পুতিনের যুদ্ধে চীনের ‘সাধারণ সমৃদ্ধি’ কি টিকে থাকবে

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং
ফাইল ছবি: রয়টার্স

এ মাসের শুরুতে যখন রুশ বাহিনী ইউক্রেনের শহরগুলোতে গোলাবর্ষণ করেছিল এবং চীনে কোভিড-১৯–এর সংক্রমণ নতুন করে বাড়ছিল, ঠিক সে সময় চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) নেতারা তাঁদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্ষিক রাজনৈতিক বৈঠক ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস এবং চায়নিজ পিপলস পলিটিক্যাল কনসালটেটিভ কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলেন। অনেক ওজনদার নথিপত্রের উপস্থাপন এবং দীর্ঘ বক্তৃতা উভয় সম্মেলনকে অন্য রকম উচ্চতা দিয়েছিল। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, ওই বৈঠক দুটিতে মহামারির কথা খুব কমই উল্লেখ করা হয়েছে এবং রাশিয়ার যুদ্ধের কথা একেবারেই আসেনি। চীন ইতিমধ্যে অর্থনৈতিকভাবে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেটিই ওই সম্মেলনের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল।

গত বছরের বেশির ভাগ সময় ধরে সিপিসির প্রচারাভিযান ও সরকারি বক্তৃতায় ‘কমন প্রোসপারিটি’ (সব শ্রেণির মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বা ‘সাধারণ সমৃদ্ধি’) কথাটি বারবার এসেছে। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং প্রায়ই এই সাধারণ সমৃদ্ধিকে ‘সমাজতন্ত্রের অবশ্য প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ’ বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সাধারণ সমৃদ্ধিবিষয়ক প্রচারণার রূপরেখা সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এখনো রয়ে গেছে। অনেক পর্যবেক্ষক আশা করেছিলেন, এই জোড়া অধিবেশনে সম্পূর্ণ না হলেও অন্তত আংশিকভাবে সেসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে। কিন্তু তা হয়নি। তার বদলে চীনের নেতারা ‘সমৃদ্ধি’ এবং ‘সবার জন্য সমৃদ্ধি’—এই দুটি টার্মকে শুধু সংক্ষিপ্ত এবং বিচ্ছিন্নভাবে উল্লেখ করেছেন।

এতে মনে হচ্ছে, দেশের ভেতরের ও বাইরের অস্থিরতার মুখে চীনের নেতারা তাঁদের অগ্রাধিকারগুলোর ওপর পুনরায় জোর দিচ্ছেন। অর্থনৈতিক বাধাবিপত্তি নতুন কিছু নয়। যদিও গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বার্ষিক কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক সম্মেলনে ২০২২ সালে চীনের অর্থনীতি চাঙা হবে বলে একটি উৎসাহব্যঞ্জক পূর্বাভাস উপস্থাপন করা হয়েছিল, তবে একই সঙ্গে সেখানে চাহিদা ও সরবরাহের ধাক্কা এবং বাজারের প্রত্যাশা দুর্বল হওয়ার ঝুঁকিগুলোও তুলে ধরা হয়েছিল। ওই সম্মেলনে নীতিনির্ধারকেরা উপসংহারে বলেছিলেন, ‘স্থিতিশীলতা’ নিশ্চিত করা এ বছরের জন্য চীনের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাঁরা বলেছেন, এই লক্ষ্য অর্জনে সম্পত্তি খাতের দুর্বল হওয়ার প্রবণতার রাশ টানতে হবে; একই সঙ্গে অর্থনীতিকে অতিরিক্ত উদ্দীপিত করার প্রলোভন থেকে বিরত রাখতে হবে।

গত তিন মাসে চীনের জন্য চ্যালেঞ্জটা অনেক বেশি কঠিন হয়ে উঠেছে। ক্রমবর্ধমান কোভিড-১৯ সংক্রমণের ফলে লকডাউনের ব্যাপ্তি ঘটেছে, যা ইতিমধ্যেই পণ্যের ব্যবহার প্রবাহকে মন্থর করেছে এবং পরিষেবা শিল্পগুলোকে হুমকিতে ফেলে দিয়েছে। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ ইতিমধ্যে জ্বালানি, সাধারণ পণ্য এবং খাদ্যের দাম বাড়িয়েছে। এটি মূল্যস্ফীতিকে ত্বরান্বিত করবে এবং বৈশ্বিক চাহিদা দুর্বল হওয়ার কারণে চীনা রপ্তানিকে আঘাত করবে। এই প্রেক্ষাপটে এ বছর চীনা সরকারের ৫ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির অর্জনের লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভবত অসম্ভব হবে। এমনকি চীনের জন্য ২ দশমিক ৫ থেকে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন কঠিন হবে। প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য এবং বেকারত্বের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি এড়াতে চীনের নেতারা ইতিমধ্যেই ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আরোপিত কর এবং ফি কমানোর পরিকল্পনা করেছেন।

রাশিয়ার আগ্রাসনে অনুভূত জটিলতা ইতিমধ্যেই চীনের সাধারণ সমৃদ্ধির লক্ষ্যকে হুমকিতে ফেলে দিয়েছে। কারণ, রাশিয়াকে সমর্থন দেওয়ায় বৈশ্বিক বাজার থেকে চীনের বিচ্ছিন্নতা আরও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে সি চিন পিং চীনের সব মানুষের ‘সাধারণ সমৃদ্ধি’ নিশ্চিত করার যে প্রচারাভিযান চালাচ্ছিলেন, তা মার খাচ্ছে।

তাই চীন সাধারণ সমৃদ্ধির প্রচারণা আপাতত বাদ দিয়েছে। তবে এটি সি চিন পিংয়ের জন্য একটি টোটেম (অনুসরণীয় প্রতীক) হিসেবে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, তিনি ২০৪৯ সালে প্রজাতন্ত্রের শতবর্ষ উদ্‌যাপন করার সময় একটি উন্নত অর্থনীতির সঙ্গে চীনকে একটি ‘মহান আধুনিক সমাজতান্ত্রিক দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছেন। সিপিসির দৃষ্টিতে সাফল্যের জন্য সামগ্রিক অগ্রগতির বদলে একক অগ্রগতি অর্জনের ওপর জোর দেওয়ার বিরূপ পরিণতিগুলোকে মোকাবিলা করা প্রয়োজন। কারণ, বৃহৎ বৃহৎ উদ্যোগের প্রতি মনোযোগ দেওয়া এবং বৃহৎ উদ্যোক্তাদের একচেটিয়া সমর্থন দিয়ে যাওয়া বড় অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা ও আয়বৈষম্য বাড়িয়ে দিয়েছে।

সিপিসি আশঙ্কা করছে, এই বিষয়গুলো উপেক্ষা করা হলে তা সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করতে পারে। তাই সমাজের সব মানুষের মধ্যে সম্পদের একটি ন্যূনতম সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। তবে এগুলোকে পশ্চিমা গণতন্ত্র হিসেবে সম্বোধন না করে তার বদলে চীনের নিজস্ব ঘরানার সামাজিক-কল্যাণমূলক সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে চীন রাজনৈতিক প্রচারণা চালাচ্ছে। সাধারণ সমৃদ্ধি অভিযানের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো বেসরকারি সংস্থাগুলোর ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে কঠোর করা এবং ‘পুঁজির সম্প্রসারণের শর্তাবলি’ আরও সুশৃঙ্খলভাবে ঠিক করা।

২০২০ সাল থেকে যখন সিপিসির কেন্দ্রীয় কমিটি ‘নতুন যুগে ব্যক্তিগত অর্থনীতির সম্মিলিত কার্যক্রমকে শক্তিশালী করা’র বিষয়ে নির্দেশনা জারি করেছে, তখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তারা অধিকতর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং ক্রমবর্ধমান ‘অনুপ্রবেশকারী নিয়মের’ সম্মুখীন হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, একেকটি প্রতিষ্ঠানে তিন বা ততোধিক পার্টি সদস্যকে ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মী নিয়োগ, তত্ত্বাবধান এবং ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট হতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। আরও বিস্তৃতভাবে বললে বলা যায়, প্রাইভেট ফার্মগুলোর উপাত্তসংক্রান্ত গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা সরকারি তদন্তের মুখোমুখি হচ্ছে।

সিপিসির নিয়ন্ত্রকদের হস্তক্ষেপের হুমকির কারণে আলিবাবা এবং টেনসেন্টের মতো নেতৃস্থানীয় সংস্থাগুলো পার্টির বিভিন্ন কার্যক্রম ও প্রকল্পে অনুদান দিতে বাধ্য হচ্ছে। এটি শুধু ‘জোরপূর্বক করপোরেট জনহিতৈষী অনুদান’ হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। তারা শত শত কোটি ডলার অনুদান দিয়েছে অথবা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। চীনের আজকের উত্থানে বাজারভিত্তিক যে নীতিগুলো সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে, সাধারণ সমৃদ্ধির নীতি সেই বাজারভিত্তিক নীতিগুলোকে অস্বীকার করছে।

তবে রাশিয়ার আগ্রাসনে অনুভূত জটিলতা ইতিমধ্যেই চীনের সাধারণ সমৃদ্ধির লক্ষ্যকে হুমকিতে ফেলে দিয়েছে। কারণ, রাশিয়াকে সমর্থন দেওয়ায় বৈশ্বিক বাজার থেকে চীনের বিচ্ছিন্নতা আরও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে সি চিন পিং চীনের সব মানুষের ‘সাধারণ সমৃদ্ধি’ নিশ্চিত করার যে প্রচারাভিযান চালাচ্ছিলেন, তা মার খাচ্ছে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • জর্জ ম্যাগনাস অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির চায়না সেন্টারের একজন গবেষণা সহযোগী