রাশিয়ার প্রেক্ষাপটে ১৯৮৯ সালকে ‘মহান প্রত্যাশার বছর’ বলে অভিহিত করা যায়। ওই বছর মস্কোর মহাসড়কে নেমে আসা লাখ লাখ গণতন্ত্রকামী আন্দোলনকর্মীদের মধ্যে রুশ ব্যান্ড দল ‘কিনো’ যখন ‘উই আর ওয়েটিং ফর চেঞ্জেস! (আমরা বদলের অপেক্ষায় আছি!)’ গানটি গাইত, তখন জনতা হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ত। গর্বাচেভের যুগে সেই বদলপ্রত্যাশীদের উন্মাদনা তুঙ্গে উঠেছিল। সাধারণ মানুষ তখন কোথায় কী ঘটছে, না ঘটছে তা জানার জন্য খবরের কাগজ ছিনিয়ে নিত, টেলিভিশনের খবরে সবার চোখ আটকে থাকত। প্রতিটি দিন তাদের কাছে মুক্তির স্বাদ বয়ে আনত।
ওই সময় অনেকেই বুঝতে পেরেছিল পচে যাওয়া সোভিয়েত সিস্টেমে বদল আনতে হলে স্তালিনীয় অতীতকে আগে ভালো করে বুঝতে হবে। ওই বছরই (১৯৮৯) সোভিয়েত ইউনিয়নের শত শত অধিকারকর্মী এক হয়ে মানবাধিকার সংগঠন ‘মেমোরিয়াল’ প্রতিষ্ঠা করেন। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন, যাঁরা স্তালিনের গুলাগে (স্তালিনের কুখ্যাত বন্দিশিবির) আটক ছিলেন। সদস্যদের মধ্যে পরমাণু পদার্থবিদ আদ্রেঁই শাখারভের মতো এমন অনেকে ছিলেন, যাঁদের স্তালিন–বিরোধিতার জন্য দীর্ঘদিন নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়েছিল। সংগঠনটির মূল উদ্দেশ্য ছিল স্তালিনের নির্যাতনের শিকার হওয়া মানুষের কথা জনসমক্ষে তুলে ধরা।
নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে ‘মেমোরিয়াল’-এর মূল কার্যালয়ে নির্যাতনের শিকার হওয়া লোকজন ভিড় জমাত। বন্দিশিবির কিংবা লেবার ক্যাম্পে কাটানো জীবনের স্মারক হিসেবে তাঁরা নানা ধরনের নথিপত্র, গুলাগে বসে লেখা চিঠি বা অপ্রকাশিত বই, বন্দীদের ব্যবহার্য জামাকাপড়, কাগজ-কলম, থালা-বাটি—এ রকম বহু কিছু নিয়ে আসতেন। এগুলো দিয়েই ‘মেমোরিয়াল’-এর মহাফেজখানা ঋদ্ধ হয়েছে। ওই সময়ে আমরা বুঝতে পারছিলাম একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার শুরুটা আমরা করতে পেরেছি। সংস্কারের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা আমাদের নতুন সরকার এই নির্যাতনের ইতিহাসকে কাজে লাগাতে পারবে।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেল আমাদের সংস্কারকেরা বাজার অর্থনীতি গড়তে যতটা আগ্রহী, ততটা ইতিহাস সংরক্ষণের বিষয়ে আগ্রহী নন। তাঁরা অর্থনৈতিক সংস্কারের সঙ্গে সরব ও শক্তিশালী সুশীল সমাজের যোগসূত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে ব্যর্থ হলেন। এরপর রাশিয়া যখন ভয়ানক আর্থিক সংকটে পড়ল, তখন বহু রুশ নাগরিকের কাছে ‘গণতন্ত্র’ এটি নোংরা শব্দ হিসেবে প্রতিভাত হলো। হতাশায় ডুবে যাওয়া মানুষের তখন মনে হলো সত্যিকারের সংস্কার আসেনি। স্তালিনের যে শোষণের কথা মনে করে তাঁদের আঁতকে উঠতে হতো, দ্রুতই যেন সে দুঃসহ স্মৃতি ফিকে হয়ে যেতে লাগল। তাদের মনে হতে লাগল এত দারিদ্র্য তো স্তালিন যুগে ছিল না। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি এসেই সোভিয়েত আমলের বিষয়ে স্মৃতিকাতরতা বেড়ে গেল। ব্রেজনেভ আমলে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে যখন লোকদের শূন্য হাতে দোকান থেকে ফিরতে হচ্ছিল, তখন তাঁদের সচ্ছলতার স্মৃতি হাতড়ানো ছাড়া উপায় ছিল না। ফলে স্তালিনের ছায়া আবার তাঁদের মনের মধ্যে ফিরে আসতে শুরু করল।
সোভিয়েতের প্রভাবশালী অতীতের ‘নায়কোচিত’ ও ‘উজ্জ্বল’ স্মৃতির ওপর ভর করে যে নতুন জাতীয়তাবোধের উত্থান ঘটেছিল, তার মধ্য থেকেই মূলত ভ্লাদিমির পুতিনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয় নিশ্চিত করা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাশক্তিতে প্রতিষ্ঠিত করার নায়ক হিসেবে স্তালিনকে আবার প্রদর্শন করার ঝোঁক শুরু হয়। এই ঝোঁকে হামলে পড়া লোকদের উন্মত্ততায় স্তালিনের নির্যাতনের শিকার হওয়া মানুষ কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
আজ ১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপের স্বাধীনতা লাভ, বার্লিন দেয়ালের পতন ও শীতল যুদ্ধের অবসানকে বহু রুশ নাগরিক নিজেদের পরাজয় হিসেবে মনে করেন। এমনকি পুতিন নিজেও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে ২০ শতকের ‘মহা ভূরাজনৈতিক বিপর্যয়’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সেই জায়গা থেকেই রাশিয়ায় এখন বিশাল বিশাল বিলবোর্ডে স্তালিনের ছবি দেখা যাচ্ছে। সাবওয়ে ট্রেন স্টেশনে, দেয়ালে বা বইয়ের দোকানের কাচের জানালায় স্তালিনের ছবি সাঁটানো হচ্ছে। সরকারের দিক থেকেও স্তালিন–বন্দনায় উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
পুতিনের কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্বকে শুধু বৈধতা দেওয়াই নয়, বরং তাঁর শাসনকে মহান হিসেবে উপস্থাপন করতেই স্তালিনের নেতৃত্বকে মহান করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। জনগণের মধ্যে এই ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে যে রাশিয়াকে আবার সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো দাপট নিয়ে দাঁড়াতে হলে স্তালিনের মতোই একজন শক্ত নেতা দরকার, আর পুতিনের মধ্যেই সেই সম্ভাবনা রয়েছে।
কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি নিজের অবস্থান সংহত করতে পুতিন স্তালিনকে যতই মহিমান্বিত করার এবং তাঁকে রুশ জনমনে পুনর্বাসিত করার চেষ্টা করুন, সে চেষ্টা সর্বাংশে সফল হবে না।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
ইরিনা শেরবাকোভা লেখক ও ইতিহাসবিদ এবং মানবাধিকার সংগঠন ‘মেমোরিয়াল’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য