মাত্র দুমাস আগেও কর্তাব্যক্তিদের মুখে আশার বাণী শোনা গিয়েছিল—পাতালরেল হচ্ছে। মোট ১১টি রুটসম্পন্ন ২৫৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই পাতালপথ। ২০৩০ সালের মধ্যে প্রথম ধাপে চারটি রুট সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু মাত্র দুই দিন আগে ‘এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে’। অধিকাংশ প্রকৌশলী ও পরিকল্পক হঠাৎ করে এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। বেশ কিছু ভীতিকর সংখ্যাও তাঁরা ছুড়ে দিয়েছেন তাঁদের নববোধোদয় যৌক্তিক বানানোর চেষ্টায়। অর্থনীতির ভাষায় তাঁরা আপেল ও কমলা যোগ করে সেখান থেকে কাঁঠালের ওজন বাদ দিয়েছেন। তাঁদের আকস্মিক নৈরাশ্যবাদ হিসাববিদ্যা-উদ্ভূত হতে পারে। কিন্তু পরিকল্পনাবিদ্যার বিচারে তা অদূরদর্শী। কল্যাণ অর্থনীতি এখান থেকে বিতাড়িত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি কিলোমিটারে নির্মাণব্যয় হবে ২ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা। মোট খরচ ৬৫ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। লাভ আসবে ২০৫৭ সালে। প্রতি মাসে পাতালরেলের যাত্রীদের ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হবে। তাই পাতালরেলের চিন্তা বাদ দিয়ে ঢাকার যানজট সমাধানের জন্য ফুটপাত উদ্ধার ও উন্নত বাস সার্ভিসের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। মনে হলো, এ-জাতীয় পরামর্শ একেবারে প্রথম শুনলাম। এ যেন অ্যাপেন্ডিসাইটিস রোগীর অপারেশনে খরচ বেশি হবে বলে তাঁকে বেদনার মলম ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া। পাতালরেল নির্মাণসংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটি সভা শেষকালে যানজট নিরসন কমিটির সভার আদলে শেষ হয়ে গেল।
বিশেষজ্ঞদের যে জায়গায় সবচেয়ে বড় ঘাটতি, সেটা হচ্ছে তাঁরা পৃথিবীর তাবৎ নগরের পাতালরেলের ইতিহাস পড়েননি। পৃথিবীর কোন্নগরের পাতালরেলের নির্মাণ রাতারাতি লাভের হিসাবে শুরু হয়েছে? কোথাও না। এ প্রকল্প বরাবরই যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বারা একটা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসাবে শুরু হয়। বেশি দূর যেতে হবে না। ভারতের অন্তর্ভুক্ত একটা রাজ্যের রাজধানী কলকাতা। সেখানে আমাদের মতোই রক্ত-মাংসের সাত লাখ বাঙালি দৈনিক পাতালরেলে চড়েন। ভারতের স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় কলকাতার জন্য পাতালরেলের প্রথম কার্যকর উদ্যোগ নেন। তখন যানজটও সেখানে তেমন ছিল না।
পাতালরেল শুধু ঢাকার যানজট নিরসনের দাওয়াই নয়; এটি একটি টেকসই রাজধানীর রক্ত সঞ্চালনের প্রক্রিয়া—একটি আধুনিক বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ব্যবহারযোগ্য অবকাঠামো। উন্নত অর্থনীতির পথপ্রস্তর। এটি পাত্রপাত্রী পছন্দের মতো অজস্র বিকল্পের ব্যাপার নয়। এটি অকল্পনীয়—এক অনিবার্য প্রকল্প। শুধু রাজধানী ঢাকা বাঁচানোর জন্যই নয়, দেশের উন্নয়নের জন্যও বটে। ঢাকা বাঁচলে দেশ বাঁচবে। ঢাকা মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৪০ ভাগ জুগিয়ে থাকে। এভাবে চললে আগামী ১০ বছরে যানবাহনের চাপে ঢাকা হবে এক সর্বোচ্চ শব্দদূষিত-বায়ুদূষিত আর্তনাদকারী পৃথিবীর বৃহত্তম পার্কিং লট। বাসিন্দার সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পৃথিবীর দ্রুততম হার অর্জনকারী এই মহানগরীতে ‘পাতালরেল হবে কি না’, এ-জাতীয় দোদুল্যমানতা পরিকল্পকের পাণ্ডিত্য দেখাতে পারে। কিন্তু তাদের লাভক্ষতির বিশ্লেষণ গলদপূর্ণ-অসংগত এবং রাষ্ট্রস্বার্থের বিবেচনা প্রশ্নসাপেক্ষ।
বিশেষজ্ঞরা তাঁদের প্রকৌশলবিদ্যা ও হিসাবশাস্ত্রের দক্ষতা দেখিয়েছেন। কিন্তু সেখানে কল্যাণ অর্থনীতির বিবেচনা রাখা হয়নি। সরকার যখন একটা উদ্যান বা ক্যানসার হাসপাতাল বানায়, তখন এটি ‘পাবলিক গুড’ বলে এখানে লাভ-লোকসানের বণিকি অঙ্ক দেখা হয় না। পাতালরেলকে সেই দৃষ্টি থেকে না দেখলে ভুল হবে। রেলে আমরা প্রচুর লোকসান দিয়েছি। রেল বন্ধ হয়নি। যদিও এই লোকসানের সিংহভাগ দুর্নীতিজাত। বিদ্যুৎ ও শক্তি খাতেও একই চিত্র। গণচাহিদার ব্যাপকতা দিয়ে এগুলো যাচাই করা হয়। পাতালরেলের মতো স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব আরেকটা বড় প্রকল্প খুঁজে পাওয়া কঠিন। ১৪ বিলিয়ন ডলারের রূপপুর প্রকল্প পরিবেশ, এমনকি অস্তিত্বের জন্যও একটা হুমকি হয়ে রয়েছে। রাশিয়ার গোঁয়ার্তুমি দেখে মনে হচ্ছে পারমাণবিক বর্জ্য শেষতক বাঙালিকেই হজম করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের যে জায়গায় সবচেয়ে বড় ঘাটতি, সেটা হচ্ছে তাঁরা পৃথিবীর তাবৎ নগরের পাতালরেলের ইতিহাস পড়েননি। পৃথিবীর কোন্নগরের পাতালরেলের নির্মাণ রাতারাতি লাভের হিসাবে শুরু হয়েছে? কোথাও না। এ প্রকল্প বরাবরই যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বারা একটা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসাবে শুরু হয়। বেশি দূর যেতে হবে না। ভারতের অন্তর্ভুক্ত একটা রাজ্যের রাজধানী কলকাতা। সেখানে আমাদের মতোই রক্ত-মাংসের সাত লাখ বাঙালি দৈনিক পাতালরেলে চড়েন। ভারতের স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় কলকাতার জন্য পাতালরেলের প্রথম কার্যকর উদ্যোগ নেন। তখন যানজটও সেখানে তেমন ছিল না। ভালোই চলছিল ট্রামে চড়া কেরানিদের আটপৌরে জীবন। পাতালরেলের প্রয়োজনই তেমন কেউ ভাবতে পারেননি। বাধা দেওয়ার লোকও ছিল প্রচুর। কিন্তু স্বাপ্নিক নেতারা কখনো এগুলোর তোয়াক্কা করেন না।
ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায় তাঁর সময় থেকে আরও ৫০ বছর পরের একটি আধুনিক বিশ্বমানের শহর—কলকাতাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর স্বপ্ন সার্থক হয়েছে। বাহাত্তর থেকে শুরু হয়ে একানব্বই পর্যন্ত প্রথম ধাপের কাজ শেষ হলো। এখন পর্যন্তও এর বিস্তৃতি চলছেই। আর এদিকে অতি স্বল্প দূরের বিশেষজ্ঞরা ঢাকায় তা হবে কি না, কিংবা না হলেই ভালো হয়, এ-জাতীয় ভীত অবসাদবাণী ছড়াচ্ছেন। এরই মধ্যে দিল্লি অল্প সময়ে পৃথিবীর দশম বৃহত্তম পাতালরেল বানিয়ে ফেলেছে, আরও বাড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। গড়ে উঠেছে বেঙ্গালুরু, চেন্নাই ও হায়দরাবাদের পাতালপুরী। এই তো সেদিনের কথা। এরা সবাই পাতালপুরী বিনির্মাণের কাজের কলকাতার অনুজ। ‘ভারতের চেয়ে আমরা মাথাপিছু আয়ে ওপরে চলে যাচ্ছি বা গিয়েছি’—এহেন আত্মতুষ্টির বাণী ছাড়ার আগে এ উদাহরণগুলো দেখা উচিত। তা না হলে গ্রাম্য মোড়লের মতো টাকা নিয়ে বসে থাকতে হবে। জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে না। দেশের ধনিকগোষ্ঠী বাইরে বসতির ব্যবস্থা করবে। মুদ্রা পাচার করবে। এসব কাজ ইতিমধ্যেই জোরেশোরে শুরু হয়েছে।
একজন সভাসভ্য পাতালরেল নির্মিত হলে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার যে মাসিক ভাড়ার ভয় দেখালেন—কল্পনানির্ভর এ ভয়ানক সংখ্যা তিনি কী করে পেলেন, তা বোঝা গেল না। ভাড়া নির্ধারণের সঠিক অঙ্ক প্রকল্প শেষ হওয়ার আগে করা হয়। ভাড়ার ও রকম ভয়ের অঙ্ক থাকলে ঢাকার মেট্রোও তো নির্মাণ করা ঠিক হয়নি। কলকাতার পাতালরেলের ভাড়া আমাদের হিসাবে ৭ থেকে ৩১ টাকা। মাসের হিসাবে সর্বোচ্চ দূরত্বের জন্য ভাড়া দুই হাজার টাকার নিচেই থাকে। মূল্যস্ফীতি হিসাব করলে তা আট বছর পর বড়জোর তিন হাজার হবে। না হয় তার চেয়েও বেশি হবে। আয়ও তো বাড়বে। সেগুলো হিসাবে আছে কি? পৃথিবীর কোন শহরে পাতালরেলের উচ্চ ভাড়ার জন্য যাত্রী কম পাওয়া যাচ্ছে, শুনিনি তো। নিউইয়র্ক শহরে যেমন দিন-আনে-দিন খায় মানুষটিও সাবওয়েতে চড়েন। আবার সাবেক মেয়র ব্লুমবার্গও চড়েন। শুধু মুনাফা সর্বোচ্চকরণের সূত্র ধরে পাতালরেলের যাত্রীভাড়া ঠিক করা হয় না।
সভায় পাতালরেলের বিরোধিতা করতে গিয়ে একজন পরিচালক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত যেসব দেশে পাতালরেলের নির্মাণ করা হয়েছে, সেসব দেশের নাগরিকদের মাথাপিছু আয় আমাদের চেয়ে ২০ থেকে ৪০ গুণ বেশি।’ ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। প্রথমত, ভারতের পাঁচটি পাতালপুরীর উদাহরণ কি গায়েব হয়ে গেল? তাদের আয় আমাদের চেয়ে কত গুণ বেশি? আইএমএফের হিসাবে ২০২২ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় ভারতের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৩১২ ডলারের চেয়ে একটু ওপরেই থাকবে। ২০১৪ সাল থেকে পাকিস্তান চীনের সহায়তায় যে মেট্রোর কাজ শুরু করেছে, তার একাংশ চলে গেছে পাতালপথে। নেপাল কাঠমান্ডুর জন্য পাতালচিন্তায় মগ্ন। রেলের কর্তাব্যক্তি আরও কয়েক বছর আগেই মন্তব্য করেছেন যে ভূপৃষ্ঠে উত্থিত মনোরেলের ভবিষ্যৎ সীমিত। তার চেয়ে নেপাল সরকারের উচিত পাতালরেলে মনোযোগ দেওয়া।
এদের কারোরই কিন্তু মাথাপিছু আয় বা প্রবৃদ্ধি আমাদের চেয়ে বেশি নয়। কিন্তু ভবিষ্যৎ ভাবনা আমাদের চেয়ে প্রখর। সভায় কেউ কেউ পাতালরেল নির্মাণ শুরু হলে ঢাকাবাসীর ভোগান্তি বাড়বে—এমন ভয় দেখিয়েছেন। ঢাকাবাসী কবে ভোগান্তিমুক্ত ছিল, তা জানলে উপকৃত হতাম। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এটা বললেন না যে মেট্রোরেলের জন্য গত এক দশকে নগরবাসীর যে ভোগান্তি হয়েছে, আধুনিক বোরিং প্রযুক্তিতে (ইঁদুরের মাটিকাটা তুল্য কৌশল) পাতালরেল নির্মিত হলে তার ১০ ভাগের ১ ভাগ ভোগান্তিও হবে না। ৬০ থেকে ৭০ ফুট নিচ দিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি চলবে, চোখেও পড়বে না। এ তো ঢাকাবাসীর ভাগ্য। রাশিয়ান পুরোনো উন্মুক্ত ‘কাট অ্যান্ড কাভার’ প্রযুক্তিতে কলকাতাবাসী কতই-না শাস্তি পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের আহ্বান জানাই, আপনারা একটা জাতির ভাগ্য প্রকল্প নিয়ে বসে আছেন। এটা কবিতার জায়গা নয় যে আবেগাপ্লুত হবেন। আবার এটা নিষ্ঠুরতার জায়গা নয় যে জাতিকে যুদ্ধে নামিয়ে দেবেন। যুক্তিগুলোকে ঠিক করুন। পাতালরেল হলে মাথাপিছু আয় বাড়ে। মাথাপিছু আয় বাড়লে পরে পাতালরেল বানায় না। ব্যাপারটা পদ্মা সেতুর মতো। আপনাদের হিসাব-নিকাশ, অর্থনৈতিক মূল্যায়ন, ভবিষ্যতের ভাড়া নির্ধারণের অঙ্কগুলো একটা পাবলিক ওয়েবসাইটে ছাড়ুন। আমরা একটু পড়ে দেখি বুঝি কি না কিংবা মতামত দিতে পারি কি না। পাতালরেল কোনো বাসমালিকের নতুন একটি ট্রাক কেনার বাণিজ্যিক হিসাব-নিকাশ নয়। পাতালরেল বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ঘটিতব্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ। সবচেয়ে দূরদর্শী প্রকল্প। ঢাকার নিচে ঢেকে থাকা আরেক নতুন ঢাকার আবিষ্কার। লাভ-লোকসানের অনুমাননির্ভর বানিয়াসুলভ হিসাব-নিকাশ এখানে বেমানান এবং অযৌক্তিক।
ভরসার স্থল একটিই; প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থরক্ষক বৃহৎ প্রকল্পের ব্যাপারে একজন সাহসী নেতা। এর প্রমাণ তিনি পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে রেখেছেন। সবার নৈরাশ্যের বাণী শুনলে আর পদ্মা সেতু নির্মিত হতো না। এবার ঢাকা পাতালরেলের ক্ষেত্রেও তিনি সেই দূরদৃষ্টি ও দৃঢ়তার সাক্ষ্য দেবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। একটি আধুনিক ঢাকা গড়ার লক্ষ্যে এটি ছিল প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী অঙ্গীকার।
ড. বিরূপাক্ষ পাল কোর্টল্যান্ডের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া প্রোগ্রামের উপদেষ্টা। birupakshapaul@gmail.com