পুতিনের হাত থেকে তুরুপের তাস কি ফসকে যাচ্ছে

ভ্লাদিমির পুতিন
ভ্লাদিমির পুতিন

ফোর্বস ম্যাগাজিন ভ্লাদিমির পুতিনকে টানা তিন বছর (২০০৩ থেকে ২০১৫) বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে বেছে নিয়েছিল। ২০১৮ সালে সিএনএনের একটি তথ্যচিত্রে তাঁকে বিশ্বের যেকোনো ব্যক্তির চেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছিল।

কিন্তু ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু থেকেই রাশিয়ার জন্য বিভ্রান্তিকর হয়ে ওঠায় পুতিনের সেই শক্তিমত্তা প্রশ্নের মুখে পড়ে গেছে। টাইম ম্যাগাজিনের পাঠক জরিপে ২০২২ সালের শীর্ষ পাঁচ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় তাঁর নাম ঠাঁই পায়নি। সেই জরিপে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি প্রথম স্থান অধিকার করেছেন।

১৯২০–এর দশকে জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার বলেছিলেন, একজন প্রকৃত শক্তিধর ব্যক্তি তাঁর সামনে আসা বাধা ঠেলে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হন। অন্যদিকে, ব্রিটিশ দার্শনিক কিথ ডাউডিং একজন শক্তিশালী ব্যক্তিকে মূলত ভাগ্যবান হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি মনে করেন, ভাগ্য অনুকূলে থাকে বলেই একজন ব্যক্তি শক্তিধর হয়ে ওঠার সুযোগ পান এবং তিনি ‘চেষ্টা না করেও’ এবং প্রতিরোধের সম্মুখীন না হয়েও তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেন।

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধটি ভাগ্য ও শক্তির খেলা হিসেবে দৃশ্যমান হচ্ছে। আর শক্তি এবং ভাগ্যের পার্থক্য সবচেয়ে ভালো বোঝা যায় জুয়া খেলার টেবিলে। এই খেলায় একজন খেলোয়াড় যখন জেতেন, তখন সাধারণত ধারণা করা হয়, তাঁর হাতে তুরুপের তাস ছিল, নয়তো তিনি প্রতিপক্ষের তুলনায় অনেক বেশি চাতুর্যপূর্ণ কৌশল প্রয়োগ করেছেন। প্রথম ক্ষেত্রে ওই খেলোয়াড় ভাগ্যবান। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তিনি শক্তিশালী।

জুয়া খেলার এই রূপক ব্যবহার রাশিয়ান সংস্কৃতির প্রতীক। ফিওদর দস্তয়েভস্কি তাঁর দ্য গ্যাম্বলার (জুয়াড়ি) উপন্যাসটিকে জগতের সব জুয়াড়ির মনস্তত্ত্বের প্রতি উৎসর্গ করেছিলেন। দস্তয়েভস্কির অমর সৃষ্টিগুলোর গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন বিশ্লেষক মিখাইল বাখতিন এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, জুয়া খেলার সময় যখন কোনো খেলোয়াড় হেরে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন, তখন তাঁর নিজেকে একেবারে খাদের কিনারে দাঁড়ানো মানুষ মনে হয়। সেই মুহূর্তে সৌভাগ্য তার জন্য সবকিছু সম্ভব করে তোলে। আর দুর্ভাগ্য তাকে সর্বস্ব হারানোর দিকে নিয়ে যায়।

রাশিয়ান রুলেট (একধরনের ক্যাসিনোবিশেষ) খেলা ভাগ্যনির্ভর একটি জুয়া খেলা। তবে যার স্মরণশক্তি প্রখর এবং সুচিন্তিত কৌশল জানা আছে, সে এই খেলায় জেতে।

কিন্তু রাশিয়ার এই তুরুপের তাসগুলো পুতিন বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারছেন, এমনটা এখনো মনে হচ্ছে না। কোনো খেলোয়াড়ের হাতে পর্যাপ্ত তুরুপের তাস থাকলেও সে যদি খেলার সময় অসতর্ক থাকে, তাহলে তার পক্ষে জেতা সম্ভব হয় না।

ইউক্রেন হলো পুতিনের চূড়ান্ত রুলেট খেলা। এই খেলাই পুতিনের ভাগ্য ও বিচক্ষণতার চূড়ান্ত পরীক্ষাস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই খেলায় তাঁকে যেকোনো মূল্যে জিততে হবে। যুদ্ধের শুরুতে পুতিনের মনে হয়েছিল তাঁর হাতে সব কটি তুরুপের তাস রয়েছে। তাঁর হাতে ছিল এমন এক সেনাশক্তি, যাকে বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিধর বাহিনী মনে করা হয়। তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পারমাণবিক পরাশক্তির মর্যাদা পেয়েছেন এবং পারমাণবিক অস্ত্রের মজুতও অনেক গুণ বাড়িয়েছেন।

রাশিয়ার হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকা প্রকৃতপক্ষে পুতিনকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা দিয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ভুল করে ফেললে এই অস্ত্র থাকার সুবাদে তাঁকে খুব কমই খেসারত দিতে হয়। এ কারণেই ইউক্রেন যুদ্ধে সমস্যায় পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুতিন পারমাণবিক অস্ত্রকে উচ্চ সতর্কতায় রাখার ঘোষণা দেওয়ায় কেউ অবাক হয়নি।

পুতিন উত্তরাধিকারসূত্রে অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদও পেয়েছেন, যা রাশিয়ার প্রভাব–প্রতিপত্তির একটি বড় নিয়ামক হয়ে আছে। ইউরোপ ঐতিহ্যগতভাবে রাশিয়ার জ্বালানি সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল।

ইউরোপ রাশিয়া থেকে তেল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা চিন্তা করেছিল। কিন্তু রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল ও পেট্রোলিয়াম কেনা, আমদানি বা স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা আরোপে ইউরোপের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। কারণ, ইউরোপ রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার জন্য প্রস্তুত নয়।

কিন্তু রাশিয়ার এই তুরুপের তাসগুলো পুতিন বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারছেন, এমনটা এখনো মনে হচ্ছে না। কোনো খেলোয়াড়ের হাতে পর্যাপ্ত তুরুপের তাস থাকলেও সে যদি খেলার সময় অসতর্ক থাকে, তাহলে তার পক্ষে জেতা সম্ভব হয় না।

এই খেলায় রাশিয়া প্রথম যে বড় ভুলটি করেছে, তা হলো ইউক্রেনের যুদ্ধ করার সংকল্প ও সামর্থ্যকে খাটো চোখে দেখা। তারা ইউক্রেনের সক্ষমতাকে পাত্তাই দেয়নি।

কিন্তু এখন পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, জেলেনস্কি এবং ইউক্রেনের জনগণ পুতিনের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হতে পারে। প্রতিরোধ পরিস্থিতি বদলে দেয়। ইউক্রেনীয়রা পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে। এখন তাদের যুদ্ধে জিততে হলে তাদের হাতে থাকা তাসগুলো বুঝেশুনে ফেলতে হবে। পুতিনের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা খাটে।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • অ্যান্টন ওলেইনিক নিউফাউন্ডল্যান্ডের মেমোরিয়াল ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক