পুতিনের সান ঝু কৌশল ও গোগলের পরিচয়

অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, পুতিন প্রাচীন চীনা যুদ্ধবিশারদ সান ঝুয়ের দ্য আর্ট অব ওয়ার-এর চিত্রনাট্য মেনে চলছেন।
ছবি : রয়টার্স

রাশিয়া যখন ‘করে’ যুক্তরাষ্ট্র তখন ‘ভাবে’। ইউক্রেনের স্বাধীনতায় হাত পড়লে ‘খবর আছে’ বলে যাঁরা হুমকি দিচ্ছিলেন, পুতিন যখন সত্যিই ইউক্রেনের দুটি অঞ্চলের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিলেন, তখন সেই পশ্চিমারা ভাবতে বসেছেন। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, পুতিন প্রাচীন চীনা যুদ্ধবিশারদ সান ঝুয়ের দ্য আর্ট অব ওয়ার-এর চিত্রনাট্য মেনে চলছেন। সান ঝু বলেছিলেন, ‘যখন তুমি দুর্বল তখন শক্তির ভাব ধরবে, যখন তুমি শক্তিশালী তখন দেখাবে দুর্বলতা। তোমার পরিকল্পনা থাকবে অন্ধকারে ঢাকা, যখন আক্রমণ করবে, তা যেন হঠাৎ বজ্রপাতের মতো দেখায়।’

রাশিয়া বহু বছর ধরে বলে যাচ্ছিল, ন্যাটো দূরে থাকো, ৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসানের সময়ে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মনে রাখো। ইউক্রেন নিয়ে রণদামামার মধ্যেই ব্রিটিশ মহাফেজখানা থেকে সেই প্রতিশ্রুতির দলিল বেরিয়ে পড়ল। পুতিন ঠিকই বলছেন, ১৯৯১ সালে শান্তিপূর্ণভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির সময় পশ্চিমারা কথা দিয়েছিল, ন্যাটোকে পূর্ব ইউরোপে নিয়ে রাশিয়ার জন্য হুমকি তৈরি করা হবে না।

যুক্তরাষ্ট্র যখন ইউক্রেনসহ রুশ প্রতিবেশী বাল্টিক দেশগুলোয় সৈন্য ও সমরাস্ত্র পাঠাচ্ছিল, তখনো রাশিয়া একটা কথাই বলছিল, রাশিয়ার নিরাপত্তার লিখিত গ্যারান্টি চাই। চীন যদি মেক্সিকোকে পক্ষে টেনে মেক্সিকোর মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের দিক মিসাইল তাক করে কয়েক মিনিটের মধ্যে ওয়াশিংটন-নিউইয়র্কে বোমা ফেলার বন্দোবস্ত করতে চায়, যুক্তরাষ্ট্র বসে থাকবে?

রাশিয়াও বসে থাকেনি। ইউক্রেনে হাত বসানোর আগে তিনটি কাজ করেছেন পুতিন: ১. ন্যাটোর মধ্যে বিভক্তি এনেছে জার্মানি ও ফ্রান্সকে দিয়ে, ২. বেইজিং অলিম্পিকের অছিলায় চীনে গিয়ে সি চি পিংয়ের সঙ্গে যৌথ ঘোষণায় রুশ-চীন ঐক্যকে দৃশ্যমান করেছেন, ৩. ইউক্রেন থেকে গণভোটের মাধ্যমে আলাদা হওয়া দোনেৎস্ক ও লুশানস্কের স্বাধীনতা ঘোষণাকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। যমজ এ দুটি নতুন রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে গেল দুটি সভ্যতার সংঘাত: নৌশক্তিধারী পাশ্চাত্য আর ভূশক্তিধারী প্রাচ্য (রাশিয়া ও চীন)।

সান ঝুর যুদ্ধবিদ্যার আরেকটি দিক হলো, তুমি যুদ্ধের হুমকিকে বড় করে তুলবে ঠিকই, কিন্তু চেষ্টা করবে বিনা রক্তপাতে জয়ী হওয়ার। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন নিয়ে ন্যাটো বনাম রুশ যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব কষেই রেখেছিল: ৫০ হাজার ইউক্রেনীয় নিহত হবে, ৫০ লাখ হবে শরণার্থী। কিন্তু পুতিন যখন সত্যিই ইউক্রেনীয় এলাকায় ‘শান্তিরক্ষী’ পাঠালেন, তখন কোনো পক্ষ থেকেই কামান ফুটল না, বিমান উড়ল না! যুক্তরাষ্ট্র ও তার বশংবদ বন্ধু যুক্তরাজ্য চেয়েছিল পুতিনকে হিটলারের মতো আগ্রাসী করে দেখাতে। কিন্তু যমজ শিশুরাষ্ট্র দুটির পক্ষে দাঁড়িয়ে পুতিন নিলেন শান্তিরক্ষীর সাজ। ন্যাটোর পক্ষে এখন নতুন দুটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নামা মানেই ‘আগ্রাসনের’ অভিযোগ নিজের ঘাড়ে নেওয়া। এভাবে বাইডেনের খেলা বাইডেনকেই ফেরত দিলেন ভূরাজনৈতিক বাজিগর পুতিন।
নিঃসন্দেহে পুতিন একজন একনায়ক। কিন্তু পশ্চিমাদের পুতুলবালক ইয়েলেৎসিনের চেয়ে জাতীয়তাবাদী পুতিনকেই যে রুশদের পছন্দ। তিনি সোভিয়েত-পরবর্তী নাস্তানাবুদ দশা থেকে রাশিয়াকে টেনে তুলেছেন। ইউক্রেন সংকটের মধ্যেও তিনি কেবল আঞ্চলিক রাজনীতি করছেন না, রাশিয়ার পুনরুত্থানের বাধাগুলো সরাতে চাইছেন।

পূর্ব ইউক্রেন রুশভাষী বিধায় রুশপন্থী। পশ্চিম ইউক্রেনের ঝোঁক ইউরোপমুখী। পুতিন পশ্চিম ইউক্রেন দখলে নিয়ে আরেকটা আফগান ফাঁদে পা দেবেন না, এটা নিশ্চিত। বরং নিপার নদীর পূর্ব দিকের ইউক্রেনকে দখলে নেবেন বলে মনে হয়। ওই অঞ্চলের রুশভাষীরা সানন্দে তা মেনেও নেবে। অবস্থাটা হবে সুকুমার রায়ের ছড়ার সেই ছাগলের মতো: রামছাগলের অর্ধেকটা বাঘে খেয়েছে বলে বাকি অর্ধেকটা সেই দুঃখে মরে গেল! অর্ধেক ইউক্রেন রুশ হয়ে গেলে বাকিটাও একসময় রাশিয়ার হাতে এসে পড়বে। আজ ইউক্রেনকে ভাঙতে সফল হলে রাশিয়া তার সীমান্তের লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়াকেও নিস্তার দেবে না।

পুতিন তিনটি হুমকি মোকাবিলা করছিলেন। রাশিয়াকে ঘিরে পশ্চিমাদের তরফে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক তিনটি প্রক্রিয়া চলছিল: পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো সম্প্রসারণের সামরিক হুমকি, সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে নেওয়ার অর্থনৈতিক হুমকি এবং রাশিয়ার ঘরের কাছে একের পর এক মার্কিন-স্পনসর্ড রঙিন বিপ্লবের মাধ্যমে রুশবিরোধীদের ক্ষমতায়ন। এ তিনটির কোনো একটি সফল হলেই রাশিয়ার জন্য মাথা উঁচু করে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। এ তিনটি প্রক্রিয়ার প্রধান নিশানায় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বিতীয় বৃহত্তম অঙ্গ ইউক্রেন। ইউক্রেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে নেওয়া, ন্যাটোবলয়ে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া চলমান। তবে তৃতীয় লক্ষ্যটি হাসিল হয় ২০১৪ সালে। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে রুশপন্থী সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসে সাবেক কৌতুকাভিনেতা জেলেনস্কি। বলা হয়, জেলেনস্কিকে ক্ষমতায় বসানোর ময়দান চত্বরের আন্দোলনে যুক্তরাষ্ট্র ৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছিল। রুশপন্থী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের পতনের পরিকল্পনাকারী ছিলেন সে সময়ের মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডারসেক্রেটারি নুলান্ড ভেবেছিলেন, পুতিনের পতনের সূচনা হলো। মার্কিন কংগ্রেসের কাছে স্বীকারোক্তিতে তিনি জানিয়েছিলেন, রাশিয়ার পালাবদলের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯২ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ২০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। একই কাজ যদি রাশিয়া বা চীন করত, বসে থাকতেন যুক্তরাষ্ট্রের শাসকেরা?

তাহলে হুমকিতে আছে কে, যুক্তরাষ্ট্র না রাশিয়া? সবকিছুর পরও যুক্তরাষ্ট্র মানবেতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যের মালিক। এ অবস্থান ধরে রাখতে রাশিয়া ও চীনের উত্থান ঠেকিয়ে রাখা আমেরিকার জন্য জরুরি। কিন্তু ইউক্রেন কেন রাজরাজড়াদের যুদ্ধের ভেতর উলুখাগড়া হতে গেল? দুটি পরাশক্তির গিরিচাপে ফেলল? ইউক্রেনের বর্তমান শাসকদের ক্ষমতা ও বিত্তের সোপান বানিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পশ্চিম ইউক্রেনের রুশবিরোধী মনোভাব উসকে তারা দেশটার গণতান্ত্রিক ময়দানকে যুদ্ধের ময়দান বানিয়ে ফেলেছে। ফিনল্যান্ড বা সুইজারল্যান্ডের মতো নিরপেক্ষতা ছাড়া বড় রাষ্ট্রের ছোট প্রতিবেশীর শান্তির পথ নেই। কিন্তু রুশমুখী মার্কিন মিসাইল, বোমা-বারুদ আর মার্কিন সেনা বিশেষজ্ঞ আসতে দেওয়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল জেনেও তারা কেন এটা করল? স্বাধীনতাকে বিপদে ফেলে আন্তর্জাতিক মুরুব্বিদের খুশি করা যে আত্মঘাতী, তা ইউক্রেনকে বুঝতে হবে। ফলে রাশিয়া এখন কেবল দোনেৎস্ক-লুশানস্ককে স্বাধীন করেই থামবে না, পরিণতি ঘটবে ইউক্রেনের ভাঙনের মধ্যে দিয়ে।

পূর্ব ইউক্রেন রুশভাষী বিধায় রুশপন্থী। পশ্চিম ইউক্রেনের ঝোঁক ইউরোপমুখী। পুতিন পশ্চিম ইউক্রেন দখলে নিয়ে আরেকটা আফগান ফাঁদে পা দেবেন না, এটা নিশ্চিত। বরং নিপার নদীর পূর্ব দিকের ইউক্রেনকে দখলে নেবেন বলে মনে হয়। ওই অঞ্চলের রুশভাষীরা সানন্দে তা মেনেও নেবে। অবস্থাটা হবে সুকুমার রায়ের ছড়ার সেই ছাগলের মতো: রামছাগলের অর্ধেকটা বাঘে খেয়েছে বলে বাকি অর্ধেকটা সেই দুঃখে মরে গেল! অর্ধেক ইউক্রেন রুশ হয়ে গেলে বাকিটাও একসময় রাশিয়ার হাতে এসে পড়বে। আজ ইউক্রেনকে ভাঙতে সফল হলে রাশিয়া তার সীমান্তের লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়াকেও নিস্তার দেবে না।

বরং ভালো ছিল, রাশিয়া ন্যাটোর কাছ থেকে যে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চাইছিল, তা মান্য করা। বিনিময়ে ইউক্রেনের স্বাধীনতা রক্ষা পেত এবং বিশ্বও শান্তি পেত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইউক্রেন গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো ন্যাটোকে দিয়ে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলা। এই দ্বন্দ্বের শেষ ইউক্রেন দিয়ে হওয়ার নয়, এর পরিণতি হবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ধীরে ধীরে বিশ্ব কি ঘুমঘোরে হাঁটা মানুষের মতো সেদিকেই যাচ্ছে না?
ইউক্রেনের রাজনৈতিক ও ভাষাগত বিভক্তিই দেশটিকে ইউরোপ ও রাশিয়ার টানাটানির মধ্যে ফেলেছে। এ ঘটনার শিক্ষা এই, যদি দেশের শাসক পরাশক্তির খেলার ঘুঁটি হয়ে যান, যদি দেশে গভীর রাজনৈতিক বিভক্তি মেটানো না যায়, যদি সামর্থ্যের বাইরের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় কোনো দেশ জড়িয়ে যায়, তাহলে তার টিকে থাকাই অনিশ্চিত হয়ে যায়।

ইউক্রেনের এই ভাঙন যেন বিখ্যাত ইউক্রেনীয় বংশোদ্ভূত রুশ লেখক নিকোলাই গোগলেরই রচনা। তাঁর জন্ম ইউক্রেন হলেও লিখেছেন রুশ ভাষায়, থেকেছেন রাশিয়ায়। তাঁর কবরও হয় মস্কোতে। গোগলের সাহিত্যের অর্ধেকটা নিপার তীরবর্তী ইউক্রেন নিয়ে, বাকিটা রাশিয়া নিয়ে। গোগল তুমি কার? এই প্রশ্ন নিয়ে বিভক্ত রুশ ও ইউক্রেনীয় সমাজ। রাশিয়া যদি সত্যিই পূর্ব নিপার দখল করে নেয়, তাহলে গোগলও হয়ে যাবেন রুশীয়। রাশিয়া ইউক্রেনকে দেওয়া ক্রিমিয়া উপদ্বীপ ফেরত নিয়েছে, দোনেৎস্ক ও লুশানস্ক নিচ্ছে, এর আগে জর্জিয়া থেকে নিয়েছে ওসেতিয়া ও আবখাজিয়া। প্রতিটি ঘটনার পেছনে ছিল রুশ প্রতিবেশীদের ঘাড়ে বসে দেওয়া মার্কিন উসকানি। সর্বশেষ ঘটনায়ও রুশ পাল্লাই ভারী হলো। ইউক্রেনেই কি তবে এককেন্দ্রিক বিশ্বের কবর হতে যাচ্ছে? সেটা সময়ই বলে দেবে।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও প্রতিচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক।
faruk.wasif@prothomalo.com