পাকিস্তান থেকে এগিয়ে আছি, পিছিয়ে পড়ছি

১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়, তখন অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক এর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তাঁদের ধারণা ছিল, পৃথিবীর সবচেয়ে জনঘনত্বপূর্ণ এই দেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারবে না। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার, যিনি আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন, বাংলাদেশকে অভিহিত করেছিলেন তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে সহায়তার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গড়িমসির ক্ষেত্রে কিসিঞ্জারের এই ভবিষ্যদ্বাণী কাজ করে থাকতে পারে। তদুপরি স্নায়ুযুদ্ধকালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে নিক্সন-কিসিঞ্জার তাঁদের পরাজয় হিসেবে দেখেছিলেন।

স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতির যাত্রা শুরু ১৯৭২ সালে। সে সময়ে অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে পাকিস্তান এগিয়েছিল। আজ ৪৮ বছর পর প্রায় প্রতিটি সূচকেই তারা বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে আছে। এটাই আমাদের স্বাধীনতার বড় অর্জন। যেকোনো দেশের উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ধরা হয় মানবসম্পদ; যাতে আমরা শুধু পাকিস্তান নয়, অনেক ক্ষেত্রে ভারত থেকেও এগিয়ে আছি। নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নারীর ক্ষমতায়ন, মা ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসে বাংলাদেশের অগ্রগতির অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে চিহ্নিত করেছে ‘বিস্ময়কর ধাঁধা’ হিসেবে।

একটি তুলনামূলক পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১২০ মার্কিন ডলার আর পাকিস্তানের ছিল ১৮০ ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৮২৭ ডলার, পাকিস্তানের ১ হাজার ৬৪১ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ৩ হাজার ৬৬০ কোটি ডলারের পণ্য। পাকিস্তান রপ্তানি করেছে ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের পণ্য। অথচ ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার এবং পাকিস্তানের রপ্তানি ছিল ৭৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ ৪৮ বছর আগে আমাদের রপ্তানি ছিল পাকিস্তানের অর্ধেকের কম। আর এখন আমাদের রপ্তানি পাকিস্তানের দেড় গুণের বেশি। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়, মহা শক্তিধর চীনের পরই।

বাংলাদেশের মুদ্রার মানও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি, ১৯৭২ সালে যা বেশ কম ছিল। বর্তমানে ১ মার্কিন ডলারের সমান বাংলাদেশের ৮৪ টাকা আর পাকিস্তানের ১৪১ রুপি। ২০১৯ সালের ২০ মার্চের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ৩ হাজার ১৬৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার, আর পাকিস্তানের (২০১৯ সালের জানুয়ারি) ১ হাজার ৪৮৮ কোটি ডলার। অর্থাৎ, আমাদের মজুত পাকিস্তানের দ্বিগুণের বেশি।

১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৭ বছর, পাকিস্তানের ৫৪ বছর। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭৩ বছর, পাকিস্তানের ৬৬ বছর। গড় আয়ুতে আমরা ভারতের থেকেও এগিয়ে আছি। বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের মানবসম্পদ সূচকে দেখা যায়, ১৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১০৬তম আর পাকিস্তান ১৩৪তম। এটিতে ভারতও আমাদের পেছনে, ১১৫তম।

এইচএসডিসির রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ পৃথিবীর ২৬তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্ব সূচকে ৪২তম। বাংলাদেশ এগিয়ে আছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেও। ১৯৭১ সালে যেখানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৫০ লাখ এবং পাকিস্তানের ৬ কোটি ৫০ লাখ, সেখানে বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি আর পাকিস্তানের ২০ কোটি ৭০ লাখ। বাংলাদেশের যেসব নীতিনির্ধারক বর্ধিত জনসংখ্যাকে সম্পদ ভাবেন, তাঁদের একবার পাকিস্তান ঘুরে আসা উচিত।

বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ এ বছর বিশ্বের শীর্ষ পাঁচে থাকবে। মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশ ভালো করেছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার, শিশুদের স্কুলে পাঠ গ্রহণের সময়কাল, শিক্ষার মান, প্রাপ্তবয়স্কদের অন্তত ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকা, শিশুদের সঠিক আকারে বেড়ে ওঠাসহ বেশ কয়েকটি সূচক দিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। আদর্শ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসুবিধা পেলে একটি শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে শতভাগ উৎপাদনশীলতা দেখাতে পারে। বাংলাদেশের একজন শিশু বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা পেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গড়ে ৪৮ শতাংশ উৎপাদনশীলতা দেখাতে পারবে। আর পাকিস্তানের শিশুরা ৩৯ শতাংশ।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক প্রতিবেদনমতে, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশ অনেকটাই পেছনে ফেলেছে ভারত ও পাকিস্তানকে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে কেবল নেপালই বাংলাদেশের থেকে এগিয়ে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৪। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী অর্থনীতিগুলোর মধ্যে ভারতের অবস্থান ৬২, পাকিস্তানের ৫২ ও শ্রীলঙ্কার ৪০।

পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ আরও যেসব ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে, তার মধ্যে রয়েছে জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমন। বাংলাদেশ জঙ্গি সমস্যাকে প্রায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। অন্যদিকে বহু বছর ধরেই পাকিস্তান জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের নিরাপদ স্থান হিসেবে পরিচিত। একদা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি তালেবান ছাড়াও ডজনখানেক জঙ্গিগোষ্ঠী দেশটিতে সক্রিয়। শুধু ভারত নয়, অপর দুই প্রতিবেশী আফগানিস্তান ও ইরানও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদ উসকে দেওয়ার অভিযোগ করে আসছে।

এত সব ইতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান থেকে দুটি বিষয়ে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। উচ্চশিক্ষার মান ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। শিক্ষার বৈশ্বিক মানক্রমে পাকিস্তানের অন্তত পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় ১ হাজার ৬০০–এর ঘরে আছে। মানক্রম যথাক্রমে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ১ হাজার ৪৯৭তম, কায়েদে আজম ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১ হাজার ৪৩৮তম, আগা খান বিশ্ববিদ্যালয় ১ হাজার ৪৭৭তম ও পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় ১ হাজার ৬০৪তম। আর বাংলাদেশে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির অবস্থান ৩ হাজার ১৩, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৩ হাজার ৩১, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ৩ হাজার ৩৯৪, খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৩ হাজার ৪৫৫ ও সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ৩ হাজার ৫৮৪তম। (সূত্র: র‌্যাঙ্কিং ওয়েব অব ইউনিভার্সিটিজ)। বৈশ্বিক মানক্রমের ধারেকাছে তো নয়ই, দক্ষিণ এশীয় তালিকায়ও বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ১০০টির মধ্যে নেই।

এবার সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকটি পরখ করে দেখতে পারি। রিপোর্টার্স উইথ আউট ফ্রন্টিয়ার্সের (আরএসএফ) সমীক্ষামতে, ১৮০টি দেশের মধ্যে পাকিস্তানের অবস্থান ১৩৯, ভারতের ১৩৮। আর বাংলাদেশ অন্তত ৯ ধাপ পিছিয়ে ১৪৬তম স্থানে আছে। এ ক্ষেত্রে নেপাল অনেক এগিয়ে আছে, ১০৬তম অবস্থানে।

নানা ঝুঁকি ও বিপদ সত্ত্বেও পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম সরকার, তথা এস্টাবলিশমেন্টের কড়া সমালোচনা করতে পারছে। ৫ এপ্রিল ফ্রাইডে টাইমস-এ নাজাম শেঠি লিখেছেন, ‘পিটিআই সরকার ভিন্নমত দমনের উদ্দেশ্যে ক্রমবর্ধমানভাবে কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠেছে। গত আট মাসে সরকারের আশাহত কার্যক্রমের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, সেটি ঠেকাতেই তারা সরাসরি এই কৌশল নিয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বহু সংবাদমাধ্যমসহ রাষ্ট্র ও সমাজের কতিপয় “স্তম্ভ” ইমরান খানের ভাবমূর্তি এমনভাবে তৈরি করেছে, যে কারণে এখন আর তাঁর অগ্রহণযোগ্য আচরণের সমালোচনা করতে পারছে না। কতিপয়ের এই স্তুতির পেছনে স্বার্থ উদ্ধারের নানা কারণ নিশ্চয়ই আছে।’

একই দিনে দ্য নেশন পত্রিকায় সাংবাদিক মালিক মুহাম্মদ আশরাফ লিখেছেন, ‘পাকিস্তান হলো সেই দুর্ভাগ্যজনক দেশগুলোর একটি, যেখানে সামরিক ও বেসামরিক স্বৈরশাসকেরা ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে জনগণকে বোকা বানিয়েছেন এবং নিজেদের দায়মুক্তি নিয়েছেন। অনিবার্যভাবে তাঁদের উদ্দেশ্য ক্ষমতা গ্রাস করা এবং নিজেদের ভাগ্য তৈরি; একই সঙ্গে তাঁদের ভাগ্য তৈরিতে সহায়তা করা, যাঁরা তাঁদের গণবিরোধী শাসনপদ্ধতির মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষা করতে চান।’

পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম সাহস করে যতটুকু সত্য বলতে পারছে, আমরা তা–ও পারছি না। এ কারণেই সংবাদমাধ্যমের সূচকে পাকিস্তানের চেয়ে ৯ ধাপ পিছিয়ে আছি। গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে অর্জিত বাংলাদেশের জন্য এটি মোটেই গৌরবজনক নয়।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com