দুনিয়াজুড়ে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বে পরিবেশদূষণের ভয়াবহতা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটি খুব ভালো একটি দিক। বাতাসের মানের সূচকের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বিশেষ করে ভারতে বাতাসের দূষণের যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে জনস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু বিশুদ্ধ বাতাসের মতো বিশুদ্ধ পানির অভাব তীব্র গতিতে বেড়ে চললেও তা খুব বেশি আলোচনায় আসছে না। হতে পারে আমরা জল থই থই একটি ‘নীল গ্রহের’ বাসিন্দা। কিন্তু এই আদিগন্ত সুবিশাল জলরাশির ৩ শতাংশের কম পানি স্বাদু বা পানযোগ্য। যতটুকু পানি পানযোগ্য তার অনেকখানিই আবার আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে (যেমন এই পানির একটি বড় অংশ হিমবাহবেষ্টিত হয়ে আটকা পড়ে আছে)।
১৯৬০ সাল থেকে এ পর্যন্ত মানুষের নাগালে থাকা স্বাদু পানির সহজলভ্যতার পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে বিশ্ববাসী সুপেয় পানির ঘাটতির চাপে পড়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই পানির চাহিদা সরবরাহের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেড়ে যাবে। প্রায় দুই–তৃতীয়াংশ সুপেয় পানির উৎস এমন সব নদী ও হ্রদ, যেগুলো বিভিন্ন দেশের জাতীয় সীমান্ত অতিক্রম করেছে। একাধিক দেশের সীমানা অতিক্রম করা এসব নদ-নদীর পানির হিস্যা নিয়ে আন্তর্দেশীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ক্ষোভ বাড়ছে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে শত শত আন্তর্জাতিক পানি চুক্তি টিকবে কি টিকবে না, সেই অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
এশিয়ার দীর্ঘতম নদ ব্রহ্মপুত্রের সীমানা ও পানির হিস্যা নিয়ে চীন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে মতপার্থক্য ও মন–কষাকষি আছে। চীন ও ভারত সক্রিয়ভাবে এই নদের ওপর বাঁধ নির্মাণ করছে, যা নদীর গতিপথকেই বদলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী হামলার জবাব দিতে ভারত নদীর গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়ার কাজ করেছে। ইথিওপিয়া নীল নদে বাঁধ দিয়ে মিসরের ক্রোধ বাড়িয়ে দিয়েছে।
পানি নিয়ে আন্তসীমান্ত সংঘাত সবে শুরু হয়েছে। পানির হিস্যা নিয়ে এখন শুধু দেশে দেশে বিরোধ বাধছে না, এই বিরোধ এখন দেশের ভেতরের রাজ্য বনাম রাজ্য, গ্রামাঞ্চল বনাম শহরাঞ্চল, কৃষি বনাম শিল্প খাত, এমনকি বাসাবাড়ির ভোক্তাদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। গত বছর পানির অভাবের কারণে পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে কেনিয়ায় বিভিন্ন আদিবাসী গোত্রের মধ্যে সংঘাত–সংঘর্ষ হয়েছে।
আসলে নীল নদ, আমাজন, মেকং এবং দানিউবের মতো বড় বড় উৎসের পানির হিস্যা নিয়ে সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। কিন্তু বর্তমানে সেই সংঘাত নতুন মাত্রা পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। সমতলের জলাধারগুলো শিল্পকারখানার দূষণ, প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য এবং মনুষ্য বর্জ্যের কারণে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। মধ্য আয়ের দেশগুলোতে এক-তৃতীয়াংশের কম পানি ব্যবহারের উপযোগী আছে। কম আয়ের দেশে তার পরিমাণ আরও কম। ১৮০ কোটির বেশি লোক বিষাক্ত জলাধারের পানি খাওয়া ও অন্যান্য গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করার খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখতে না পারায় এই সমস্যায় পড়ছে মানুষ।
পানির এই অপ্রতুলতা কমবেশি সবাইকে ভোগাচ্ছে। তবে সবচেয়ে চাপে পড়ছে কৃষি খাত। বিশ্বে যে পরিমাণ পানি ব্যবহৃত হয়, তার ৭০ শতাংশই কৃষি খাতে লাগে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কৃষি খাতের ৯০ শতাংশই এখন পানিসংকটের মুখে আছে। বিশ্বের শহরাঞ্চলগুলোও এখন পানিসংকটজনিত বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে। গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে এমন পানিসংকট দেখা দিয়েছিল যে সিটি করপোরেশন নির্দিষ্ট একটি দিনকে ‘ডে জিরো’ (ওই দিনে গোটা কেপটাউনে পানি সরবরাহ বন্ধ থাকবে) হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তুতি নিয়েছিল। ভাগ্যিস কেপটাউনবাসীকে এখনো সেই দিবস পালনের মুখে পড়তে হয়নি। একইভাবে মেক্সিকো সিটিও দীর্ঘদিন ধরে পানিসংকট মোকাবিলা করে যাচ্ছে।
সবচেয়ে বড় অসুবিধার মুখে পড়ছে ভারতের বড় বড় শহর। ২০১৮ সালের একটি সরকারি প্রতিবেদনে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে, আগামী বছর (২০২০) নাগাদ দিল্লি, বেঙ্গালুরুসহ ২১টি বড় শহরের ভূগর্ভস্থ পানি জিরো লেভেলে চলে আসবে এবং এতে কমপক্ষে ১০ কোটি মানুষ পানির অভাবে পড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পানিসংকটে সবচেয়ে যে দেশগুলো ভুগতে যাচ্ছে, তারা হলো আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার দেশ। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনে এই এলাকার দেশগুলোই সবচেয়ে কম দায়ী।
ভারতের মহারাষ্ট্রে নারী ও কম বয়সী মেয়েদের প্রতিদিন খাবার পানি সংগ্রহ করতে ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত হাঁটতে হয়। এমন অনেক গ্রাম আছে, যেখানকার কূপ শুকিয়ে গেছে বলে প্রতিটি পরিবারে একজন লোক খাওয়ার পানি সংগ্রহের জন্য নির্ধারিত থাকে। ধনী পরিবারগুলো টাকাপয়সা খরচ করে লোকজন দিয়ে এই পানি সংগ্রহ করে। কিন্তু বেশির ভাগ লোকের পক্ষে তা সম্ভব হয় না।
যেসব উন্নত অর্থনীতির দেশের কারণে এই বিপত্তি বেধেছে, তারা এখন পর্যন্ত পানিসংকটে পড়েনি। আর পড়েনি বলেই হয়তো তারা এখনো পানিসংকটের মূল কারণ পরিবেশদূষণ সমানতালে করে যাচ্ছে। সাধারণভাবে ধান চাষে বেশি পরিমাণ পানির দরকার হয় বলে মনে করা হয়। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, এক কেজি ধান উৎপাদনে যে পানি খরচ করতে হয়, এক কেজি গরুর মাংস উৎপাদনে তার পাঁচ গুণ বেশি পানি খরচ হয়। এক কেজি আলু উৎপাদনে যে পানি খরচ হয়, এক কেজি গরুর মাংস উৎপাদনে তার চেয়ে এক শ গুণ বেশি পানি লাগে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মোট রপ্তানির একটি বড় অংশ যেহেতু কৃষিপণ্য, সেহেতু ধরে নেওয়া যায় এসব পণ্য রপ্তানির মধ্য দিয়ে দেশগুলো প্রকারান্তরে তাদের সীমিত পানিই রপ্তানি করছে।
বর্তমানে আফ্রিকার যেসব ভূমি নেওয়ার জন্য বহুজাতিক কোম্পানি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে, সেসব ভূমি মূলত পানির কাছাকাছি থাকা ভূমি। বড় নদী, বড় হ্রদ, আর্দ্র জমি—এসবই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু।
২০১৫ সালে জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজির ঘোষণায় ‘সবার জন্য সুপেয় পানি এবং পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা’ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছিল। সেই অঙ্গীকারের পর পরিস্থিতি উন্নত হওয়ার বদলে আরও অবনতির দিকে গেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ বিষয়ে এখনো তৎপর হচ্ছে না। এতে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উন্নত বিশ্বও এর ছোবল থেকে রেহাই পাবে না। পানি নিয়ে ইতিমধ্যেই আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক জায়গায় কোন্দল শুরু হয়েছে। এই কোন্দল পৃথিবীর বাকি অংশেও ছড়াবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
জ্যোতি ঘোষ দিল্লির জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক