শিক্ষা

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারের ঔদাসীন্য

এ নিয়ে কোনোই বিতর্ক নেই যে বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বেশি অবদান রাখতে পারে শিক্ষা। কিন্তু এ পর্যন্ত রাষ্ট্রের নীতি, শিক্ষার প্রতি বিভিন্ন সরকারের মনোভাব, শিক্ষায় আর্থিক বরাদ্দের বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে আমরা হতাশাব্যঞ্জক চিত্রই পাই। বিনা মূল্যে পুস্তক বিতরণ, প্রাথমিক শিক্ষায় নারীদের অগ্রগতিসহ নানা বিষয়ে বর্তমান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকলেও সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যে শিক্ষার গুরুত্বের বিষয়টি ভালো বোঝেন, তা মনে হয়নি। রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা পুলিশ, র্যাব, সামরিক বাহিনী, প্রশাসনের আমলারাই বেশি ভোগ করেছেন। সাধারণ মানুষ, এমনকি রাষ্ট্রের ২৬টি ক্যাডারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ন্যায্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত। সবচেয়ে নাজুক অবস্থা শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষকদের। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হচ্ছে জিডিপির ২ দশমিক ৬ শতাংশ, যা কিনা ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বরাদ্দের চেয়ে কম। ২০১৫ সালে শ্রীলঙ্কার অন্তর্বর্তীকালীন বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ওই দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। ভারত তার ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে উচ্চশিক্ষা খাতে আগের বছরের তুলনায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছে ১৩ শতাংশ।

দুই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা প্রদান করে আসছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে মানসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট তৈরি করেছে, তাঁদের অনেকেই এখন আমলা, রাজনীতিক, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী বা অন্য কোনো পেশায় কর্মরত। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয়বান্ধব নীতি গ্রহণ না করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দিচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের করা হয়েছে অপমান। রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকেরা বুঝতে পারছেন না যে শিক্ষকদের অসম্মানিত করে কোনো জাতি বড় হতে পারে না।
মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে যে অষ্টম পে কমিশন গঠন করা হয়, সেই পে কমিশন তাদের রিপোর্টে বলেছে, যত দিন পর্যন্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হবে, তত দিন পর্যন্ত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আলাদা পে-স্কেলের বিষয়টি আমলযোগ্য নয়। অর্থাৎ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গণমুখী চরিত্র ও সরকারের ভর্তুকি তাঁদের পছন্দ নয়। লাখ লাখ দরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী ছেলেমেয়েরা যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন, তা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নামমাত্র বেতন, আবাসিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার কারণে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে স্বল্প আর্থিক ক্ষমতাসম্পন্ন পরিবারের মেধাবী সন্তানেরা যেমন বঞ্চিত হবেন, তেমনি বাংলাদেশে এখনো মানসম্পন্ন শিক্ষার যতখানি অবশিষ্ট আছে, তার কিছুই থাকবে না।
সম্প্রতি প্রকাশিত ২০১৪ সালের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রতিবেদনে বলা আছে, ‘সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে তাদের নিজস্ব আয় থেকে লাভজনক নিরাপদ খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া খুবই জরুরি।’ মঞ্জুরি কমিশন তার প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয়ের ৫০ শতাংশ আসতে হবে এর অভ্যন্তরীণ খাত থেকে। অষ্টম পে কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আর্থিকভাবে পরিপূর্ণ স্বাবলম্বী হতে হবে, এদিকে মঞ্জুরি কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয়ের ৫০ শতাংশ আসতে হবে এর অভ্যন্তরীণ খাত থেকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোত্থেকে টাকা জোগাড় করবে? ছাত্রছাত্রীদের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাবলম্বী হবে, নাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যাংক, কল্যাণ সংস্থা (যেমন সেনা কল্যাণ সংস্থা), শপিং মল, মেডিকেল কলেজ স্থাপন করে করপোরেট ব্যবসায় নেমে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হবে? এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ববিদ্যালয় চরিত্র কি ক্ষুণ্ন হবে না? বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি অব্যাহত রাখতে পারবে তার গণবান্ধব, গণতান্ত্রিক এবং শিক্ষা ও গবেষণা-সংশ্লিষ্ট ভূমিকা?

>যে বিশ্ববিদ্যালয় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলে খ্যাত ছিল, সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি আজ এশিয়ার প্রথম ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় বা বিশ্বের প্রথম ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই কেন, সেই প্রশ্নটি করা কি অন্যায্য হবে? এ ব্যর্থতার দায় কি রাষ্ট্রের, না বিশ্ববিদ্যালয়ের, নাকি এটি আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা?

তিন
রাষ্ট্রীয় কর্তাব্যক্তিরা ইদানীং শিক্ষার প্রসঙ্গ এলে কিছু জ্ঞানগর্ভ ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেন, যেমন ‘জ্ঞানভিত্তিক সমাজ’, ‘একবিংশ শতকের উপযোগী শিক্ষা’, ‘উন্নয়ন সহায়ক মানবসম্পদ’ ইত্যাদি। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এগুলো প্রতিষ্ঠা বা বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রের কোনো আগ্রহ বা উদ্যোগ দৃশ্যমান হয় না। জাতীয় বাজেটে উচ্চশিক্ষায় শূন্য দশমিক ৬৫ শতাংশ বরাদ্দ দেখে আমরা বড়সড় একটি ধাক্কা খাই। এ বরাদ্দ দিয়ে ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যূনতম ব্যয়ই মেটানো কষ্টসাধ্য, গবেষণা হবে কীভাবে, একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী শিক্ষা হবে কীভাবে, আর কীভাবে উন্নয়ন-সহায়ক মানবসম্পদ তৈরি হবে, তা আমার বোধগম্য নয়।
মঞ্জুরি কমিশন তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ২০১৩-১৪ সালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ১৫৪২ দশমিক ৫০ কোটি টাকা (বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বাজেট যখন প্রায় তিন লাখ হাজার কোটি টাকা, তখন উচ্চশিক্ষার জন্য বরাদ্দ মাত্র দেড় হাজার কোটি টাকা)। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব খাত থেকে সংগ্রহ করেছে ২৮২ দশমিক ৮০ কোটি টাকা। এ অর্থের ৭২ শতাংশই ব্যয় হয়েছে বেতন-ভাতা ও পেনশন প্রদানের জন্য, ১৬ শতাংশ গেছে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। বাকি অর্থ ব্যয় হয়েছে শিক্ষাসংক্রান্ত খাতে। আর গবেষণারজন্য যা বরাদ্দ ছিল, তা নামমাত্র। বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, কলা ও পরিবেশবিজ্ঞানের মানসম্পন্ন গবেষণার জন্য যে আর্থিক বরাদ্দ দরকার, তা না থাকায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মুখ থুবড়ে পড়েছে। অথচ নানা সীমাবদ্ধতা ও ঘাটতির মধ্যেও অনেক শিক্ষক ও গবেষক যে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা করছেন, তা পুরোপুরি ব্যক্তি উদ্যোগে। গবেষণায় বরাদ্দ বা মৌলিক গবেষণাকে উৎসাহিত করার ব্যাপারে রাষ্ট্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে সীমাহীন গাফিলতি ও বিরূপ মনোভাব।

চার
আগেই উল্লেখ করেছি যে এ ভূখণ্ডের শিক্ষা ও গবেষণার বিকাশে এবং মানসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট তৈরিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রয়েছে এক অনন্য অবদান। প্রাসঙ্গিকভাবে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা উল্লেখ করতে চাই। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পর কয়েক দশকের মধ্যে শিক্ষা ও গবেষণার উঁচু মান ও আবাসিক চরিত্রের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল থেকে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, যিনি সত্যেন বোস নামে পরিচিত, একটি প্রবন্ধ পাঠান। তাঁর ওই প্রবন্ধ পড়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘আমার মতে বসু কর্তৃক প্ল্যাংক-সূত্র নির্ধারণের এই পদ্ধতিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।’
বিশ্বখ্যাত আরেক বিজ্ঞানী আব্দুস সালাম ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সম্মেলন উদ্বোধন করতে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। ঢাকায় একসময়ে গড়ে উঠেছিল এক শক্তিশালী গবেষক দল, যারা মৌলিক পদার্থের প্রকৃতি সম্বন্ধে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিল। এসব গবেষণায় অংশগ্রহণ করেছিলেন কে এস কৃষ্ণান, এস আর খাস্তগীর, কাজী মোতাহার হোসেন ও আরও অনেকে। বিখ্যাত রোনাল্ড ফিশার ঢাকার বিমানবন্দরে নেমেই কাজী মোতাহার হোসেনের খোঁজ করতেন। এটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার শিক্ষকদের প্রকৃত পরিচয়, সত্যিকারের ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের জন্যই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জগন্নাথ হলে বসে লিখতে পেরেছিলেন: ‘এই কথাটি মনে রেখো, তোমাদের এই হাসি খেলায়...’ (অধ্যাপক এ এম হারুন-অর-রশীদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব স্যুভেনির, ২০১২।) যে বিশ্ববিদ্যালয় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলে খ্যাত ছিল, সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি আজ এশিয়ার প্রথম ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় বা বিশ্বের প্রথম ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই কেন, সেই প্রশ্নটি করা কি অন্যায্য হবে? এ ব্যর্থতার দায় কি রাষ্ট্রের, না বিশ্ববিদ্যালয়ের, নাকি এটি আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা?
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশের শিক্ষা কিসের ওপর দাঁড়াবে, কীভাবে মজবুত হবে টেকসই উন্নয়ন?
শেখ হাফিজুর রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক, অপরাধ বিশ্লেষক ও মানবাধিকার গবেষক।