পুতিন ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অপরাধের বিচারের দাবি জোরালো হচ্ছে
পুতিন ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অপরাধের বিচারের দাবি জোরালো হচ্ছে

মতামত

পুতিনের বিচারের দাবি এখন বৈশ্বিক

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বিশ্ব রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। পাশাপাশি জেলেনস্কি সরকারকে মানবিক ও সামরিক সহায়তা তারা দিচ্ছে। কিন্তু এসব পদক্ষেপ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের যুদ্ধাপরাধ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ইউক্রেনে প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছেই। ইউক্রেনের জনগণের বীরত্ব ও সংহতি ইউরোপ ও বিশ্বের বেশির ভাগ অংশের মানুষের সম্মিলিত চেতনাকে আলোড়িত করছে। ফলে পুতিন ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অপরাধের বিচারের দাবি জোরালো হচ্ছে।

এই দাবি বৈশ্বিক। বিশ্বের ১৪০ জন খ্যাতনামা আইনবিদ ও সাবেক নেতা ‘ইউক্রেনে আগ্রাসনের অপরাধের বিচারের জন্য বিশেষ আদালত’ গঠনের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। ধারণাটি প্রথম লন্ডনের ফিলিপ স্যান্ডস অব ইউনিভার্সিটি কলেজ থেকে প্রস্তাব করা হয়। ইউক্রেনের প্রধান বিচারক এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, পুতিন ও তাঁর বাহিনী ইউক্রেনে যে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছে, সেটার তথ্য-প্রমাণ তিনি জোগাড় করছেন। জার্মানি ও পোল্যান্ডের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও তাদের নিজেদের মতো তদন্ত শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক আদালতে চিলির সাবেক স্বৈরশাসক অগাস্তো পিনোশের বিচার হয়েছিল। সেই উদাহরণ থেকে স্পেনের একজন ম্যাজিস্ট্রেট একটি মামলার খসড়া তৈরি করছেন, যাতে পুতিন ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা যায়।

এ ছাড়া ৩৯টি দেশের অনুরোধে সাড়া দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান বিচারক ইউক্রেনে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত শুরু করেছে। (যদিও আইসিসি আগ্রাসনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে রাশিয়াকে বিচার করার এখতিয়ার রাখে না)। জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক কাউন্সিলের অনুসন্ধান কমিশনের হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচলেট ঘোষণা করেছেন, তাঁর সংস্থা মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও আগ্রাসনের নথিপত্র সংগ্রহ করবে। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত থেকে রাশিয়ার নিয়োগ করা প্রতিনিধি পদত্যাগ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। চরম নিষ্ঠুর পন্থায় আইন লঙ্ঘন করছে, এমন একটি দেশের প্রতিনিধিত্ব করা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।’

পুতিনের অপরাধের মাত্রা এত বেশি যে উপরিউক্ত সব কটি তদন্ত উদ্যোগ যেমন প্রয়োজনীয়, আবার সেগুলোকে স্বাগত জানানো উচিত। ইউক্রেনের জনগণের কাছে একটা বার্তা পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন যে তাদের সঙ্গে যে অন্যায় হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে বিশ্ব দাঁড়িয়েছে। রাশিয়ার শাসকদের কাছেও এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন যে পুতিনের যুদ্ধের সহায়ক হলে, কেউই দায়মুক্তি পাবে না।

যুগোস্লাভিয়া ও রুয়ান্ডাতে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য বিশেষ আদালত গঠনের ব্যাপারে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছিলেন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সেই আদালতকে সমর্থন করেছিল। এখন সেই ধরনের একটি আদালত প্রতিষ্ঠার প্রাসঙ্গিকতা আবার এসেছে। এ কাজে নৈতিক নেতৃত্ব দিতে হবে আমেরিকাকে।

ইউক্রেন ইস্যুতে বিশেষ আন্তর্জাতিক আদালত গঠনের উদ্যোগকে ইউরোপের সরকারগুলোর সমর্থন দেওয়া উচিত। কিন্তু এর ফাঁকে আমরা একটি অন্তর্বর্তী কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে পারি, যেখানে আগ্রাসনের মতো অপরাধের তদন্ত করা যায়। একজন অন্তর্বর্তী প্রসিকিউটর নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন, যিনি দলিলপত্র সংগ্রহ করবেন এবং বিচারের ধরন ও প্রক্রিয়ার মতো মৌলিক প্রশ্নগুলোর সমাধান করবেন। হেগ হতে পারে এ ধরনের কার্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা। অন্তর্বর্তী কার্যালয়ের জন্য ১০ জনের বেশি জনবল প্রয়োজন নেই। এক বা দুটি দেশের আর্থিক সহায়তায় অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্য অন্তর্বর্তী সংস্থাটি আইসিসির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পারে।

আগ্রাসনের মতো অপরাধ তদন্ত ও বিচার অপেক্ষাকৃত সোজাসাপ্টা একটি বিষয়। আগ্রাসনের পরিকল্পনা ও শুরুর সঙ্গে কারা যুক্ত এবং কারা এ ক্ষেত্রে প্রভাবিত করেছে, সেটি খুঁজে বের করতে হবে। আমেরিকার একদল আইনজীবী এরই মধ্যে পুতিনের আগ্রাসনমূলক কাজের তথ্য-প্রমাণাদি সংগ্রহের ক্ষেত্রে অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক কাজ করেছেন। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল ও ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে সৈন্য পাঠানোর ঘটনা থেকে তাঁরা এটি শুরু করেছেন।

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে পুতিনের এই আগ্রাসনমূলক অপরাধের পরিসমাপ্তি ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন হামলার মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে না। ইউক্রেনের নগর ও শহরগুলোর ওপর যেসব হামলা চলছে, দেশটির নির্দোষ জনগণকে যেভাবে হত্যা করা হচ্ছে, মানবিক করিডর ও যুদ্ধবিরতির প্রতি পুতিনের বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দখল করে ইউক্রেন সরকারকে চাপ দেওয়ার মতো প্রতিটি ঘটনা আগ্রাসনমূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত হবে।

যুগোস্লাভিয়া ও রুয়ান্ডাতে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য বিশেষ আদালত গঠনের ব্যাপারে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছিলেন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সেই আদালতকে সমর্থন করেছিল। এখন সেই ধরনের একটি আদালত প্রতিষ্ঠার প্রাসঙ্গিকতা আবার এসেছে। এ কাজে নৈতিক নেতৃত্ব দিতে হবে আমেরিকাকে। বিশেষ আদালত গঠনের প্রাসঙ্গিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সে সময় ক্লিনটন বলেছিলেন, এ আদালত কোনো বর্ণ-ধর্ম বা বিশেষ গোত্রকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য গঠিত হচ্ছে না। কিন্তু যারা মুষ্টিবদ্ধ হাত চালনা করছে, আর যারা স্বেচ্ছায় দুবাহু বাড়িয়ে দিচ্ছে, দুই দলের মধ্যে পার্থক্যরেখা টানার জন্য এটি হচ্ছে।

ক্লিনটনের বক্তব্যের সারকথা হচ্ছে, পার্থক্যরেখা টানাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আজ আমাদের সামনেও একই দায়িত্ব এসে পড়েছে। আজ আমাদেরও পার্থক্যরেখা টানা দরকার। এর এক পাশে আছেন, যারা মনে করেন ‘আমাদের’ ও ‘তোমাদের’ মধ্যকার অনন্ত যুদ্ধ কখনোই শেষ হওয়ার নয়। অন্য পক্ষে আছেন, যাঁরা আমাদের একই ধরনের মানবিকতাকে আলিঙ্গন করেন। রাশিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধের তথ্য সংগ্রহ, সেগুলো নথিভুক্ত করা ও বিচার শুরুর মাধ্যমে আমরা ইউক্রেনের জনগণ ও বিশ্বকে একটি বাস্তবসম্মত আশা দিতে পারি। সেটা হলো, ন্যায়বিচার হবেই।

গর্ডন ব্রাউন যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জাতিসংঘের বৈশ্বিক শিক্ষাবিষয়ক বিশেষ দূত