প্রতিবছর ২ ডিসেম্বর এলেই আমরা সরকার ও জনসংহতি সমিতির কাছ থেকে দুটি পরস্পরবিরোধী বিবৃতি পেয়ে থাকি। সরকারের দেওয়া বিবৃতিতে দাবি করা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার প্রায় পুরো সমাধান হয়ে গেছে। চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি পুরো এবং ১৫টি আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকিটাও বাস্তবায়িত হয়ে যেত, যদি সরকার জনসংহতি সমিতির পূর্ণ সহযোগিতা পেত। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বিবৃতিতে বলা হয়, চুক্তির দুই যুগ পরও সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার মূলে হাত দেয়নি। সরকার কেবল উপরিকাঠামোয় কিছু চুনকাম করেছে। কিছু প্রতিষ্ঠান করেছে। ফলে সেখানকার পরিস্থিতি দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির একটা পটভূমি আছে। সেখানে প্রায় দুই দশক যুদ্ধাবস্থা চলছিল। যখন পূর্বাপর সরকার দেখল সমস্যাটি রাজনৈতিক এবং শক্তি প্রয়োগে এর সমাধান পাওয়া যাবে না, তখন তারা জনসংহতি সমিতির সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেয়। আলোচনা শুরু হয় এরশাদের আমলে, খালেদা জিয়ার সময়েও আলোচনা হয়েছে এবং যৌক্তিক পরিণতি লাভ করে শেখ হাসিনার আমলে। এ জন্য শেখ হাসিনার সরকার অবশ্যই কৃতিত্ব দাবি করতে পারে। যাঁরা মনে করেন দেশটি কোনো বিশেষ ধর্মের ও গোত্রের মানুষের নয়, তাঁরা এই চুক্তি সমর্থন করবেন। যদিও রাজনৈতিক কারণে অনেকে অনেক সময় বিপরীত অবস্থান নেন। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে চুক্তি সই করেছিলেন তৎকালীন চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের পক্ষে জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা, যিনি সন্তু লারমা নামে অধিক পরিচিত। চুক্তির জন্য শেখ হাসিনা ইউনেসকোর ‘হুপে-বোয়ানি’ শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু পাহাড়ে শান্তি এসেছে কি? যদি না এসে থাকে, সে জন্য কে বা কারা দায়ী?
২.
কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দা নয়, সারা দেশের মানুষই আনন্দিত হতো, যদি দেখা যেত, চুক্তির ২৪ বছর পূর্তিতে চুক্তি সইকারী দুই পক্ষ সরকার ও জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধিরা একসঙ্গে বসে কথা বলছেন, চুক্তির যেসব ধারা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দিচ্ছেন, চুক্তি বাস্তবায়নের বাধাগুলো দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছেন। সরকারের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ বলছেন, পাহাড়ে এখনো সংঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আগে সংঘাত হতো বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যে। এখন পাহাড়িরা নিজেদের মধ্যেও হানাহানি করছেন। কিন্তু তাঁরা এ কথা বলছেন না যে চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণেই হানাহানি হচ্ছে। সেখানকার মানুষের মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস বেড়েছে।
সরকার বলছে, চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হয়েছে। সরকারের এই দাবি কি যৌক্তিক? চুক্তির শুরুতে বলা হয়েছে, ‘উভয় পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি-অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করিয়া এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এ অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করিয়াছেন।’ বাস্তবে কি পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতি-অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? সেখানে কি বাঙালি সেটেলর যাওয়া বন্ধ হয়েছে? চুক্তি সইয়ের সময় সেখানে পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর যে অনুপাত ছিল, তা আর এখন নেই। বাঙালি জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, হাটবাজারে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য। এখন উপজাতি-অধ্যুষিত অঞ্চলে পাহাড়িরাই সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছেন।
জনসংহতি সমিতি বলছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাদের যা যা করণীয়, সবই তারা করেছে। চুক্তি সইয়ের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জনসংহতি সমিতির সদস্যরা অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন। ভারতের ত্রিপুরায় আশ্রিত প্রায় ৭০ হাজার শরণার্থী দেশে ফিরে এসেছেন। কিন্তু এখনো অনেকে তাঁদের দখল হওয়া ঘরবাড়ি ও জমিজমা ফেরত পাননি।
জনসংহতি সমিতি বলছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাদের যা যা করণীয়, সবই তারা করেছে। চুক্তি সইয়ের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জনসংহতি সমিতির সদস্যরা অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন। ভারতের ত্রিপুরায় আশ্রিত প্রায় ৭০ হাজার শরণার্থী দেশে ফিরে এসেছেন। কিন্তু এখনো অনেকে তাঁদের দখল হওয়া ঘরবাড়ি ও জমিজমা ফেরত পাননি। তাদের অভিযোগ, চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে সাধারণ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদিসহ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও কার্যাবলি হস্তান্তর করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি।
তবে সরকার কিছুই করেনি, সে কথাও ঠিক নয়। চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় করা হয়েছে, পাহাড়িদের মধ্য থেকে একজন মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে। আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদও গঠন করা হয়েছে।
যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। সরকারি বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থাও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কাজ করছে। নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরও দীর্ঘদিন তিন পার্বত্য জেলা মুঠোফোন নেটওয়ার্কের বাইরে ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি-পাহাড়ি বাসিন্দাদের পাশাপাশি সেখানে পদায়িত সরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য কেউ মুঠোফোন ব্যবহার করতে পারতেন না। কিন্তু ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তিন পার্বত্য জেলায় মুঠোফোন নেটওয়ার্ক চালু করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীর বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের যে মূল সমস্যা ভূমিবিরোধ, তার সুরাহা হয়নি দুই যুগেও। চুক্তি সইয়ের পর এ পর্যন্ত পাঁচবার ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে। জনসংহতি সমিতির দাবি অনুযায়ী, আইনও সংশোধন করা হয়েছে। কিন্তু তারা কাজ শুরু করতে পারেনি বিধি জারি না হওয়ায়। পাহাড়িদের পক্ষ থেকে হাজার হাজার আবেদন জমা হলেও বিধি জারি না হওয়ায় নিষ্পত্তি হতে পারছে না।
চুক্তিতে আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য তিন জেলা পরিষদ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত করার কথা ছিল। আর সেই নির্বাচনের শর্ত ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী নাগরিকদের (উপজাতীয়, অ-উপজাতীয়সহ) নিয়ে ভোটার তালিকা করতে হবে। কিন্তু ২৪ বছরেও কারা স্থায়ী কারা অস্থায়ী নাগরিক, তা চিহ্নিত করেনি সরকার। ফলে নতুন ভোটার তালিকাও হয়নি। আর ভোটার তালিকা হয়নি বলে আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদের নির্বাচনও হতে পারছে না। তিন জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ চলছে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থায়। অর্থাৎ যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের স্থানীয় নেতারাই জেলা পরিষদ চালান। অথচ পুরোনো ভোটার তালিকা অনুযায়ী তিন পার্বত্য চট্টগ্রামের পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন নিয়মিতই হচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী হেডম্যান, কার্বারিদের সুপারিশক্রমে তিন সার্কেলপ্রধানের স্থায়ী, অস্থায়ী নাগরিক চিহ্নিত করার কথা। কিন্তু করছেন জেলা প্রশাসকেরা। এটিও চুক্তির লঙ্ঘন বলে মনে করে জনসংহতি সমিতি।
৩.
পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদেশি কূটনীতিক/নাগরিকদের ভ্রমণের বিষয়ে সরকার নানা রকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নির্দেশনাও দেওয়া হয়। সরকার মনে করে, সেখানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি, ফলে এ সতর্কতার প্রয়োজন অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূতের চট্টগ্রাম ও রাঙামাটি সফরকে সামনে রেখে গত ২১ অক্টোবর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সহকারী সচিবের সই করা যে চিঠি দুই জেলার জেলা প্রশাসক বরাবর পাঠানো হয়েছে, তাতে বেশ কিছু আপত্তিকর ও উসকানিমূলক কথাবার্তা আছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘ভারতের সীমান্তবর্তী রামগড় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সদস্যরা রাঙামাটি সদরের বিভিন্ন স্থানে অনুপ্রবেশ ও সশস্ত্র নাশকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছে বলে জানা যায়।’ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরদাতা জনসংহতি সমিতির কোনো সশস্ত্র সদস্য থাকার কথা নয়। থাকলে সরকারের উচিত তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া। কিন্তু তা না নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ ধরনের চিঠি পাঠানোর মাজেজা কি?
এ বিষয়ে জনসংহতি সমিতির এক শীর্ষস্থানীয় নেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, যাঁরা চুক্তি বাস্তবায়ন করছেন না এবং যাঁরা চুক্তির বিরোধিতা করছেন, তাঁরা পাহাড়ে অশান্ত পরিস্থিতি তৈরি করছেন। সরকার এমন কোনো দৃষ্টান্ত দেখাতে পারবে না, জনসংহতি সমিতি এই চুক্তি বাস্তবায়নের বিপক্ষে কাজ করছে বা তাদের কোনো সদস্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন। আসলে চুক্তি বাস্তবায়ন না করার জন্য তারা জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে এ ধরনের অসত্য ও ভিত্তিহীন অভিযোগ আনছে।
২৪ নভেম্বর এক বিবৃতিতে ২৭ বিশিষ্ট নাগরিক এক বিবৃতিতে পাহাড়ি জাতিসত্তার মানুষের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০’-এর কার্যকারিতা নিয়ে একটি মহল প্রশ্ন তোলার তৎপরতায় লিপ্ত। এই আইন পার্বত্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর প্রথাগত, ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকারসহ অন্য অধিকারগুলোর সুরক্ষা দিয়েছে। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে এসব অধিকার বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। তাই পার্বত্য শাসনবিধি ১৯০০-এর বিরোধিতার অর্থ পার্বত্য চুক্তিরই বিরোধিতা করা।
এ ছাড়া ওই চিঠিতে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে চাকমা সার্কেলের চিফ রাজা দেবাশীষ রায়ের বৈঠক প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, তিনি (রাজা দেবাশীষ রায়) জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। এ কারণে বৈঠকটি সার্কেল চিফের কার্যালয়ে না করে কোনো রেস্তোরাঁয় করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। রাজা দেবাশীষ রায় জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ফোরামে লবিং করেছেন, এ রকম তথ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোথায় পেল? আমরা যতটা জানি, জনসংহতি সমিতি ‘রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য রেখে’ সরকারের সঙ্গে যে চুক্তি সই করেছে, সে ব্যাপারে রাজা সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন।
৪.
২৪ নভেম্বর এক বিবৃতিতে ২৭ বিশিষ্ট নাগরিক এক বিবৃতিতে পাহাড়ি জাতিসত্তার মানুষের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০’-এর কার্যকারিতা নিয়ে একটি মহল প্রশ্ন তোলার তৎপরতায় লিপ্ত। এই আইন পার্বত্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর প্রথাগত, ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকারসহ অন্য অধিকারগুলোর সুরক্ষা দিয়েছে। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে এসব অধিকার বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। তাই পার্বত্য শাসনবিধি ১৯০০-এর বিরোধিতার অর্থ পার্বত্য চুক্তিরই বিরোধিতা করা।
১৯০০ সালের ৬ জানুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য এ শাসনবিধি জারি করে। পাহাড়ের মানুষদের স্বাতন্ত্র্য, তাঁদের ভূমির অধিকারের রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচিত এ আইন।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন সরকার ঐতিহাসিক চুক্তি সই করেছিল। এর মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৭৫ সাল-পরবর্তী সামরিক সরকার পরিচালিত ভ্রান্ত নীতির ফলে সৃষ্ট অশান্তির অবসান ঘটে। এর ফলে পার্বত্য অঞ্চলের অবহেলিত সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু এখন তা আমাদের আমলাতান্ত্রিক শাসনকাঠামোর একাংশের প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন অসহযোগিতার কারণে অনেকটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এ আইনে প্রদত্ত পার্বত্য অঞ্চলের সংখ্যালঘু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রথাগত, ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকারসহ অন্যান্য অধিকার সুরক্ষা দিয়েছে। আর ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তিতে এই প্রথাগত, ঐতিহ্যগত অধিকার বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। তাই পার্বত্য শাসনবিধি ১৯০০-এর বিরোধিতার অর্থ হচ্ছে প্রকারান্তরে পার্বত্য চুক্তিরই বিরোধিতা এবং তার বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করা। যে বাঙালি বিদেশি আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশ স্বাধীন করেছে, তারা কেন অন্য জনগোষ্ঠীর ওপর আধিপত্য বিস্তার করবে? সরকারের অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা যায় না আমলা তথা স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতা ও পক্ষপাতমূলক আচরণের জন্য। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে।’
৫.
শরদিন্দু শেখর চাকমা (এস এস চাকমা), সরকারি চাকরিতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে যিনি প্রথম অতিরিক্ত সচিব ছিলেন, পরবর্তীকালে ভুটানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতও হয়েছিলেন, প্রায়ই টেলিফোন করেন। তিনি ব্যক্তিগত বিষয় বা সমস্যা নিয়ে কথা বলেন না। সব সময় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কোনো সমস্যা, সেখানে সংঘটিত কোনো অন্যায় নিয়ে কথা বলেন। নবীন-প্রবীণনির্বিশেষে সর্ব শ্রেণির পাহাড়ি তাঁকে অত্যন্ত সম্মান করেন, বিপদে-আপদে তাঁর কাছে যান।
১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সইয়েও এই মানুষটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। জানা যায়, পরামর্শক কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি জনসংহতি নেতাদের রাজি করিয়েছেন, তাঁদের বুঝিয়েছেন, সশস্ত্র পন্থায় কোনো লাভ হবে না, আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। ৮৬ বছর বয়সী এস এস চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে একাধিক বইও লিখেছেন। এই মানুষটি সোমবার টেলিফোন করে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, পাহাড়িরা জমিজমা ও ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছেন। সুযোগ পেলেই বাঙালিরা তাঁদের ওপর চড়াও হচ্ছেন।এর প্রতিকার কী।
আমরা তাঁর প্রশ্নের জবাব দিতে পারিনি। চুক্তি সইকারী সরকারের নীতিনির্ধারকেরা কি দিতে পারবেন?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com