বিশ্বের দেশে দেশে কর্তৃত্ববাদের উত্থান এখন রীতিমতো শঙ্কার আবহ তৈরি করেছে। এমন নয় যে বিভিন্ন দেশে হঠাৎ করে কেউ তেড়েফুঁড়ে এসে ক্ষমতার মসনদটি দখল করে বসছে। বরং নির্বাচন হচ্ছে, জনগণ ভোট দিচ্ছে, আর তাদের ভোটে তৈরি করা পথ দিয়েই ক্ষমতায় বসে শাসক কর্তৃত্ববাদী শ্বাস ফেলছেন গণতন্ত্রের ঘাড়ে। গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দিতে প্রতিষ্ঠা করা বিভিন্ন সংস্থা রীতি মেনে এ অবস্থার সমালোচনা করছে, বলছে, ‘এটা ভালো নয়’; কিন্তু আদতে কোনো নিদান দিতে পারছে না। কারণ রোগ নয়, উপসর্গটি নিয়েই সবাই ব্যস্ত।
বহু বছর ধরেই উদারনৈতিক গণতন্ত্র ও পুঁজি হাতে হাত ধরে চলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এই দুইয়ের মেলবন্ধনেই বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে, স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যার একচেটিয়াকরণ ঘটেছে। রাষ্ট্র, অঞ্চল বা বিশ্বের যেকোনো অসুখের নিদান হিসেবে হাজির করা হয়েছে উদারবাদী গণতন্ত্রকে, যার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে ব্যবস্থাপত্রে লেখা হয়েছে ‘মুক্তবাজার’ অর্থনীতির কথা। কিন্তু এখন অক্ষুণ্ন মুক্তবাজার অর্থনীতির কক্ষে উদারবাদী গণতন্ত্রই শয্যা নিয়েছে। কর্তৃত্ববাদের ছুরির তলায় অস্ত্রোপচার চলছে তার। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা—সবখানেই এ অস্ত্রোপচার চলছে একযোগে। কোথাও প্রকট হয়ে উঠেছে চিহ্নগুলো, কোথাও এখনো কিছুটা প্রচ্ছন্ন।
কর্তৃত্ববাদের জন্য চীন, রাশিয়াসহ কিছু দেশ আগে থেকেই বিশ্ববিবেক বলে পরিচিত অংশের সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু ছিল, এখনো আছে। এই সমালোচনার ক্ষেত্রে আদর্শ হিসেবে সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের গণতান্ত্রিক কাঠামোর উদাহরণ টানা হতো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া ও অনুমিত পথেই বিভিন্ন কট্টর সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে এই উদাহরণ আর কাজ করছে না। অবশ্য গণতন্ত্রের উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগেই তার আবেদন হারিয়েছে। বিশেষত, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে গত কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে যে তৎপরতা চালিয়েছে এবং এর ফলে যে দীর্ঘমেয়াদি সহিংসতা ও রক্তপাতের সূচনা হয়েছে, তাতে গণতন্ত্রের মুখেই কালি লেগেছে সবচেয়ে বেশি।
সম্প্রতি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম ধাপে অনুমিতভাবেই জয়ী হয়েছেন জায়ের বোলসোনারো। সব হিসাব ঠিক থাকলে দ্বিতীয় ধাপেও তিনি জয়ী হতে যাচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে। তাঁর এ নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্ব আরেকজন কট্টর ডানপন্থী নেতার দর্শন পেতে যাচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। শুধু ব্রাজিল কেন, সারা বিশ্বেই এখন কর্তৃত্ববাদী শাসনের উত্থান ঘটছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিভিকাসের ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের মাত্র ৩ শতাংশ লোক বর্তমানে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক আবহে বাস করতে পারছেন, যেখানে প্রতিবাদ, মতপ্রকাশ ও সে অনুযায়ী সুফল ভোগের সুযোগ রয়েছে। এমনকি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনেও বিশ্বের বর্তমান অবস্থাকে ‘কর্তৃত্ববাদ ও ফ্যাসিবাদের পূর্বাবস্থা’ বলে মত প্রকাশ করা হয়েছে।
বহুমত, রাজনৈতিক পরিসর সংকোচন, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদের আসনটি পাকাপোক্ত হয়। এটা সত্য যে বর্তমানে সারা বিশ্বে এই কর্তৃত্ববাদী শাসন লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির ঘাড়ে সওয়ার হয়েই হাজির হচ্ছে। কিন্তু এটাও মনে রাখা জরুরি, এ দুটি একটি আরেকটির সহায়ক হলেও আদতে এক নয়। লোকরঞ্জনবাদ কর্তৃত্ববাদের পথ শুধু। ক্ষমতায় বসার জন্য এই ধারা অনুসরণই এখন দস্তুর। দুটোকে এক মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে, এই দুটিরই ‘জাতীয় শত্রু’ কিংবা ‘প্রাক্তন গৌরব’ ও ‘পুনরুত্থান’ ধারণাকে জনপ্রিয় করার প্রয়োজন পড়ে।
বিশ্বে কর্তৃত্ববাদ নতুন নয়। বরং গণতন্ত্রের পুরোহিতদের মধ্যেই এ ধরনের শাসন ছিল অবিচ্ছেদ্য, সে ইউরোপ কিংবা যুক্তরাষ্ট্র, যার কথাই বলা হোক না কেন। অবশ্য পশ্চিমা দেশগুলোই প্রথম কর্তৃত্ববাদের বিপরীতে একমাত্র মহৌষধ হিসেবে পুঁজিবাদের প্রস্তাব করে। তারা বলে, পুঁজিবাদ ও উন্মুক্ত বাজারই বিশ্বকে কর্তৃত্ববাদের বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে। যদিও এখন এই দুইয়ের মেলবন্ধনকেই কর্তৃত্ববাদের সবচেয়ে বড় সহায়ক হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে। কারণ, এই দুই মিলেই মানুষের সবচেয়ে বড় বিমানবিকীকরণটি করেছে।
পুঁজি বরাবরই লাভের পেছনে ছুটেছে। এই ছোটার ক্ষেত্রে নিজের সব শিকল খুলে ফেলতে এনেছে মুক্তবাজার ধারণাটি। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকে পাশ কাটাতে একসময় যে মুক্তবাজার ধারণা এসেছে, তা-ই এখন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। শ্রমিক উৎপাদন ও শ্রম শোষণই তার স্বভাব। ফলে এই ব্যবস্থা প্রকল্পিতভাবেই এক পীড়নযন্ত্রের সূচনা করে। এ পীড়নের হাত থেকে মুক্তি পেতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আজকের গণতান্ত্রিক ধাপটিতে উন্নীত হয়েছিল বিশ্ব। কিন্তু ভেতরের অসুখ এই ব্যবস্থাকেও ক্ষয় করে ফেলছে। যে অর্থনৈতিক বণ্টন, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এই ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত, তার ওপরই একের পর এক আঘাত নেমে আসছে। মূলত, এটি অবধারিতই ছিল। কারণ, পশ্চিমা গণতন্ত্র বরাবরই অর্থনৈতিক বণ্টনকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে এবং অন্য দেশগুলোর সামনে রাখা ব্যবস্থাপত্রেও এই বিষয়কে এড়িয়ে যাওয়ার কথাই বলেছে। ফলে, এক দিনের নির্বাচনকেন্দ্রিক গণতন্ত্রের একটা ধারা তৈরি হলেও তাতে অর্থনৈতিক বণ্টন ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্নটি দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। এরই মঞ্চায়ন দেখা গেছে ২০১১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন শুরুর মধ্য দিয়ে। ওই আন্দোলনে যে তীক্ষ্ণ সত্যটি তুলে ধরা হয়, তা হলো পুঁজির গুড় শুধু ১ শতাংশ মানুষের পাতেই যাচ্ছে। বাকি ৯৯ শতাংশ তা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে। অর্থাৎ, মূল প্রশ্নটি ওঠে বণ্টন নিয়ে। বছর বছর প্রকাশিত হওয়া গবেষণা নিবন্ধগুলো জানিয়ে যায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিপরীতে ক্রমবর্ধমান অসাম্যের কথা।
স্নায়ুযুদ্ধের পর পুঁজিবাদী বিশ্বকাঠামোর যে বিজয়কেতন উড়েছিল, তা প্রথম বড় ধাক্কা খায় শূন্য দশকের গোড়ার দিকে। পশ্চিমে শুরু হওয়া এ মন্দা বড় আকার নিতে সময় লাগেনি। সে সময়ই পুরো ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কিন্তু সেদিকে নজর এড়িয়ে উপসর্গকেই মূল হিসেবে সামনে আনে পশ্চিমারা, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র। ফলে, সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক বণ্টনের প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বরং বড় বড় করপোরেশনকে আরও সহায়তা দিয়ে, দাবার ঘুঁটির নানা চালে তার সম্প্রসারণের নানা পথ তৈরি করে, তথাকথিত প্রবৃদ্ধির সমীকরণের দিকেই ছুটেছেন বিশ্বনেতারা। উন্নত দেশগুলোর এই প্রবণতা বরাবরের মতোই অন্ধভাবে অনুসরণ করেছে বাকি দেশগুলো। এই ক্ষেত্রে নীতিটি হলো বড় পুঁজি টিকে থাকলে তার চুঁইয়ে পড়া অবশেষ দিয়েই অগণিত জনতারও কিছু অগ্রগতি হয়। আর এভাবে একটা আপাত-স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক ছদ্মবেশ ধরে রাখা সহজ হয়।
এই পন্থা মোটামুটি কাজ করছিল। কিন্তু বাদ সাধল প্রযুক্তির অভাবিত অগ্রগতি। নতুন প্রযুক্তি তথ্যের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে দিল। বদলে গেল সংঘবদ্ধ হওয়ার চিরায়ত কৌশল। ফলে সত্যটি তেড়েফুঁড়ে বাইরে আসতে শুরু করল। এই যে পরিবর্তন, এর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে একরকম বিপাকে পড়ে গেছে রাষ্ট্র। কারণ, পুঁজির কাঠামোয় বিদ্যমান নানা সমীকরণের সঙ্গে চলতে গিয়ে সে নিজেই এখন এক বড় করপোরেশনে পরিণত হয়েছে, যার নির্বাচন থেকে শুরু করে তাবৎ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাধারণ মানুষ নয়, বরং পুঁজিই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গণতান্ত্রিক খোলসটি খুলে তাই নিজের করপোরেশন চরিত্রটি প্রকাশ করতে হচ্ছে রাষ্ট্রকে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদধারীর মতো করেই সে এখন নিজের ইচ্ছের প্রয়োগ দেখতে চায়, কোনো সমালোচনা নয়। উন্নয়নের নামে লাভের অঙ্কটি পকেটস্থ করার দিকেই তার তাবৎ খেয়াল।
অনেকে এ ক্ষেত্রে গত দশকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির টালমাটাল দশার বিপরীতে বাণিজ্যশক্তি হিসেবে কর্তৃত্ববাদী চীনের উত্থানকে কারণ হিসেবে দেখান। তাদের মতে, চীনের উন্নয়নই দেশটির ব্যবস্থাকে সবার সামনে মডেল হিসেবে হাজির করেছে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, দৃশ্যপটে চীন না থাকলেও এর কোনো হেরফের হওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ, পুঁজির অসুখের গোড়াতেই রয়েছে বণ্টন-অসাম্য। ফলে, প্রশ্নটি সামনে হাজির হবেই। আর এই প্রশ্নের মুখ আটকানোর জন্য বিচার, তথ্য ও মুক্তমতের পথ রুদ্ধ করা ছাড়া উপায় নেই। এসব করার পথে লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতিকে কাজে লাগানো হচ্ছে। কোথাও দুর্নীতি, কোথাও মাদক, কোথাও বেকারত্ব, কোথাও অনুৎপাদনশীলতাকে প্রতিপক্ষ ও তথাকথিত উন্নয়নকে একমাত্র মোক্ষ হিসেবে হাজির করে এক রাগী জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়ে ক্ষমতায় বসছে পুঁজির হেফাজতকারীরা। তারা চাইছে, কোনোভাবে শুশ্রূষা করে রোগটি ধামাচাপা দিতে পারলে আরও কিছুকাল কাটিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু আদতে মানুষ নতুন নানা প্রযুক্তি ও মাধ্যমের সুযোগ নিয়ে প্রশ্নটি সোজাসুজি করে ফেলছে। ফলে, তাকে রুখতে প্রকাশ ঘটাতে হচ্ছে কর্তৃত্ববাদী রূপ; প্রকাশ করতে হচ্ছে পুঁজিকে। আর সাধারণ খাবি খাচ্ছে কোন শাসক ভালো ছিল বা হবে—এই অতল সমীকরণে। বণ্টন-অসাম্য, রুদ্ধ মুক্তমত ইত্যাদি উপসর্গের ভিড়ে ভুলে যাচ্ছে পুঁজির অন্তর্গত ক্ষতের কথা।
ফজলুল কবির : সাংবাদিক