১৯৪৭ সালে যখন ভারত ভেঙে পাকিস্তান হয়, তখন এ অঞ্চলে (পূর্ববঙ্গ) ৩টি বিভাগ ও ১৭টি জেলা ছিল। তার মধ্যে একটি ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম। এখন এ নামে কোনো জেলা নেই। এটি ভাগ করে তিনটি জেলা হয়েছে—রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি। পুরো অঞ্চল বুঝতে এখনো পার্বত্য চট্টগ্রাম নামটি ব্যবহার করা হয়। এ নামে একটি আঞ্চলিক পরিষদ আছে। তবে সেটি আলংকারিক।
পার্বত্য চট্টগ্রামের নিসর্গ ও মানুষ বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকা থেকে আলাদা। এখানে অনেক জাতিগোষ্ঠী আছে। আগে তাদের একবর্গে ‘আদিবাসী’ বলা হতো। ২০০৯ সালের ৯ আগস্ট সংবাদপত্রে ছাপা হওয়া ক্রোড়পত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বাণীতে বলেছিলেন, ‘জাতিসংঘঘোষিত আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আমি বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব আদিবাসীকে শুভেচ্ছা জানাই।...জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ গৃহীত আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নেও আমরা একযোগে কাজ করতে চাই।’
‘আদিবাসী’ শব্দটি নিয়ে অনেকেরই অস্বস্তি ও আপত্তি আছে। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি হেঁটেছে একই পথে। ২০১০ সালের ১২ এপ্রিল জাতীয় সংসদে পাস হয় ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন’। সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, ‘আদিবাসীদের’ পরিচয় হবে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আমি বেশ কিছুদিন পড়াশোনা ও গবেষণা করেছি। এ নিয়ে সম্প্রতি প্রথমা প্রকাশন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম: শান্তিবাহিনী জিয়া হত্যা মনজুর খুন নামে বই প্রকাশিত হয়েছে। এটি করতে গিয়ে মনে হয়েছে, একই দেশে বাস করে আমরা তাদের সম্বন্ধে কত কম জানি। লালন সাঁইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর/ সেথা পড়শি বসত করে/ একঘর পড়শি বসত করে/ আমি এক দিনও না দেখিলাম তারে।’
আমার জানামতে, বাঙালিসহ ১৪টি জাতিগোষ্ঠীর বাস এ অঞ্চলে। ছোট একটি এলাকা, আয়তনে বাংলাদেশের দশ ভাগের এক ভাগ। কিন্তু এমন বৈচিত্র্যময় অঞ্চল পৃথিবীতে খুব কমই আছে, যেখানে এতগুলো জাতিগোষ্ঠী জড়াজড়ি করে একসঙ্গে আছে অনেক বছর ধরে। অঞ্চলটি নিঃসন্দেহে দেশের একটি মূল্যবান ঐতিহ্যগত সম্পদ। শান্তিপূর্ণ এ অঞ্চল একসময় অশান্ত হয়ে উঠল। রক্ত ঝরল অনেক। অবশেষে শান্তির সন্ধানে একটি চুক্তি হলো। কিন্তু শান্তি কি ফিরে এসেছে?
গত দেড় শ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনবিন্যাস একেবারেই পাল্টে গেছে। এই জেলার প্রথম ডেপুটি কমিশনের টি এইচ লুইনের লেখা বই থেকে আমরা জানতে পারি, এখানকার অধিবাসীদের মোটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়—পাহাড়ের সন্তান বা ‘টংথা’, যেমন কুকি, খুমি, ম্রো, লুসাই, খিয়াং, বনেযাগী ও পাংখো এবং নদীর সন্তান বা খ্যাংথা, যেমন চাকমা, মারমা, টিপরা (ত্রিপুরা), তঞ্চঙ্গ্যা, রিয়াং ইত্যাদি। সমতলের বাঙালিদের চোখে এরা সবাই হলো ‘পাহাড়ি’। সব কটি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীকে স্থানীয় রাজনীতিতে একবর্গে বলা হয় ‘জুম্মজাতি’। পাহাড়ের ওপরে ও ঢালে ‘জুম’ নামের বিশেষ পদ্ধতির চাষাবাদের কারণে এই নাম। ব্রিটিশ ভারতে ১৮৭২ সালের হিসাব অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যা ছিল ৬৩ হাজার ৫৪ জন। তাদের মধ্যে বাঙালি ছিল ১ হাজার ৯৭ জন (২%)। ১৯৯১ সালে মোট জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৯ লাখ ৭৪ হাজার ৪৪৫ জন। তাদের মধ্যে বাঙালি ৪ লাখ ৭৩ হাজার ৩০১ জন (৪৯%)। গত ৩০ বছরে এই বিন্যাস নিশ্চয়ই অনেক বদলে গেছে।
আমি প্রথম রাঙামাটি যাই ১৯৭০ সালের নভেম্বরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একটি দলের সদস্য হিসেবে ‘শিক্ষাসফরে’। শেষ গিয়েছি এ বছর ২৫ মার্চ প্রথম আলো আয়োজিত এক সুধী সমাবেশে যোগ দিতে। শহরটি যে কত বদলে গেছে, তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না। তখন চট্টগ্রাম থেকে তৎকালীন ইপিআরটিসির মিনিবাসে চড়ে কোথাও না থেমে সরাসরি চলে গেছি। এবার যাত্রাপথে দুবার থামতে হলো। পথে সেনাবাহিনীর একটি এবং বিজিবির একটি চেকপোস্ট। তাদের জিজ্ঞাসা—কোথা থেকে আসছেন, কোথায় যাবেন, কেন যাবেন, কী করেন ইত্যাদি। মনে মনে পরাধীন পাকিস্তান আমল আর স্বাধীন বাংলাদেশের পরিস্থিতির তুলনা করলাম।
যুদ্ধে আসলে কেউ জেতে না। যুদ্ধ মানেই হত্যা, লুণ্ঠন, জনপদ পুড়ে যাওয়া আর উদ্বাস্তুকরণ। যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। তারপরও যুদ্ধ হয়। পিঁপড়ের মতো মানুষ মরে। যে জুম্ম যুবক ঘর ছেড়ে অস্ত্র হাতে গভীর অরণ্যে চলে গিয়েছিলেন কিংবা যে তরুণ লেফটেন্যান্ট দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি, তাঁদের জন্য এখনো কি পথ চেয়ে বসে আছে কেউ?
পার্বত্যবাসীর কিছু দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে সেখানে ১৯৭২ সালে তৈরি হয়েছিল ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’। সংবিধানে তারা এই অঞ্চলের জন্য বিশেষ অঞ্চলের স্বীকৃতি ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য সাংবিধানিক নিশ্চয়তা চেয়েছিল। সেই দাবি মানা হয়নি। সেই ক্ষোভ থেকে তৈরি হয়েছিল জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সংগঠন ‘শান্তিবাহিনী’। একটা সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে, বিশেষ করে খাগড়াছড়ি জেলায় শান্তিবাহিনীর প্রভাব ও প্রতিপত্তি ছিল ব্যাপক। প্রথমে রাঙামাটি ও পরে খাগড়াছড়ির ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক (পরে মেজর জেনারেল হয়ে অবসরপ্রাপ্ত) এক সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেছেন, ‘খাগড়াছড়িতে দুই প্রকারের প্রশাসন চালু ছিল। দিনের আলোয় বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন ছিল প্রথমত গতানুগতিক, যতটুকু না করলেই নয় ততটুকু। অন্যদিকে শান্তিবাহিনীর প্রশাসন ছিল সর্বগ্রাসী, সর্বব্যাপী—জন্মের ঘটনা থেকে মৃত্যুর ঘটনা পর্যন্ত পাহাড়িদের সর্বপ্রকারের জীবনযাত্রার পন্থী ও ঘটনা নিয়ন্ত্রণকারী, ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায় বিস্তৃত।’
শান্তিবাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনী, বিডিআর ও পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। অলিখিত যুদ্ধ চলেছে অনেক বছর। হতাহত হয়েছেন উভয় পক্ষে অনেকেই। মাঝখানে অসামরিক পাহাড়ি বাঙালি মারা গেছেন অগুনতি। অনেককে বেছে নিতে হয়েছে উদ্বাস্তু জীবন। শান্তিবাহিনীর হাতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর অনেক সদস্য প্রাণ দিয়েছেন। আবার তাঁদের হাতে শান্তিবাহিনীর অনেক সদস্যও জীবন হারিয়েছেন। অবশেষে একটি চুক্তি হয়েছে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর। যুদ্ধে শুধু প্রাণহানি নয়, অচল ছিল জীবনযাত্রা, অর্থনীতির চাকা। স্বাভাবিক অবস্থা যে এত বছরেও ফিরে আসেনি, তার প্রমাণ হলো জায়গায় জায়গায় চেকপোস্ট। এত চেকপোস্টের ঝামেলা থাকলে সেখানে পর্যটকেরা যেতে আগ্রহী হবেন কীভাবে। কত তরুণ শান্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে আর ঘরে ফিরে আসেননি, সেনাবাহিনীর কত তরুণ সদস্য পাহাড়ে অ্যামবুশে পড়ে মারা গেছেন! তাঁদের পরিবার কী পেল?
যুদ্ধে আসলে কেউ জেতে না। যুদ্ধ মানেই হত্যা, লুণ্ঠন, জনপদ পুড়ে যাওয়া আর উদ্বাস্তুকরণ। যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। তারপরও যুদ্ধ হয়। পিঁপড়ের মতো মানুষ মরে। যে জুম্ম যুবক ঘর ছেড়ে অস্ত্র হাতে গভীর অরণ্যে চলে গিয়েছিলেন কিংবা যে তরুণ লেফটেন্যান্ট দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি, তাঁদের জন্য এখনো কি পথ চেয়ে বসে আছে কেউ?
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নিয়ে দেশে ঐকমত্য ছিল না। বড় একটি দল চুক্তির বিরোধিতা করেছিল। বলেছিল, ফেনী থেকে শুরু করে দেশের পূর্বাঞ্চলের বাকি অংশ বাংলাদেশ থেকে আলাদা হয়ে যাবে। জনমনস্তত্ত্ব বড্ড ভয়ংকর জিনিস। মন থেকে সমঝোতা ও সন্ধির চেষ্টা না থাকলে কাগজে লেখা চুক্তি কোনো কাজে আসে না। দলের মধ্যে অনেক বিরোধিতা সত্ত্বেও জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও ‘শান্তিবাহিনীর’ কমান্ডার জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে খুব আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু পরে তাঁর আশাভঙ্গ হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের দুই বছর না পেরোতেই ১৯৯৯ সালের ৩০ অক্টোবর খাগড়াছড়িতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ষষ্ঠ ও প্রথম প্রকাশ্য জাতীয় সম্মেলনে সন্তু লারমা অভিযোগ করেন, চুক্তি সই করা ছিল বিরাট ‘ভুল’। সরকার ‘সৎ উদ্দেশ্যে নয়, বরং জুম্ম জনগণের সঙ্গে “বেইমানি” করার জন্য চুক্তি সই করেছে। সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ করছে।’
পাহাড়ে এখন অনেক সশস্ত্র গ্রুপ। তারা প্রায়ই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। রাজনীতি নয়, চাঁদাবাজি নিয়েই বেশির ভাগ সংঘর্ষ। আর বেশ কিছু সংঘর্ষ হয় নানান মতলব থেকে। সারা দেশ যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করছে, পাহাড় তখনো রয়ে গেছে অশান্ত।
উন্নয়নের পারদ উঁচুতে উঠছে। চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক চার লেনে উন্নীত হচ্ছে। পথের পাশে সারি সারি বুলডোজার, ক্যাটারপিলার, নীল পাহাড় আর সবুজ বনে ঘেরা উপত্যকাগুলো ইটভাটায় সয়লাব। চিমনি দিয়ে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে অনর্গল। বন আর নেই। তার জায়গা করে নিয়েছে প্ল্যান্টেশন—মনোকালচার। সেখানে পাখি বসে না। বিভিন্ন সময় দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও কিছু এনজিও হাজার হাজার একর জমি লিজ নিয়ে পাহাড়গুলোকে নষ্ট করেছে। কিন্তু কিছুই বলার নেই, করার নেই।
● মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
mohi2005@gmail.com