আমাদের কাজ মামুলিই ছিল বলা চলে। আমাদের পাসপোর্ট আছে, মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। রি-ইস্যু করতে হবে। কোনো পরিবর্তন নেই। ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। জানতে পারলাম, একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যাঁরা আসতে পারবেন, তাঁদের পাসপোর্টই গ্রহণ করা হবে; কিন্তু নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা লোকজন সেই সময়ের ১০ মিনিট আগেই জানালেন যে এরপর থেকে আর কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। ততক্ষণে আরও কিছু লোক এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা সময়ের মধ্যেই এসেছেন বলে নিশ্চিন্তই ছিলেন এতক্ষণ। হঠাৎ সময়ের আগেই আর ঢুকতে দেওয়া হবে না শুনেই নানা অনুনয় করতে শুরু করল লাইনে দাঁড়ানো নাগরিকদের একদল। আমি তখন ভাবছি, এই নাগরিকদের পয়েন্ট আছে। তাঁরা কীভাবেই–বা জানবেন যে আজকে লোকজনের চাপ বেশি বা যেকোনো কারণেই হোক নির্ধারিত সময়ের একটু আগেই বন্ধ করা হবে দরজা? নানা অনুনয়-বিনয়ের পরও দায়িত্বপ্রাপ্ত এনসিও অনড় থাকলেন। বুঝতে পারলাম, আমি নির্ভার থাকলেও আমার পেছনের অনেকেরই আর আজকে আবেদন জমা দেওয়া হবে না। একটু হলে আমারও এই অবস্থা হতো ভেবেও আমি ঠিক স্বস্তি বোধ করতে পারলাম না! ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে ও ধুলাবালু খেয়ে এই লোকগুলোকে আবার আসতে হবে?
একটু পর একজন নারী এসে বললেন, অনেক দূর থেকে ছোট শিশু নিয়ে এসেছেন, একটু যাতে বিবেচনা করা হয়। ভাবলাম, এইবার যদি করে। ততক্ষণে এনসিওর চেহারায় একটা আত্মতৃপ্তির ভাব ফুটে উঠেছে। অনেক মানুষকেই তিনি না বলে ফিরিয়ে দিতে পেরেছেন। ওই নারীকে একটা উঁচু জায়গা দেখিয়ে বললেন, ‘এই দিক দিয়ে গিয়ে স্যারকে বলেন। দেখেন কিছু হয় কি না।’ কিন্তু এত মানুষকে যে না করলেন, ফিরিয়ে দিলেন, কথায় বা ভাবে দুঃখিত হওয়ার কোনো চিহ্ন ফুটে উঠল না লোকটার মুখে। আমি অবাক বিস্ময়ে লাইনে দাঁড়িয়ে এসব দেখলাম!
আঙুলের ছাপ ও পাসপোর্ট স্ক্যান করে একটা রসিদ দিতে মোট তিনটি লাইনে দাঁড়াতে হলো। প্রথমবার ঢোকার লাইনটা ধরলে চারবার লাইনে। মোট সময় লাগল চার ঘণ্টা। যেসব রুমে দাঁড়াতে হলো, সেসব রুম ধুলায় ধূসরিত। টয়লেট দুর্গন্ধময়, এমনকি কোনো কোনো টয়লেটে ছিটকিনি নেই। বিষয়টি অবহিত করার জন্য উর্দি পরে থাকা একজন কর্মীকে কিছু বলতে গেলে লক্ষ করলাম, তিনি নিজের স্মার্টফোন থেকে নজর সরাতে পারছিলেন না। আমি ‘এক্সকিউজ মি’ শব্দটা একটু চড়া গলায় উচ্চারণ করাতে আমার দিকে তাকালেন। ছিটকিনি নেই শুনে প্রথম উত্তর: এখানে আমাদের কিছু করার নেই। আমি বললাম: তাহলে কারা দায়িত্বে আছেন? একটু দেখা করিয়ে দিন বা অভিযোগ বাক্সটি কোথায় দেখিয়ে দিন। ইংরেজি শব্দের কারণেই কি না জানি না, ততক্ষণে আমার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, দেখব।’ আমি তখন ভাবছি, একটু আগে কেন বললেন কিছু করার নেই! এই অব্যবস্থাপনার জন্য একটু সরি তো বলতেই পারতেন!
চার ঘণ্টা পর দুপুরের খাবারের সময় হলো। যেসব জায়গায় লাইন আছে, সেসব স্থানে কোনো খাবারের দোকান নেই। বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা কোনো সময় করা হয়েছিল, কিন্তু সম্ভবত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা নষ্ট পড়ে ছিল। বয়স্কদের কোনো লাইন দেখতে পারলাম না। এই পুরো সময়ে একজন ষাটোর্ধ্ব ভদ্রলোক তাঁর বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানকে নিয়ে আমার সামনে থাকলেন। লাইন ভেঙে একটু ঘুরে এসে আবার আমাদের সঙ্গেই যোগ দেওয়াতে জানতে চাইলাম, ‘এলডারলি পিপলদের কোনো লাইন পেলেন না?’ বললেন, ‘না।’ পরে দেখলাম, সে রকম একটা নির্দেশনা আছে, কিন্তু সেটা দেয়ালেই। বাস্তবায়নের জন্য যে প্রয়োজনীয় স্থানে সহায়তা দরকার, তার কিছুই নেই। এ কারণে আমরা সবাই এক লাইনে!
আরও কিছু বিস্ময় তখনো আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কোনো কিছু পর্যবেক্ষণের জন্য চার ঘণ্টা অনেক সময়! আমার পেছনে এক তরুণ দাঁড়িয়ে। একটু দাড়ি, বড় চুল। একজন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসারের কর্মী জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কী করো?’ তরুণ ছেলেটি প্রথমে তাঁর প্রশ্ন বুঝতে না পেরে উত্তর দিলেন না। দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করাতে বললেন, ‘ছাত্র।’ এরপরই সেই দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি বলে বসলেন, ‘বাউল–টাউল হওয়ার ইচ্ছা নাই তো!’ কথাটা শুনে তরুণটির সঙ্গে আমার বিস্ময়সূচক চাহনিটি শেয়ার করতে যাব ভেবে তাকালাম, কিন্তু তাকিয়ে মনে হলো তরুণটি খুব একটা আহত হননি। আমি এতেও একটু অবাক হলাম। ইউনিফর্মে থাকা কারও (সে যত ছোট বা বড় পদই হোক না কেন) কাছ থেকেও এই ধরনের মন্তব্য খুবই বেমানান ঠেকল আমার কাছে।
এসবই পাসপোর্ট অফিসে আমার এক দিনের অভিজ্ঞতা। একে কোনোভাবেই ভালো বলা সম্ভব নয়। যেদিকেই তাকাচ্ছিলাম, মানুষকে ভীষণ অবসন্ন দেখাচ্ছিল। সামান্য একটা কাজে তিন–চার কাউন্টার কেন ঘুরতে হবে, আমার এই মন্তব্য শুনে লাইনে থাকা এক ভদ্রমহিলা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘বুঝতে হবে, এটা বাংলাদেশ। এখানে অনেক নাটক!’
লাইনে থাকা অনেককেই বলতে দেখলাম যে তাঁরা নানা কারণে পাসপোর্ট সময়মতো হাতে পাননি বা পাচ্ছেন না। হয়তো অনেক কারণই আছে, তবে সরকারি কোনো দপ্তরে আমাদের কেন সব ক্ষেত্রেই বৈরী পরিবেশের মধ্যেই পড়তে হবে? আমরা তো পাসপোর্ট সংগ্রহ করার মতো একটি সাধারণ কাজেই গিয়েছি সেখানে? এর থেকে বেশি আইন মান্য করার কাজ আর কীই–বা হতে পারে? লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা বেশির ভাগ লোক ভীষণ বিরক্তি নিয়ে থাকলেন। পর্যাপ্ত বসার জায়গা পর্যন্ত নেই। এতটা অমানবিক হওয়ার দরকার কী? এমনকি হতে পারত না যে লোকজন খুব সহজ প্রক্রিয়ায়, অল্প সময়ে এবং হয়রানি ছাড়াই আনন্দের সঙ্গে পাসপোর্টের কাজ করে বাড়ি ফিরছেন? পাসপোর্ট হাতে পেয়ে ছবি তুলছেন!
জানি, এই সব ক্ষেত্রে ভিআইপি লাইন ধরা যায়। প্রায়ই দেখি, লোকজন সরকারি অফিসে কোনো কাজ থাকলেই পরিচিত কাউকে খুঁজে বের করেন। কেন? পরিচিত লোক ছাড়া কি কোনো কাজ করতে নেই? সরকারি কর্মকর্তারা এত গর্ব করেন কিসের? জনগণের ট্যাক্সেই তো সব চলে। তাহলে এই সাধারণ নাগরিকদের প্রতি এমন অবহেলাসুলভ আচরণ কেন? জবাব কি পাওয়া যাবে?
মাহমুদুল সুমন: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক