আমরা আট ভাইবোন। বড় ভাইবোনদের কারও কারও ম্যাট্রিক পরীক্ষা এবং আমার ও আমার ছোট বোনের এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার দিনগুলোর ঘ্রাণ আমি আজও পাই। মনে পড়ে, আশপাশের বাসা আর স্কুলের পরীক্ষার্থী বড় আপা, বড় ভাইবোনদের হঠাৎ সমীহ জাগানো চেহারার উদয় হতো স্কুলগুলোতে। আমরা জানতাম, তারা পরীক্ষার্থী। সাধারণত ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে পরীক্ষা হতো। ফেব্রুয়ারি থেকে আমের বোলে পাগল করা ঘ্রাণ বাতাসে। দিনগুলো উজ্জ্বল ঝকঝকে।
টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট হয়ে যেত নভেম্বরের শেষ বা ডিসেম্বরের শুরুতেই। তারপর আর স্কুলে যাওয়া নেই। ১০ বছর স্কুল জীবনশেষে প্রি-টেস্ট ও টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীরা (ম্যাট্রিক/এসএসসি ক্যান্ডিডেট নামেই তারা পরিচিত থাকত বাসায়, স্কুলে, পাড়ায়) আড়াই-তিন মাসের জন্য ঢুকে যেত বাসায়। পাড়ার মাঠে যারা ক্রিকেট খেলত দিনমান, গার্লস স্কুলের সামনে ঘোরাঘুরি করত যারা স্কুল কামাই করে, কিংবা যারা দুই বিনুনি বেঁধে রোজ স্কুল যেত সকাল-বিকেল, তারা সবাই তখন ‘ক্যান্ডিডেট’।
যারা সারা বছর পড়েনি, তারা পড়তে শুরু করত, রুটিন মেনে, টেস্টপেপার সলভ করে। আর যারা সারা বছর পড়েছে, তারা স্টার পাওয়ার জন্য, কেউ কেউ বোের্ড স্ট্যান্ড করার আশায় দিন-রাত উজাড় করে দিত এই তিন মাস। মা-বাবা সামর্থ৵ অনুযায়ী খাবারের পাতে একটু মাখন, বিকেলে চায়ের বদলে হরলিকস যোগ করতেন। এই বিশ্রাম আর যত্নে, নিয়ম করে পড়ার মধ্য দিয়ে তাদের চেহারা আড়াই-তিন মাসে খানিকটা বদলে যেত। দেখলেই কেমন সমীহ জাগত। পাড়ার অনুষ্ঠান বা যেকোনো উৎসব-মাহফিলে খেয়াল করা হতো আশপাশের বাড়িঘরে কেউ ক্যান্ডিডেট আছে কি না। থাকলে মাইকের শব্দ একটু কমিয়ে দেওয়া অবধারিত। পাড়ার সবাই জানত, কোন বাড়িতে কারা পরীক্ষা দিচ্ছে, কে কেমন রেজাল্ট করবে, সে বিষয়েও থাকত একধরনের প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা মা-বাবা-পরিবার ছাড়িয়ে পাড়া-মহল্লা-স্কুলেও থাকত। পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষার রুটিন পেত এক মাস আগে। রুটিন দেখে জানত কোন পরীক্ষার আগে কত দিন ছুটি। সেই অনুযায়ী তারা প্রস্তুতি নিত। কোনো পরীক্ষার আগে ছুটি কম, তো সেই পরীক্ষার প্রস্তুতি থাকত এক রকম। আর যদি ছুটি দু-তিন দিন, তো সেই বিষয়ের প্রস্তুতিও সেই অনুযায়ী।
আমি ঢাকার কথা জানি না, কিন্তু জেলা শহরগুলোতে দেখেছি, পরীক্ষার দু-এক দিন আগে আশপাশের বাড়ির মুরব্বিরা এসে খোঁজ নিতেন, নয়তো পরীক্ষার্থীরাই যেত আশীর্বাদ নিতে। পরীক্ষার দিনে তেল-জবজবে মাথায় পানি ঢেলে, পবিত্র চেহারায় ছেলেমেয়েরা যেত পরীক্ষা দিতে। শহরের সবাই জানতেন ম্যাট্রিক/এসএসসি পরীক্ষার দিন সেদিন। সেদিন যার পরীক্ষা, মহল্লার রিকশাস্ট্যান্ডে তাদেরই অধিকার আগে। দোয়া-দরুদ-মন্ত্র পড়তে পড়তে পরীক্ষার্থীরা যেত পরীক্ষার হলে, যেন প্রশ্ন কমন পড়ে।
পরীক্ষা যেদিন দুই পেপার, সেদিন বিরতিতে অভিভাবকেরা যেতেন খাবার নিয়ে। ডাবের দাম বেড়ে যেত। আর কেউ পরীক্ষার হল থেকে আগেই বের হলে হুমড়ি খেয়ে পড়তেন অন্য পরীক্ষার্থীদের অপেক্ষমাণ অভিভাবকেরা। নিশ্চিত হতে চাইতেন পরীক্ষায় প্রশ্ন কমন পড়েছে তো! পরীক্ষা শেষে হল থেকে বাসায় পৌঁছানো পর্যন্ত কতজন যে জিজ্ঞস করতেন পরীক্ষা কেমন হলো, প্রশ্ন সব কমন পড়ল কি না, বিশেষ করে বাংলা-ইংরেজি পরীক্ষায় রচনা কমন পড়ল কি না, অঙ্ক পরীক্ষার দিনে লেটার উঠবে কি না—এমন সব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে পরীক্ষার্থীরা ঘরে ফিরত। পরীক্ষা ছিল পরীক্ষার্থীদের ঘিরে এক উৎসব। সেই উৎসবের ঘ্রাণ ছড়ানো থাকত শহরজুড়ে। এই পরীক্ষার মধ্য দিয়েই কিশোর-কিশোরীরা বড় হয়ে উঠত যেন। গুরুত্ব পেতে শুরু করত। বড় হয়ে ওঠার দিনগুলোর স্বীকৃতি থাকত এই পরীক্ষা ঘিরে। আমার মনে হয়, পরিণত বয়সে সব মানুষই চোখ বুজলে দেখেন তাঁদের জীবনের অবশ্যম্ভাবী স্মৃতি সেসব পরীক্ষা-দিনের রং। এসব দিনে রাজনৈতিক আন্দোলন, হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি।
আমার এসএসসি পরীক্ষা ছিল এরশাদ আমলে। রাজনীতিতে, ছাত্ররাজনীতিতে তত দিনে অস্থিরতা যুক্ত হয়েছে। আমরা স্কুলে থাকতেই ১৯৮৩-এর মধ্য-ফেব্রুয়ারিতে সামরিক শাসকের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন জাফর-জয়নাল-কাঞ্চন-দীপালি সাহারা। তবু আমাদের পরীক্ষার দিনগুলো নির্বিঘ্ন ছিল। আমরা আমাদের জীবনের এসএসসি পরীক্ষার দিনগুলো প্রস্তুতিতে-শঙ্কায়-আশীর্বাদে পার করেছি।
এরপর দেশের রাজনীতি জটিল হয়েছে ক্রমাগত, যার ঝাপটা লেগেছে শিক্ষাঙ্গনে সবচেয়ে বেশি। নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে গেছে আমাদের শিক্ষার্থীরা। ক্রমাগত শিকার হয়েছে পরীক্ষার অনিশ্চয়তার হুমকির। ১৯৯৬ সালে প্রথম এসএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে যায় সে সময়কার বিরোধী দল আওয়ামী লীগের আন্দোলনের কারণে। এরপর নানা আন্দোলনে বারবারই শঙ্কায় থেকেছে পরীক্ষার্থীরা, কখনো এক-আধটু পিছিয়েছে। ২০১৩ সালে বড় হুমকির মুখে ছিল পরীক্ষার্থীরা। কিন্তু এ বছর অতীতের সব দুঃস্বপ্নকে ছাড়িয়ে গেছে এসএসসি পরীক্ষার সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোটের লাগাতার অবরোধ আর হরতালের কর্মসূচি। এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষাগুলোর মোট প্রায় ১৫ লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নিয়ে এমন রসিকতা বুঝি আর হয়নি। দৃশ্যমান কোনো আন্দোলন ছাড়াই, অজ্ঞাতনামা জায়গা থেকে এই দেশের প্রধান একটি দল, যে দলটি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকেছে, লাগাতারভাবে হরতাল আর অবরোধ করেই ক্ষান্ত থাকেনি, নিরীহ মানুষের ওপর পেট্রলবোমা ছুড়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরে যে নজিরবিহীন আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে, তেমনটি সত্যি ভাবা যায় না।
শিক্ষামন্ত্রী হাত জোড় করে পরীক্ষার দিনগুলোকে অন্তত হরতাল-অবরোধের বাইরে রাখার মিনতি জানিয়েছেন। মোট ১০ বিষয়ে পরীক্ষা হয় এসএসসিতে। এসব দিনকেও জিম্মি করা হলো। বাধ্য হয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারে পরীক্ষা নিতে বাধ্য হয়েছে। একবার তো গুজব ছড়িয়ে পড়ল শুক্রবারেও হরতাল চলবে। গত ৬৮ দিনের তথাকথিত ‘আন্দোলন’ বা হরতাল-অবরোধ-পেট্রলবোমা ছুড়ে মানুষ মারার দিনগুলোতে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ১২০ জনেরও বেশি মানুষ, তাঁদের সিংহভাগই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর। রেহাই পাননি পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি থেকে শুরু করে আড়াই বছরের শিশু পর্যন্ত। এখনো পুড়ছে মানুষ আর তাদের জীবন-জীবিকার শেষ সম্বল। পুড়ছে দেশের শিক্ষাবর্ষ।
সেদিন এক টক শোতে দেখলাম একজন বেশ বিচক্ষণ নারী আইনজীবী, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী সমিতির নেতাপর্যায়ের, মমতাময় চেহারা, চমৎকার তাঁর বাচনভঙ্গি, অথচ কী অবলীলায় বললেন, ১৬ কোটি মানুষের দেশে ১৫ লাখ ছেলেমেয়ের পরীক্ষায় এক-আধটু অসুবিধা নাকি বৃহত্তর স্বার্থে, গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে কম্প্রোমাইজড হতেই পারে। হতভম্ব হয়ে গেলাম। তাঁর কাছে ১৫ লাখ পরীক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন তাহলে সামান্য ক্ষতি! অথচ বিএনপিপ্রধান, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নিহত ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মেয়ে কিন্তু বাবার জানাজা শেষ করেই মালয়েশিয়া ফিরে গেছে তার ‘ও’ লেভেল পরীক্ষা শেষ করার জন্য। কোকোর সন্তানের পরীক্ষা নির্বিঘ্ন হোক, এটি যেমন চাই, তেমনি চেয়েছিলাম এ দেশের ১৫ লাখ পরীক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের মর্মও দেশের নেতারা বুঝবেন। কিন্তু সেটি হয়নি।
সারা বছরের প্রস্তুতি ছিল এক ধরনের, অথচ রুটিন প্রতি সপ্তাহে পাল্টে গেছে। এসএসসি পরীক্ষা শুরুর আগের দিন পত্রিকায় দেখলাম, বেশ কিছু শিক্ষার্থী মানববন্ধন করেছে, যেন পরীক্ষার মধ্যে হরতাল দেওয়া না হয়। আমি চিন্তা করলাম আমার এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগের দিনের কথা। সেদিন পথে বের হওয়া, তাও মানববন্ধন নিজেরই পরীক্ষার দিনের নিরাপত্তা চেয়ে! বুঝলাম কী ভীষণ পাল্টে গেছে দিন আমাদেরই চোখের সামনে। চোখের কোণ অজান্তেই ভিজে গেল। সেই থেকে লজ্জায় আছি। আসলে আমরা কিছুই করিনি এমন অমানবিক রাজনীতির বিপরীতে। হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে বলিনি, একটি দেশের ১৫ লাখ পরীক্ষার্থীর জীবন নিয়ে এমন রসিকতার নাম রাজনীতি নয়। রাজনীতিক আপনি যে-ই হোন না কেন, এই রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।
যারা এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষাগুলোর পরীক্ষার্থী, তারা এ দেশের রাজনীতির কেউ নয়। দেশের সরকার পরিবর্তন তত্ত্বাবধায়ক–পদ্ধতিতে হবে, নাকি সরকারি দলই করবে, এই মর্মে এখনো তাদের মাথাব্যথা নেই। তারা তো শুধু তাদের পরীক্ষাই দিতে চেয়েছিল। কেন তাদের জিম্মি করা? গ্রামের কত পরীক্ষার্থীর কেন্দ্র পড়ে থানা বা জেলা সদরে, তাদের কষ্টের কথা আর কী বলব!
পরীক্ষা-দিনের কাঙ্ক্ষিত ঘ্রাণ পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা, মনোজগতে গেঁথে যাচ্ছে পেট্রল-বারুদের তাড়া করা দুঃস্বপ্নের স্মৃতি। আমরা জাতিগতভাবে তাদের ন্যায্য পাওনা প্রথম বড় পরীক্ষার স্মৃতি এভাবে দুঃস্বপ্নে ভরিয়ে দেওয়া ‘গণতন্ত্র রক্ষার অান্দোলন’কে মেনে নিয়েছি। ভালো পরীক্ষার জন্য দোয়া-দরুদ পড়ার বদলে নিরাপদে পরীক্ষার হলে যাওয়া-আসার দোয়াই হয়ে উঠেছে তাদের কাছে মুখ্য। রাজনীতির এই নিকষ দিকটি কি সত্যিই দেখানো দরকার ছিল এসব কিশোর পরীক্ষার্থীর? তার পরও কি আমরা আশা করব, তারা এই দেশকে নিঃশর্ত ভালোবাসবে? উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ।
ড. কাবেরী গায়েন: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।