মতামত

পুতিনের কর্মকাণ্ডে একজন রুশ হিসেবে আমি লজ্জিত

পশ্চিমা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে পুতিনবিরোধী বিক্ষোভ। সেখানে রুশ জনগণের জন্যও তৈরি হয়েছে অনিরাপত্তা। যুক্তরাষ্ট্রে লস অ্যাঞ্জেলসে
ছবি: এএফপি

একজন রাশিয়ান হিসেবে কি আমার দুঃখ প্রকাশ করা উচিত? আমার কি লজ্জিত হওয়া উচিত? এক দশক ধরে এসব প্রশ্ন আমার ভেতরে কাজ করছে। যখন আমার দেশ আবারও ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বিশ্বব্যাপী সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হলো, আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না। আমি রাশিয়াকে ভালোবাসি। কিন্তু সেটি নিয়ে কীভাবে আমি গর্ববোধ করতে পারি, যখন এটি নিজ নাগরিকদের জন্য বা বিশ্বের জন্য সর্বশেষ কোন ভালোটা করেছে, তা আমি মনে করতে পারি না।

২০১৪ সালে রাশিয়া যখন ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ করে নেয়, তখন সেটির গুরুত্ব বুঝতে আমি অনেক ছোট ছিলাম। তবে এখন বুঝতে পারছি, সেই সিদ্ধান্ত ছিল একেবারেই ভুল এবং এর জন্য রুশ সরকারের পদক্ষেপকেই আমি দায়ী করব। আমি বলব, আপনার দেশের এমন কিছুকে মেনে নেওয়া উচিত নয়, যেটি আপনি পছন্দ করছেন না।

পরের মাসগুলোতে, রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়ার আচরণ আন্তর্জাতিক মহলের নিন্দাকেই সে ডেকে আনে এবং রুশোফোবিয়া (রুশবিদ্বেষ) ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময়ে আমি যুক্তরাজ্যে অধ্যয়নরত ছিলাম। তখন নিজেকে বারবার বোঝাতে চেয়েছি যে ‘আমি পুতিনকে ভোট দিইনি’, ‘আমি যুদ্ধ সমর্থন করি না’। কিন্তু একবার লন্ডনে একটি কনসার্টে গিয়ে আমার বন্ধুরা একটি ব্যান্ডের সদস্যদের জিজ্ঞাসা করে যে তারা কখন রাশিয়ায় একটি শো করবে। গায়কের প্রত্যুত্তর ছিল, ‘যখন আপনারা বিমান ধ্বংস করে দেওয়া বন্ধ করবেন।’ তিনি সেই গ্রীষ্মের শুরুতে পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়াপন্থী বিদ্রোহীদের দ্বারা ভূপাতিত মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের বিমানের কথা উল্লেখ করছিলেন। সেই ট্র্যাজেডির জন্য আমাদের কোনো দায় না থাকলেও গায়কের সেই মন্তব্য এখনো আমাকে আঘাত করে।

রুশ সরকারের জঘন্য কর্মকাণ্ড রুশোফোবিয়া উসকে দিয়েছে এবং গোটা বিশ্ববাসীকে আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ফলে এসব কর্মকাণ্ড অনেকের জন্য ভোগান্তির কারণ হয়েছে এবং আমাদের আরও বেশি পঙ্গু করে দিয়েছে। আমার মনে আছে, ক্রিমিয়া অধিগ্রহণের সময় এক পাউন্ডের মূল্য হয়ে পড়ল ১১৫ রুবল, কয়েক মাস আগে আমি যখন প্রথমবারের মতো যুক্তরাজ্যে এলাম, সে সময়ের তুলনায় ১৫৫ শতাংশ বাড়তি।

আমরা যুদ্ধ চাই না, আমরা আজকে ইউক্রেনীয় ভাইবোনদের প্রতি সংহতি জানাচ্ছি। আমরাও এই যুদ্ধের কারণে ভুগছি, আমরাও এই ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসনের শিকার। এরপরও আমি আমার লজ্জা ঝেড়ে ফেলতে পারি না। আমি লজ্জিত যে আমি একজন রুশ।

হঠাৎ আমার সরকার এমন কিছু করল, যার ওপর আমার নিয়ন্ত্রণ ছিল না; এতে আমার জীবন, আমার শিক্ষা, আমার ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়েছিল। আমার পরিবারের পর্যটন ব্যবসা ধসে গিয়েছিল। রাশিয়ান মুদ্রায় আমাদের পুরো সঞ্চয়, অন্য দেশে শিক্ষা-জীবনযাত্রা-ভাড়ার ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। সেই ধাক্কার পর রুশ অর্থনীতি এখনো পুনরুদ্ধার হয়নি। কিন্তু মানুষের জীবন তো থেমে থাকে না। আমরা সীমিতভাবে জীবন যাপন করতে শিখে গিয়েছি। অনেক কিছুই আমাদের সামর্থ্যের বাইরে চলে গেছে, তা মেনে নিয়েছি। পুতিনের আগে রাশিয়ার নাগরিকদের জীবন কেমন স্বাচ্ছন্দ্যময় ছিল, সেসব অগ্রজদের কাছে শুনলে এখন গল্পই মনে হয়।

এখন মানুষ এমন জীবনে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্ব যখন ইউক্রেনে আরেকটি রুশ আক্রমণের আশঙ্কা করছিল, তখনো মস্কোতে জনজীবন ছিল একেবারে স্বাভাবিক। খুব কম মানুষের আলোচনার মধ্যে বিষয়টি আছে। আমরা আট বছর ধরে ইউক্রেনের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ অবস্থায় আছি, ফলে আমাদের জন্য এই জল্পনা নতুন কিছু ছিল না। কিন্তু ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাশিয়ার সর্বাত্মক হামলায় ইউক্রেনের জনগণ যখন দুঃস্বপ্নের মধ্যে জেগে উঠল, রাশিয়ার জনগণের মধ্যেও একই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলো। যদিও দুই দিকের পরিস্থিতি কোনোভাবেই তুলনাযোগ্য নয়। জানালার বাইরে আমরা বিস্ফোরণের শব্দ শুনছি না, আমাদের রাস্তায় ট্যাংকের চলাচল নেই এবং আমাদের কোনো প্রাণের ভয় নেই। কিন্তু আমরা যখন টিভি খুলছি, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনাম দেখে বুঝতে পারছি, যে জীবনকে আমরা জানতাম তা আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চলেছে। আমাদের ইউক্রেনীয় প্রতিবেশীদের মতো রাতারাতি আমরাও রুশ সরকারের শিকার হয়ে গেলাম। না আমরা এই যাতনা কারও কাছে প্রকাশ করতে পারছি, না কারও কাছে সমর্থন চাইতে পারছি।

পুরো অনলাইন দুনিয়ায় আচমকা ঘৃণ্য আক্রমণের শিকার হয়ে পড়ল রুশরা—আমাদের মতো লাখ লাখ মানুষ, যারা এই যুদ্ধ কখনো চায়নি, যুদ্ধকে সমর্থনও করে না, এমনকি যুদ্ধ বন্ধ করার কোনো সুযোগও তাদের নেই। আমার সঙ্গী যে কি না হন্যে হয়ে একটি চাকরি খুঁজছে, সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিভি থেকে তার রুশ পরিচয় বাদ দিয়ে দেবে। ইউরোপীয়রা একজন রুশকে কোনো চাকরিতে নিয়োগ দেবে না, এমন ভয় তার ভেতরে ঢুকে গেছে। আমি এটিকে অহেতুক মাথা বিগড়ে যাওয়া মনে করতাম, যদি না ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু দেশ ইতিমধ্যে রুশদের ভিসা বন্ধ করে না দিত।

ইউরোপের শহরগুলোতে বিক্ষোভকারীদের এবং টিভি শোগুলোতে রাজনৈতিক নেতা ও বিশেষজ্ঞদের প্রতিক্রিয়ায় এটি স্পষ্ট যে, পুতিনের এসব কর্মকাণ্ডের জন্য আমরাই দায়ী। তারা বিশ্বাস করে, এই যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের কাছে আছে, কিন্তু আমরা কিছু করছি না। এমনকি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও এমন বিবৃতি দিয়েছেন এবং এই হামলার প্রতিবাদ জানাতে আমাদের আহ্বান করেছেন।
সত্য কথা হচ্ছে, অধিকাংশ রুশ শুধু এই যুদ্ধ নয়, কোনো যুদ্ধই চায় না। ফলে রাশিয়ার জনগণ কিন্তু জেলেনস্কির আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে। মস্কো, সেন্ট পিটার্সবার্গসহ ৪০টি রুশ শহরের রাস্তায় নেমে এসেছে মানুষ। ২৪ ঘণ্টার ভেতরে আঠারো শর বেশি বিক্ষোভকারী গ্রেপ্তার হয়েছেন। এমনটা হবে জানা সত্ত্বেও আমরা রাস্তায় নামার ঝুঁকি নিয়েছি। কারণ, আমরা বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, পুতিনের শাসন আমাদের প্রতিনিধিত্ব করে না।

আমি জানি না, ইউক্রেনীয়রা কোন পরিস্থিতির মধ্যে আছে। কারণ, আমি জানি না সাইরেনের শব্দে জেগে উঠতে, টিউব স্টেশনে লুকিয়ে থাকতে, পরবর্তী গোলাটি আমার ঘরে আঘাত হানছে কি না, এমন ভয় পেতে কেমন লাগে। কিন্তু আমি তাদের ক্ষোভ, ঘৃণা, বিরক্তি ভাগ করে নিতে চাই। আমি জানি আমার মতো অনেক রুশেরও একই অনুভূতি হচ্ছে।

একটি শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্রের ওপর আক্রমণ চালানো ঘৃণ্য কাজ, কোনো ইতিহাস দিয়েই এটি বৈধ করা যায় না। এটি আমাকে অসুস্থ করে তোলে যে আমাদের ভ্রাতৃপ্রতিম দেশগুলোকে পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা যুদ্ধ চাই না, আমরা আজকে ইউক্রেনীয় ভাইবোনদের প্রতি সংহতি জানাচ্ছি। আমরাও এই যুদ্ধের কারণে ভুগছি, আমরাও এই ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসনের শিকার। এরপরও আমি আমার লজ্জা ঝেড়ে ফেলতে পারি না। আমি লজ্জিত যে আমি একজন রুশ।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: রাফসান গালিব

  • ম্যারউই ওলিনিক মস্কোভিত্তিক সাংবাদিক