই সপ্তাহ পার হওয়ার পরও রাজধানী কিয়েভ দখলে রাশিয়ার ব্যর্থতা প্রমাণ করে যে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী এবং সাধারণ নাগরিকেরা বড় ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ বাহিনী যে অগ্রসর হতে পারছে না, তার একটি কারণ হচ্ছে ইউক্রেনের আবহাওয়া। বলা হয়ে থাকে, ফল বা শরৎকালের শেষে রাশিয়া ও ইউক্রেনের আবহাওয়া এমন থাকে এবং কাঁচা রাস্তাঘাট এতটাই কর্দমাক্ত হয়ে পড়ে যে সেখানে ট্যাংক বা সাঁজোয়া বহরের অগ্রসর হওয়া প্রায় অসম্ভব। কিয়েভ অভিমুখী সাঁজোয়া বহরের অনেক ছবি দেখে মনে হচ্ছে, রুশ বাহিনী কাদায় আটকে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়লে তা সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর জন্য স্বস্তিদায়ক হবে না। শুধু তা-ই নয়, বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা সৃষ্টি হলে তা চীনের জন্যও ইতিবাচক নয়। এ অর্থনৈতিক বিবেচনায়ই চীন রাশিয়াকে এ যুদ্ধে সমর্থন দিতে কুণ্ঠিত করেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদে রাশিয়ার পক্ষে থাকেনি চীন। বিশ্ব অর্থনীতির যত বেশি সমস্যা মোকাবিলা করবে, রাশিয়ার ওপর যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য চাপ বাড়বে। পুতিন তা বুঝতে পারেন বলেই ধারণা করা যায়।
কিন্তু এগুলোকে একার্থে প্রতীকী বলেই বিবেচনা করা দরকার। কাদায় পড়ার কারণ কেবল আবহাওয়ার হিসাব নয়, রাশিয়ার হিসাবে আরও কিছু ভুল হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। রাশিয়া সম্ভবত আশা করেছিল, অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে অভিযান চালিয়ে ইউক্রেনে তার অনুগত একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করে সামরিক অভিযান শেষ করতে পারবে। সেই বিবেচনায়ই রাশিয়ার পক্ষ থেকে যুদ্ধের গোড়ায় বারবার ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল যে তারা যেন বিদ্রোহ করে জেলেনস্কি সরকারের পতন ঘটায়। তা হয়নি। রাশিয়া সম্ভবত আশা করছিল, ইউক্রেনের নাগরিকদের একাংশ রুশ সেনাদের স্বাগত জানাবে। রাশিয়ার এ ধরনের প্রত্যাশার কারণ হচ্ছে ২০১৩ সাল থেকে রাশিয়া প্রতি অনুগত রাজনীতিবিদদের প্রতি ইউক্রেনে সমর্থন ছিল। ২০১০ সালে ইয়ানুকোভিচ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন, ঐতিহাসিকভাবে ভাষা ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের কারণে ইউক্রেনের অনেকেই রাশিয়ার সঙ্গে একধরনের বন্ধন অনুভব করেন। অন্যদিকে রাশিয়া কখনোই ইউক্রেনের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি। ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর এক লেখায় ইউক্রেন ও রাশিয়াকে ‘এক জাতি’ বলেই বর্ণনা করেছিলেন; একই কথা বলেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে। রাশিয়ার হিসাব ছিল ইউক্রেনের ভেতর থেকে তারা সমর্থন পাবে। কিন্তু কিন্তু তিন দশক ধরে স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া মানুষের মধ্যে যে ধরনের জাতীয়তাবাদী চিন্তা গড়ে উঠেছে, সেটিই তাদের এ হামলার সময় আরও বেশি রুশবিরোধী করে তুলছে। সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরণার্থী সমস্যার ব্যাপকতা একদিকে রাশিয়ার জন্য নেতিবাচক হয়েছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ঠেলে দিয়েছে।
২২ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা পুতিন তাঁর কর্তৃত্ববাদী শাসনকে বহাল রাখতে পেরেছিলেন যেসব কারণে, এর একটি অন্যতম দিক ছিল তিনি একধরনের স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। যেকোনো ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা অর্থনীতি সফল বলে তাঁদের শাসনের বৈধতা দিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু গত কয়েক দিনে রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সাধারণ মানুষের ওপর ভয়াবহভাবে প্রভাব ফেলেছে। রুবলের দাম এতটাই পড়ে গেছে যে তা আর কতটা কাজে দেবে, কেউ জানে না।
পুতিন ও তাঁর সহযোগীরা সম্ভবত এটা ভাবতে পারেননি যে কত দ্রুততার সঙ্গে পশ্চিমের এ নিষেধাজ্ঞা অর্থনীতির ওপর প্রভাব বিস্তার করবে। যদিও পুতিন এ যুদ্ধকে দেখাতে চাইবেন পশ্চিমের বিরুদ্ধে রাশিয়ার টিকে থাকার লড়াই, কিন্তু ক্রমাগতভাবে তা যে রুশদের জন্য অগ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে, এটি ইতিমধ্যেই বিভিন্ন শহরে যুদ্ধবিরোধী সমাবেশ থেকে বোঝা যায়। রাশিয়ায় মতপ্রকাশের ওপর আরও কঠোর ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এগুলোর কারণে দেশের ভেতরে যত অসন্তোষ বাড়বে, সরকার তত বেশি নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা নেবে। বলা আবশ্যক, পুতিনের এই যুদ্ধের প্রতি সমর্থন করার মতো রুশ নাগরিকেরা আছেন। কিন্তু যে ক্ষুদ্র সুবিধাভোগী গোষ্ঠী এত দিন পুতিনের পাশে ছিল এবং এখনো আছে, তারা এ ধরনের অর্থনৈতিক চাপের মুখে কী ভূমিকা নেয়, সেটাও দেখার বিষয়। কেননা এ নিষেধাজ্ঞা তাদের লক্ষ্য করেই চাপানো হয়েছে। এসব ঘটনা পুতিনের আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে। যুদ্ধের দ্রুত নিষ্পত্তি করতে অভিযানের কৌশলকে আরও বেশি নিষ্ঠুর করে করে তুলতে পারেন।
রাশিয়ার ওপর সরকারিভাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলো যেসব নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাতে সমর্থন দিয়েছে অন্য অনেক দেশ। কিন্তু যেটা লক্ষণীয়, সেটা হচ্ছে বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজস্ব উদ্যোগেই রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছে। যেসব পণ্য বা সেবার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি, সেগুলো পর্যন্ত এখন রাশিয়ার জন্য দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। স্মরণ করা দরকার, রাশিয়ার মোট জিডিপির ২৬ শতাংশ নির্ভর করে তার রপ্তানির ওপর। রাশিয়া তার ২০১৪ সালের অভিজ্ঞতা থেকে সম্ভবত মনে করেছিল ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে মতপার্থক্যের কারণে বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়িত হবে না। রাশিয়ার তেল-গ্যাসের ওপর ইউরোপের নির্ভরতার কারণে ইউরোপ খুব বেশি কঠোর হবে না। কিন্তু রাশিয়া থেকে তেল-গ্যাস আমদানি অব্যাহত রেখেও যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে।
এসব ব্যবস্থা যে কেবল রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলবে তা নয়, এর প্রতিক্রিয়া সারা বিশ্বের অর্থনীতির ওপরই পড়বে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাংক ইতিমধ্যেই এই মর্মে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। জ্বালানি তেল ও কৃষিজাত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ইতিমধ্যেই ঘটতে শুরু করেছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ছোট দেশগুলো। বাংলাদেশের একটি উদাহরণ দিলেই তা বোঝা যাবে। বাংলাদেশ প্রতিবছর ৭০ লাখ টন গম আমদানি করে থাকে। এর মধ্যে ৩৫ লাখ টন আমদানি করা হয় ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে। রাশিয়া ও ইউক্রেন সারা বিশ্বের মোট গমের ২৯ শতাংশ রপ্তানি করে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়লে তা সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর জন্য স্বস্তিদায়ক হবে না। শুধু তা-ই নয়, বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা সৃষ্টি হলে তা চীনের জন্যও ইতিবাচক নয়। এ অর্থনৈতিক বিবেচনায়ই চীন রাশিয়াকে এ যুদ্ধে সমর্থন দিতে কুণ্ঠিত করেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদে রাশিয়ার পক্ষে থাকেনি চীন। বিশ্ব অর্থনীতির যত বেশি সমস্যা মোকাবিলা করবে, রাশিয়ার ওপর যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য চাপ বাড়বে। পুতিন তা বুঝতে পারেন বলেই ধারণা করা যায়। কিন্তু এসব তাঁকে আপসমুখী করবে—এমন মনে হয় না, বরং আরও আগ্রাসী করে তুলবে বলেই আশঙ্কা। এ কারণে আগামী দিনগুলোয় বিপদের মাত্রা বাড়বে বৈ কমবে না।
● আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট